শিশুদের প্রহার করা মোটেও উত্তম চরিত্র নয়। হোক তিনি শিশুর অভিভাবক বা পাঠদানের শিক্ষক। ভালুকায় শিক্ষকের প্রহারের দরুন চিকিৎসার অভাবে এক মাদ্রাসা ছাত্রের মৃত্যুর খবরে সোশাল মিডিয়া সরগরম। সরকার ১০১০ কওমী (বাস্তবে যদিও ভিন্ন) আলেমকে চাকরি দেওয়ায় যারা হাতের তালু কামড়িয়ে আক্ষেপের দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছেন। তারা এবার খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে এসে মাতালের মত কওমী আলেম ও মাদ্রাসার বিপক্ষে উল্টো বমি শুরু করছেন। নিউজটাকে বাড়িয়ে চড়িয়ে মসলা মাখিয়ে মুখরোচক খাবার হিসেবে পরিবেশন করছেন আর এলার্জিযুক্ত আবাল কিছু বাঙ্গালী মাদ্রাসা শিক্ষা, আলেম হাফেজ, ইসলাম ও হাদীস কুরআনকে ধুইয়ে দিচ্ছে। আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা দিচ্ছি, ভালুকার অভিযুক্ত শিক্ষককে সরকার গ্রেফতার করে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করুক। এব্যাপারে কোন আলেম হাফেজ কেউ আপত্তি জানাবে না। বরং তার মত মানসিক ভারসাম্যহীন শিক্ষককে উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের জন্যে জোড় দাবী জানাচ্ছি। যাতে ভবিষ্যতে দ্বিতীয় কোন শিক্ষক নামের কলংক কেউ এরূপ করার সাহস না পায়। তাই বলে তোমরা শতভাগ সফলভাবে মানুষ গড়ার সর্বোত্তম শিক্ষা কারিকুলাম এবং জাতির সর্বোচ্চ সম্মানীত ব্যক্তিদের বিপক্ষে কুৎসা গেয়ে বেড়াবে তা কখনোই হতে দেওয়া হবে। এক বিকৃত মানসিক প্রতিবন্ধী শিক্ষকের কারণে যদি কওমী শিক্ষা ধারাকে অকার্যকর বল তাহলে জাগতিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে বহু আগেই নিস্ফল বলে বাতিল করা উচিৎ ছিল। যাদের অন্তর বক্রতায় গড়া, মন যাদের কুটিলতায় ভরা, উলামায়ে কেরামের পোষাকের শুভ্রতায় যাদের গাত্রদাহ হতে থাকে তারা যখন নিজেরা কোমলমতি শিশুর পায়ুপথে বাতাস দিয়ে হত্যা করে তখন কোন সমস্যা হয় না। হোটেলের অর্ডার ডেলিভারি দেওয়ার সময় গায়ে পানি ঢেলে পড়ার অপরাধে প্রফেসর সাহেব যখন ছেলেটার গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দেন তখন এটা হয় নীতিশিক্ষা। পুলিশ যখন জনতার সামনে শিশুবাচ্চাকে বেধড়ক মারধর করে তখন কেউ পুরো পুলিশ বাহিনিকে দোষারোপ করে না। যত দোষ মোল্লাদের। দেশের সত্তর হাজারেরও বেশী কওমী মাদ্রাসার মধ্যে বিচ্ছিন্ন কোন একটা মাদ্রাসায় ব্যতিক্রমী কিছু ঘটলে পুরো মাদ্রাসা সিস্টেমকে দোষারোপ করা শুরু হয়। এটা কোন ধরণের ইনসাফ? এটা কেমন বিচার??
এবার আসি আসল কথায়।
শিশুকে শিক্ষা দিতে প্রহার করা কি আদৌ সঠিক পন্থা? না। কখনোই না। মনে রাখা উচিত, শরীয়তের দৃষ্টিতে শিশুদের পরিচয়, তারা গায়রে মুকাল্লাফ তথা দায়ভার ও জবাবদিহিতা থেকে মুক্ত। তারা শারীরিকভাবে যেমন দুর্বল তেমনি মানসিকভাবেও কোমল। তাই তাদের সাথে কোমল ও নরম আচরণ করতে হবে। তাদেরকে শিক্ষাদান করতে হবে মায়ের স্নেহ-মমতা দিয়ে। এক্ষেত্রে ডাঁট-ধমক ও কঠোরতা পরিহার করে নম্রতা ও কোমলতা অবলম্বন করতে হবে।
হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. হতে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসের শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা আমাকে হঠকারী ও কঠোরতাকারীরূপে প্রেরণ করেননি; বরং সহজ-কোমল আচরণকারী শিক্ষকরূপে প্রেরণ করেছেন।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৪৭৮
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম গাযালী রাহ. বলেন, এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, শিক্ষার্থীর ভুল-ত্রুটিগুলো যথাসম্ভব কোমলতা ও উদারতার সাথে সংশোধন করতে হবে এবং দয়া ও করুণার পন্থা অবলম্বন করতে হবে। ধমক ও ভৎর্সনা নয়।-আর রাসূলুল মুয়াল্লিম, পৃ. ১১
আরেক হাদীসে এসেছে হযরত মুআবিয়া ইবনে হাকাম রা. বর্ণনা করেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে নামাযরত ছিলাম। হঠাৎ এক ব্যক্তি (নামাযের মধ্যে) হাঁচি দিল। প্রতিউত্তরে আমি ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বললাম। লোকজন তখন আমার দিকে চোখ তুলে তাকাচ্ছে। আমি বলে উঠলাম, আপনাদের কী হয়েছে? আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছেন কেন? লোকজন তাদের উরুতে হাত চাপড়িয়ে আমাকে শান্ত ও চুপ হতে ইঙ্গিত করল। আমি চুপ হয়ে গেলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাম ফিরিয়ে নামায শেষ করলেন। আমার পিতামাতা তার প্রতি উৎসর্গিত হোন, তার মতো এত উত্তম ও সুন্দর শিক্ষাদানকারী কোনো শিক্ষক তার পূর্বেও কাউকে দেখিনি এবং তার পরেও দেখিনি। আল্লাহর কসম! তিনি আমাকে না প্রহার করলেন, না তিরস্কার করলেন, না ধমক দিলেন; তিনি বললেন, আমাদের এই নামায মানষের কথাবার্তার উপযোগী নয়। (অর্থাৎ নামাযে এ ধরনের কথা বলা যায় না।) বরং এ তো হল তাসবীহ, তাকবীর ও তেলাওয়াতে কুরআন।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৫৩৭;
স্বভাব-প্রকৃতির কারণেই শিশুরা অন্যদের চেয়ে ব্যতিক্রম। তাই শিশুদের শিক্ষাদান খুবই কঠিন। শান্ত-শিষ্টতার চেয়ে চপলতা ও চঞ্চলতাই তাদের মধ্যে প্রবল। ফলে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করাও বেশ কষ্টকর। কখনো কখনো পরিস্থিতি এমন হয়ে যায় যে, শিক্ষকের মধ্যে ক্রোধের ভাব সৃষ্টি হয়ে যায় এবং প্রহার করার অবস্থা সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় শাস্তি দেওয়া উচিত নয়। এ সময় শাস্তি দিবে না; বরং নীরব-নিশ্চুপ থেকে নিজের রাগ দূর করবে। তারপর করণীয় ঠিক করবে। এটাই ইসলামের শ্বাশ্বত শিক্ষা ও ধর্মীয় নির্দেশনা।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. হতে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা শিক্ষাদান কর, সহজ ও কোমল আচরণ কর; কঠোর আচরণ করো না। যখন তুমি রাগান্বিত হবে তখন চুপ থাক। যখন তুমি রাগান্বিত হবে তখন চুপ থাক। যখন তুমি রাগান্বিত হবে তখন চুপ থাক (এ কথা তিনবার বললেন)।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৫৫৬, ২১৩৬; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ২৫৮৮৮; মুসনাদে বাযযার, হাদীস : ১৫২, ১৫৩; মুসনাদে আবু দাউদ ত্বয়ালিসী, হাদীস : ২৬০৮; আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীস : ২৪৫,
মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. বলেছেন, শিশুদেরকে প্রহার করা খুবই ভয়াবহ। অন্যান্য গুনাহ তো তওবার মাধ্যমে মাফ হতে পারে। কিন্তু শিশুদের উপর জুলুম করা হলে এর ক্ষমা পাওয়া খুবই জটিল। কেননা এটা হচ্ছে বান্দার হক। আর বান্দার হক শুধু তওবার দ্বারা মাফ হয় না। যে পর্যন্ত না যার হক নষ্ট করা হয়েছে সে মাফ করে। এদিকে যার উপর জুলুম করা হয়েছে সে হচ্ছে নাবালেগ। নাবালেগের ক্ষমা শরীয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। এজন্য এ অপরাধের মাফ পাওয়া খুবই জটিল। আর তাই শিশুদেরকে প্রহার করা এবং তাদের সঙ্গে মন্দ ব্যবহার করার বিষয়ে সাবধান হওয়া উচিত। -ইসলাহী মাজালিস, মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সঠিক বুঝার তাওফিক দিন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন