ক্রিকেট খেলা নিয়ে বর্তমান বাংলাদেশী ও ভারতীয় প্রজন্ম যা শুরু করেছে, সেটা ধর্মান্ধতা থেকেও ভয়াবহ অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। যখন কোন বাংলাদেশী, হিন্দু বা ভারতীয় জনগনকে ধর্মীয় মূল্যবোধে দেখে, তখন তাকে বলে মালু! মালুর বাচ্চা। আবার যখন হিন্দু বা ভারতীয়কে ক্রিকেটের মূল্যবোধে দেখে, তখন তাকে বলে রেন্ডি! রেন্ডির বাচ্চা। ভারতের জনগণও কমে যায় না! একই অবস্তা! আমাদের বাঙ্গালীদের বলে পাকি জারজ, কাঙ্গালী!
আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই কর্পোরেট পুঁজিবাদ সম্পর্কে জানেনা। কর্পোরেট পুঁজিবাদ হলো নব্য সম্রাজ্যবাদ! বর্তমান কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের এক তৃতীয়াংশই আমেরিকার দখলে। বাকিটা পশ্চিম ইউরোপ ও জাপান-কোরিয়ার দখলে। আর এই কর্পোরেট প্রতিস্ঠান গুলো ক্রিকেট ফুটবল, বিনোদন, নাচ-গানের স্পন্সর বা আয়োজনে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যায় করে। বাংলাদেশে ধর্মের নাম ভাঙ্গিয়ে যে দুএকটা কোম্পানি গড়ে উঠেছে তারাও এখন নাক কান বন্ধ করে এসব বিনোদনে কোটি কোটি টাকা ব্যায় করে যাচ্ছে। যার বাস্তবতায় এখনকার খেলোয়ার আর বিনোদন শিল্পীরা আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ! কয়েকদিন আগে নিউজে দেখলাম আমাদের ক্রিকেটার " সাকিব আল হাসান" ২৭৬ কোটি টাকার মালিক! আর ভারতীয় ক্রিকেটারদের প্রত্যেকেই আনুমানিক ৪/৫ শত কোটি টাকার মালিক হবে!
একবার কল্পনা করুন অবস্থা! কিছুদিন আগে আমাদের দেশে এমপিওর দাবিতে প্রাথমিক শিক্ষকদের অনশনে এক শিক্ষক মারা যায়, কৃষকরা ঋণগ্রস্থ হয়ে আত্মহত্যা করে, গ্রামীণ ব্যাংকের কিস্তি দিতে না পেরে এক গৃহবধূর আত্মহত্যা। তাঁতশিল্প আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। হাজার হাজার তাঁতী পরিবারের জন্যে দুবেলা ভাত জুটাতে হিমশিম খাচ্ছে। এ তো আমাদের দেশের কিছু হালচাল। প্রতিবেশী দেশ ভারতের অবস্থা তো আরো ভয়াবহ। যেখানে শত শত কৃষকরা প্রতিবছর দারিদ্র নিপীড়িত হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। দুটি দেশেই দারিদ্রতা আর অভাবের কারণে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ শিশুরা শিক্ষাবঞ্চিত হচ্ছে, স্কুল থেকেই ঝড়ে পড়ছে।
অথচ এগুলো নিয়ে সরকার, এমনকি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান, এনজিওদের উল্লেখযোগ্য কোন সাড়া নেই। সাধারণ জনগণও এসব দেখে দেখে গা সওয়া ভাবধারা পোষণ করছে। ফুটবল ক্রিকেট, আর সিনেমাজগতের দিকে সর্বসাধারণ আজ নেশাগ্রস্থ হয়ে আছে। আরো দুঃখ লাগে যখন দেখি জাতির পথপ্রদর্শকের অনেকেও খেলার জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ফেসবুকে পোষ্ট করে। গতকালই দেখলাম এক মসজিদের খতীব সাহেবও বাংলাদেশের বিজয় কামনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন। কেমন মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত আজ জাতির মূল্যবোধ। অনেকেই আবার ক্রিকেটীয় এ উন্মাদনার পক্ষে গলাবাজি করে। বিভিন্ন ফায়দার কথাও শোনায়। ক্রিকেটের মাধ্যমে নাকি দেশ বহির্বিশ্বে পরিচিতি আর সুনাম লাভ করে। যদি তাই হয় তাহলে একটু বলে দিক জাপান, চিন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইউরোপের উন্নতদেশগুলোর কয়টা দেশ খেলার সুবাদে পরিচিত হয়েছে? শোনা কথা, জাপানে নাকি ক্রিকেটের প্রচলন নেই। কারণ দীর্ঘ সময় মানুষকে কর্মব্যস্তহীন কাটাতে হয়। তারা সময়ের মূল্য দিতে পেরেছে বলেই এত উন্নত। অতি নিকটবর্তী কালেও মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুরের অবস্থা কত নিম্নমানের ছিল তা সবার জানা। তারা কি ক্রিকেট আর ফুটবল খেলেই এত উন্নত?
আজ এদেশের মানুষদেরকে ক্রিকেটপ্রেম, জাতীয়তাবাদসহ নানা চেতনার আফিমে নেশাগ্রস্থ করে রাখা হচ্ছে। পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানগুলো গরীব অসহায় মানুষের রক্ত শুষে তাদেরকেই মোহগ্রস্ত করে রেখেছে বিনোদনের নামে বিভিন্ন চিত্তাকর্ষক জিনিষ দিয়ে। অথচ আমরা বুঝতেই পারছি না বা বোঝার চেষ্টাও করছি না।
আর যদি কিছুক্ষণের জন্যে মানা হয় যে, ক্রিকেট, ফুটবল এগুলো হলো আমাদের বিনোদন ও শরীরচর্চার মাধ্যম। খেলাধূলা মানুষের শারীরিক -মানসিক বিকাশ ঘটায়! আমাদের মন ভাল রাখে! তাহলে এই খেলাধূলা নিয়ে কেন সাম্প্রদায়িকতা, কেন ঘৃণা চর্চা মাতামাতি? ভারত বাংলাদেশে খেলা চলাকালীন অবস্থায় দেশ কেন স্থবির হয়ে যায়। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কেন কমে যায়। মসজিদের জামাতে নামাযের কাতার কেন ফাঁকা হয়? খেলা নিয়ে সবকাজ ত্যাগ করে এত কেন পাগলামী? মানলাম, খেলা-ধূলায় জিতলে হয়ত সাময়িক প্রশান্তি বা আনন্দ পাই! কিন্তু এটা দ্বারা কি আমাদের জীবন চলে? দু চার ম্যাচের জয়ে কি দেশের দারিদ্রসীমার রেখা কমে যাবে? আমরা ক্রিকেট খেলা নিয়ে যেই উন্মাদনা, দেশপ্রেম দেখাই, সেটা কৃষক, শ্রমিক দিনমজুরদের অধিকার আদায়ে কেন নয়? জাতির কাণ্ডারি প্রাইমারী শিক্ষকেয়া যখন দুবেলা ভাতের জন্যে এমপিওর আবেদনে রাস্তায় নেমেছিল তখন কই গিয়েছিল এত উন্মাদনা।
কৃষক শ্রমিক দিনজমুর হাসলেই দেশ জেতে, কৃষক শ্রমীকরা কাঁদলেই দেশ হেরে যায়!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন