খুতবার শাব্দিক অর্থ বক্তৃতা বা বক্তৃতা করা। আর শরিয়তের পরিভাষায় খুতবা বলা হয় এমন বক্তৃতা যাতে আল্লাহর প্রশংসা, তাঁর একাত্মবাদের ঘোষণা, রাসূলের প্রতি দরূদ এবং উপস্থিত সাধারণের প্রতি উপদেশ বিদ্যমান থাকে। (মোজাহেরে হক-১/১০১৯)
খুতবা জুমার নামাজের শর্ত বা ফরজ। খুতবা ব্যতীত জুমার নামাজ হয় না। মুসল্লীদের জন্য খুতবা শ্রবণ করা ওয়াজিব। তাই খুতবা চলাকালে নিরর্থক কর্মে লিপ্ত হওয়া শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ নয়।
হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘জুমার দিন খুতবা প্রদানের সময় যদি তুমি তোমার সাথীকে বলো, ‘চুপ করো’ তখন তুমি অনর্থক কথাই বললে।’ (বোখারি শরীফ-১/১২৮)
এ হাদিস দ্বারা সুদৃঢ়ভাবে প্রমাণিত হয়, খুতবার সময় নিশ্চুপ হয়ে খুতবা শ্রবণ করা ওয়জিব এবং কথাবার্তা বলা হারাম। অনুরূপ খুতবার সময় সুন্নত-নফল নামাজ পড়াও বৈধ হবে না।
এ প্রসঙ্গে অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘যখন ইমাম খুতবার জন্য বের হবেন তখন না নামাজ পড়বে, না কথা বলবে।’ (মেরকাত-৩/৪৩২)
তাই মুসল্লীদের উচিত, খুতবার সময় সর্ব প্রকার কথাবার্তা থেকে বিরত থেকে অত্যন্ত মনোযোগী হয়ে খুতবা শ্রবণ করা এবং যে সকল কাজ নামাজে নিষিদ্ধ তা থেকে বিরত থাকা অতীব জরুরি।
এ প্রসঙ্গে ফিকাহ শাস্ত্রের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ ‘ফাতাওয়ায়ে শামী’ গ্রন্থে একটি মূলনীতি উল্লেখ হয়েছে তা হলো- যে সকল কর্ম নামাজের মধ্যে হারাম তা খুতবার মধ্যেও হারাম। যেমন- কথাবার্তা বলা, পানাহার করা ইত্যাদি। (ফাতাওয়ায়ে শামী-৩/৩৫)
বর্তমানে অনেক মসজিদে লক্ষ করা যায়, খুতবা চলাকালে অনেক মুসল্লীরা নামাজবিরোধী কর্মে লিপ্ত হয় যা সম্পূর্ণ শরিয়ত পরিপন্থি এবং হারাম। এছাড়া অনেক মসজিদে খুতবা চলাকালে চাঁদার বাক্স/থলে চালানো হয়ে থাকে, এটি শরিয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নাজায়েজ। খুতবার সময় এ সমস্ত না জায়েজ কর্ম পরিহার করে মনোযোগী হয়ে খুতবা শ্রবণ করা অত্যন্ত জরুরি।
জুমার খুতবা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আরবি ভাষায় হওয়া আবশ্যক। অন্য কোনো ভাষায় খুতবা দেয়া বৈধ হবে না। (উমদাতুর রে‘য়ায়াহ-পৃ.২০০)
কারণ, রাসূল (সা.)-এর যুগ থেকে নিয়ে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন এবং সমগ্র মুসলিম উম্মাহ সর্বযুগে এ অনুযায়ী আমল করেছেন। তাছাড়া সাহাবায়ে কেরাম অনেক অনারব দেশ বিজয় লাভ করেছিলেন কিন্তু তারপরও ওই সমস্ত দেশে সাহাবায়ে কেরাম আরবি ভাষায় খুতবা প্রদান করতেন। (ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া-১২/৩৬১)
এ প্রসঙ্গে শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. বলেন, জুমার খুতবা আরবি ভাষায় দিতে হবে। কেননা, মুসলিম জাহানের অনেক অঞ্চলের ভাষা অনারবী হওয়া সত্ত্বেও সমগ্র পৃথিবীতে জুমার খুতবা আরবি ভাষায় প্রদান করা হতো। (মুসাফফা-পৃ.২৪৪)
খুতবার কিছু সুন্নত রয়েছে, খতিবদের সে সমস্ত সুন্নত অনুসরণ-অনুকরণ করা প্রয়োজন। ফিকাহ শাস্ত্রের অন্যতম গ্রন্থ ‘ফাতাওয়ায়ে আলমগীরি’ গ্রন্থে খুতবার ১৫টি সুন্নত উল্লেখ করা হয়েছে। তা হলো,
এক. পবিত্রতার সাথে খুতবা প্রদান করা। ওজু ছাড়া বা নাপাক অবস্থায় খুতবা দেয়া মাকরূহ।
দুই. দাঁড়িয়ে খুতবা দেয়া। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত জাবের ইবনে সামুরা রাযি. বলেন, ‘রাসূল (সা.) দাঁড়িয়ে খুতবা দান করতেন।’ (মুসলিম শরীফ-১/২৮৩)
তিন. মুসল্লীদের দিকে মুখ করে খুতবা পাঠ করা। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন মিম্বারে দাঁড়াতেন তখন আমরা তাঁর সম্মুখ হয়ে বসতাম। (তিরমিজি-১/১১৪)
চার. খুতবার পূর্বে অন্তরে ‘আউযুবিল্লাহ’ পাঠ করা।
পাঁচ. মুসল্লীদেরকে খুতবা শ্রবণ করানো, অর্থাৎ, খুতবাকে উচ্চস্বরে পাঠ করা, যাতে করে মুসল্লীরা খুতবা শ্রবণ করতে পারেন।
ছয়. আল্লাহর প্রশংসার মাধ্যমে খুতবা শুরু করা।
সাত. খুতবায় আল্লাহ পাকের এমন প্রশংসা করা, যার উপযুক্ত একমাত্র তিনিই।
আট. খুতবায় কালেমায়ে শাহাদত পাঠ করা।
নয়. রাসূল (সা.) এর ওপর দরূদ পাঠ করা।
দশ. ওয়াজ-নছিহত করা।
এগার. ছোট তিন আয়াত বা বড় এক আয়াত পরিমাণ কোরআন তিলাওয়াত করা।
বার. দ্বিতীয় খুতবায় আল্লাহ পাকের প্রশংসা এবং নবী কারীম (সা.) এর ওপর দরূদ পাঠ করা।
তের. সমগ্র পৃথিবীর মুসলিম নর-নারীর জন্য বেশি বেশি দোয়া করা।
চৌদ্দ. খুতবা সংক্ষিপ্ত হওয়া অর্থাৎ যে সমস্ত তিওয়ালে মুফাসসল সূরা রয়েছে খুতবা সেগুলোর মধ্যে থেকে যে কোনো একটি সূরার পরিমাণ হওয়া। হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে হযরত আম্মার রাযি. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, ‘কোনো ব্যক্তির নামাজের দীর্ঘতা এবং খুতবার সংক্ষিপ্ততা তার সূক্ষ্ম জ্ঞানের পরিচায়ক। সুতরাং তোমরা নামাজকে দীর্ঘ করবে এবং খুতবাকে সংক্ষেপ করবে।’ (মুসলিম শরীফ-১/২৮৬)
পনের. দুই খুতবার মাঝে ছোট তিন আয়াত পড়া যায়, এ পরিমাণ সময় বসা। (ফাতাওয়ায়ে আলমগীরি-১/১৪৬)
আলামা কাসানি রহ. উল্লেখ করেন, জুমার খুতবা দু’টি হওয়া সুন্নত এবং খুতবা মিম্বারে দেয়া সুন্নত। কেননা, রাসূল (সা.) মিম্বারের ওপর দাঁড়িয়ে খুতবা প্রদান করতেন। এ প্রসঙ্গে হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত জাবের ইবনে সামুরা রাযি. বলেন, ‘রাসূল (সা.) দু’টি খুতবা পাঠ করতেন এবং উভয় খুতবার মাঝখানে বসতেন। তিনি কোরআন তিলাওয়াত করতেন এবং লোকদের উপদেশ দিতেন।’ (মুসলিম শরিফ-১/২৮৩)
পাঞ্জেগানা মসজিদে খুতবা দিলে জুমার নামাজ
উত্তরমুছুনআদায় করা যায়।