জিহাদ আর কিতালের মধ্যে বড্ড তালগোল পাকিয়ে ফেলেছি। কেউ হয়ত না জেনে, আবার কেউ হয়ত সজ্ঞানে। যাকে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা। প্রবাদটার প্রতিক্রিয়ার কারণেও অনেকেই জিহাদ শব্দকে মাযলুম করে দিচ্ছেন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সময় বিপর্যয়ের সূত্রধরেও জিহাদ শব্দকে নির্দিষ্ট ধাঁচে ফেলে কিম্ভুতকিমাকার বানিয়ে ফেলেছে। জিহাদে (ই)কারটা পিস্তল আর (আ)কারটা চাকুর প্রতিবিম্ব বানিয়ে দেয়া হচ্ছে। জঙ্গী আস্ফালনের কারণে এই শব্দটা নিয়ে সচারাচর লেখালেখি করে না কেউ। কিন্ত জানতে হলে লিখতে হবে বা লিখতে হলে জানতে হবে কথাটা তো সত্য। জানা আর লিখা পারস্পরিক সম্বন্ধীয় বিষয়। এইডস সমস্যায় যৌনাচার নিয়ে বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীকে বলতে শোনা যায় "যৌনাচার নিয়ে সঠিক জ্ঞান না থাকার দরুন মানুষ এইডস বা যৌন নিগ্রহের শিকার হচ্ছে। তাই যৌনাচার সম্পর্কে সবার সঠিক ধারণা থাকা চাই।" এজন্যে বিদ্যালয়ে যৌনশিক্ষার ধারা চালু করতে পাঁয়তারা করছে। সেই থিউরিতে আমিও বলতে চাই যে, জিহাদ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না থাকার কারণেই আজ জঙ্গীবাদের সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষকে ধর্মের দুর্বলতায় কাবু করে জিহাদের নামে ভুল ধারণা দিয়ে দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরী করছে অসাধু লোকগুলো। এজন্যে সরকারের উচিৎ দেশের শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরামের মাধ্যমে জিহাদের সঠিক অর্থ তুলে ধরা। জিহাদ ও কিতালের মধ্যে পার্থক্যগুলো প্রচার করে মানুষকে জিহাদের নামে ভুল ধারণা থেকে বাঁচানো। এই বিধানটার সঠিক ব্যাখ্যা পেলে দেশের মানুষ নষ্ট লোকদের অপপ্রচার ধরে ফেলবে। তারা আর সহজেই কোমলমতি তরুণদের মগজধোলাই করে জঙ্গীবাদের কাজে ব্যবহার করতে পারবে না।
বাঁচতে হলে জানতে হবে।
এ তো গেল দেশের অবস্থা। দুঃখের বিষয় হল ইদানীংকালে উলামায়ে হাক্কানীর কিছু বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিও জানিনা কোন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে জিহাদ শব্দটার ব্যাপক অর্থকে সংকীর্ণ করে ফেলেছেন। যেখানে মহান রাব্বুল আলামীন জিহাদ শব্দকে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছেন, কিন্তু আলেমে হক জিহাদকে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করায় কিছু ভাই মানতে পারছেন না। কেন? অথচ তারাও জানেন সত্যটা, কিন্তু মানছেন না। শব্দ আর বাক্যের ফুলঝুরিতে ভিন্নরকম মোটিভেশন করে চলছেন। যদি জিহাদকে সমর-যুদ্ধের সাথে বিশেষায়িত করা হয় তবে আল্লাহর কালাম
ومن جاهد فإنما يجاهد لنفسه "
অর্থঃ যে ব্যক্তি জিহাদ করল ( ভাল কাজ করল) তাহলে সে নিজের জন্যেই জিহাদ করল ( ভাল কাজ করল) (সূরা আনকাবূত, আয়াত- ০৬)
সাহাবায়ে কেরামের উক্তি:-
"رجعنا من الجهاد الاصغر الي الجهاد الاكبر
অর্থঃ আমরা ছোট জিহাদ (সমর-যুদ্ধ) থেকে বড় জিহাদ (নফস শয়তান ও ভ্রান্তপন্থার বিরোধিতার) দিকে প্রত্যাবর্তন করলাম।
এই জাতীয় ইবারতের কী ব্যাখ্যা হবে? এখানে আল্লাহ তায়ালা ও সাহাবায়ে কেরাম 'জিহাদ' শব্দকে যুদ্ধের অর্থে ব্যবহার করেননি। মহান গ্রন্থ আলকুরআনে আরো ইরশাদ হচ্ছেঃ-
جاهدهم به جهادا كبيرا"
অর্থঃ- তাদের সাথে আপনি কুরআনের মাধ্যমে বড় জিহাদ করুন। এখানে কথার মাধ্যমে বাতিলের মোকাবেলাকে জিহাদ বুঝানো হয়েছে। ( সূরায়ে ফুরক্বান, আয়াত নং- ৫২)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছেঃ-
ومن جاهد فإنما يجاهد لنفسه
অর্থঃ যে ব্যক্তি জিহাদ করল ( ভাল কাজ করল) তাহলে সে নিজের জন্যেই জিহাদ করল ( ভাল কাজ করল)। (সূরায়ে আনকাবুত, আয়াত নং- ০৬)
এখানে নেক আমলকে জিহাদ বলা হয়েছে।
ইমাব রাগেব ইস্পাহানী রাহ. কিতাবুল মুফরাদাতের মধ্যে জিহাদের তিন অর্থ করেছেন। তিনি বলেনঃ-
والجهاد ثلاثة أضرب: مجاهدة العدو الظاهر، ومجاهدة الشيطان، ومجاهدة النفس
অর্থঃ জিহাদ তিন প্রকার। (১) প্রকাশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে মোকাবেলা। ২. শয়তানের বিরুদ্ধে মোকাবেলা ৩. কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে মোকাবেলা করা। (আল মুফরাদাত, ৭৮ পৃষ্ঠা)
এসকল ইবারত দ্বারা বুঝা যায় জিহাদ শব্দটার ব্যাপক অর্থ বহন করে। ধর্মীয় পবিত্র যুদ্ধে বাতিলের মোকাবেলা করাকে যেমন জিহাদ বলে তেমনি মুখের কথা দিয়ে, কলমের খোঁচা দিয়ে বাতিলের বিরোধিতা করা বা শয়তানের বিরুদ্ধে নেক আমলের পাহাড় গড়ে তোলাকেও জিহাদ বলে। তেমনি আল্লাহ ভোলা মানুষকে আল্লাহর পথে আহবান করা কিংবা খোদার বিধান বাস্তবায়নের লক্ষে যোগ্য নেতাকে বেছে নেওয়াও প্রকারান্তে জিহাদের অন্তর্ভুক্ত। যদিও এটাকে কিতাল বলা হবে না। কারণ জিহাদ আর কিতাল একক নয়। কিতাল হল ধর্মীয় পবিত্র যুদ্ধে বাতিলের মোকাবেলা করা। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ
فإن قاتلوكم فاقتلوهم
অর্থঃ যদি তারা কিতাল (যুদ্ধ) করে তবে তোমরাও কিতাল (যুদ্ধ) করবে।( সূরায়ে বাক্বারাহ, আয়াত নং ১৯১)
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছেঃ-
كتب عليكم القتال وهو كره لكم
অর্থঃ তোমাদের উপর কিতাল (ধর্মযুদ্ধ) ফরজ করে দেওয়া হয়েছে যদিও তোমরা অপছন্দ। ( সূরায়ে বাকারাহ - ২১৬)
এই আয়াতসমূহের ইবারত দ্বারা বুঝা যায় কিতাল শব্দটার অর্থ নির্দিষ্ট। তাহল ধর্মীয় পবিত্র যুদ্ধে বাতিলের মোকাবেলা করা। এজন্য উলামায়ে কেরাম বলেনঃ
الجهاد اعم من القتال ، فالجهاد يكون باللسان ، ويكون بالسنان - وهو القتال - ، ويكون بالمال ،
فالجهاد باللسان منه جهاد الكافرين ، ومنه جهاد المنافقين ، ومنه جهاد أهل البدع ، ومنه جهاد أهل الضلال والشهوات .
وأما القتال فلا يكون إلا بالسنان ، فمنه قتال الكفار،
অর্থঃ "জিহাদ শব্দটা কিতাল থেকে ব্যাপক। অতএব জিহাদ কখনো যবানের মাধ্যমে হয়। কখনো অস্ত্রের মাধ্যমে হয় (যেটাকে কিতাল বলে)। কখনো অর্থ সম্পদের মাধ্যমে হয়। আর যবানী জিহাদের অন্তর্ভুক্ত হবে বিধর্মী, মুনাফিক, বিদয়াতী পথভ্রষ্ট ও নফসপূঁজারীদের বিরুদ্ধে মৌখিক বিরোধিতাও। তবে কিতাল কেবল অস্ত্রের যুদ্ধকেই বলে। যেমনঃ বিধর্মীদের সাথে ধর্মযুদ্ধ।"
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা বুঝতে পারলাম যে, জিহাদ শব্দের অর্থ কেবলই যুদ্ধ নয়। নফসের বিরোধিতা, নেক আমল করা, ওয়াজ নসীহত ও বাতিলের বিরুদ্ধে হকের কথা বলা ও লিখাও জিহাদের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এই শব্দটা নিয়ে জলঘোলা করে নিজ স্বার্থ পূরণের চেষ্টা না করাই ভাল।
আল্লাহ আমাদেরকে বুঝার তাওফিক দিন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন