বিমার সংজ্ঞা :
বিমার ইংরেজি প্রতিশব্দ ইন্স্যুরেন্স (Insurance) যার অর্থ হল নিরাপত্তা দেওয়া বা গ্যারান্টি প্রদান করা। নিশ্চয়তা প্রদান করার অর্থেও শব্দটির বহুল ব্যবহার প্রচলিত। উউলামায়ে কেরামের ভাষায় বিমার আলাদা আলাদা কিছু পারিভাষিক পরিচয়ও রয়েছে। যেমন বাংলাদেশের শাণিত কলমের অধিকারীদের একজন মাওলানা আবুল ফাতাহ ইয়াহইয়া সাহেব -মুদ্দা জিল্লুহু- বলেন, "বিমা হল এক ধরণের অর্থ লেনদেনের চুক্তি, যাতে ভবিষ্যতে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে তার ক্ষতিপূরণ দেয়ার গ্যারণ্টির ভিত্তিতে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত কিস্তিতে টাকা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। যে সংস্থা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার শর্তে টাকা গ্রহণ করে তাকে বলা হয় বিমা কোম্পানি।"
আরেক বরেণ্য ব্যক্তিত্ব আল্লামা তাকী উসমানী দা.বা. বিমার পরিচয় তুলে ধরেন এভাবে যে, "মানুষের ভবিষ্যতে সম্ভাব্য দুর্ঘটনা যা ঘটতে পারে, কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সে সকল দুর্ঘটনার আর্থিক ক্ষতিপূরণের দায়িত্ব গ্রহণ করা।"
মাওলানা ইসহাক সাহেব রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বিমার বাস্তবতা ও পরিচয় অত্যন্ত সুন্দর ও সাবলীলভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন- বিমা মূলতঃ বিমা কোম্পানি ও আবেদনকারীর মধ্যবর্তী এক চুক্তি। এর পদ্ধতি হল, বিমা কোম্পনি নির্দিষ্ট মেয়াদে গ্রাহক থেকে নির্ধারিত হারে কিস্তির আকারে এক নির্দিষ্ট অংকের অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। মেয়াদ শেষে উক্ত নির্দিষ্ট অংকের টাকার সাথে আরো কিছু টাকা বৃদ্ধি করে গ্রাহককে বা গ্রাহক কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তিকে ফেরৎ প্রদান করা হয়ে থাকে। উক্ত বাড়তি টাকাকে পরিভাষায় বোনাস অভিহিত করা হয়। যেমনঃ কোন গ্রাহক থেকে যদি পাঁচ বছরে কিস্তি আকারে ৬,০০০ টাকা সংগ্রহ করে থাকে তাহলে মেয়াদ শেষে উক্ত গ্রাহককে ৬,০০০ টাকার সাথে আরো এক দেড় হাজার টাকা বৃদ্ধি করে দিয়ে দেওয়া হয়। পরিভাষায় এই অতিরিক্ত বাড়তি টাকাকেই বোনাস বলা হয়। সাথে সাথে কখনো কোন গ্রাহক যদি দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয় তাহলে সেই বিমা কোম্পানি তাকে আর্থিক সহায়তাও প্রদান করে থাকে। এটা হল গ্রাহকের লাভের দিক। এক্ষেত্রে কোম্পানির লাভের দিকটা হল - গ্রাহক থেকে গ্রহণকৃত অর্থ উচ্চসুদে লাগিয়ে বিশাল অংকের মুনাফা অর্জন করা। চাই সেটা ব্যবসার মাধ্যমে হোক বা অন্যকোন খাতের মাধ্যমে। আর গ্রাহকের অর্থ দ্বারা অর্জিত সেই বিশাল মুনাফার সামান্যতম অংশ গ্রাহককে বোনাস হিসেবে প্রদান করে থাকে। কখনো প্রয়োজন হলে সেই সামান্যতম অংশ দ্বারাই দুর্ঘটনাকবলিত ব্যক্তিকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকে। কিন্তু মূল উদ্দেশ্য থাকে মুনাফা অর্জন।
বিমার সূচনা :
বর্ণিত আছে বিমার সূচনা ঘটে চতুর্দশ শতকের দিকে। তৎকালীন সময়েও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বর্তমান সময়ের মত সাগর পথে মালামাল আমদানি রপ্তানি হত। অনেক সময় পণ্যবাহী জলজাহাজ দুর্যোগে ডুবে যেয়ে মাল সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেত। এতে করে ব্যবসায়ীরা নিঃসম্বল অসহায় হয়ে পড়ত। এর কোন সুরাহা করা যায় কি না? এ নিয়ে তদানীন্তন সময়ে ব্যাপক গবেষণার পর সর্বপ্রথম ইটালিয়ান বণিকরা একটি পদ্ধতি আবিষ্কার কররে সক্ষম হন। সেই পদ্ধতিটি ছিল এমন - যদি কোন ব্যক্তির পণ্যবাহী জাহাজ মালামালসহ সাগরে নিমজ্জিত হয় তখন অন্যান্য সকল বণিকরা তাকে সাহায্য করার জন্যে প্রতিমাসে নির্দিষ্ট হারে অর্থ সঞ্চয় করত। সে ফান্ড থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত বণিককে সহায়তা প্রদান করা হত।এতে করে কোন ব্যক্তির পণ্যবাহী জাহাজ সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হলেও সে একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ত না। এ উদ্যোগটিই পরবর্তীতে নৌবিমা হিসেবে পূর্ণতা লাভ করে।
অন্য এক বর্ণনা পাওয়া যায়, সর্বপ্রথম উন্দুলুসের এক মুসলিম শাসকের যুগে সমুদ্রপথে ক্ষতিগ্রস্ত বণিকদের সাহায্য করণার্থে ব্যবসায়িক বিমার (Commercial Insurance) পদ্ধতি সূচিত হয়। তখনকার সময়ে বিমার পদ্ধতি ও নিয়মকানুন ছিল একদম সাধারণ। পরবর্তিতে বিভিন্ন সময়ে ধাপে ধাপে বিমায় নতুন নতুন পদ্ধতি চালু হতে থাকে। নেদারল্যান্ডস এক্ষেত্রে সবার চেয়ে একধাপ এগিয়ে। বর্তমানে অনেক দেশে বিভিন্ন খাতে বিমা করা রাষ্ট্রীয় আইনে রূপান্তরিত করা হয়েছে। সে সকল দেশের জনগণকে বাধ্য হয়েই বিমা করতে হচ্ছে। আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে চিকিৎসা বিমা (Medical Insurance) এবং বিশ্বের প্রায় সব দেশেই দায়িত্ব বিমা (Third party Insurance) করাটা আবশ্যক।
উসমানী খেলাফতের সময়ে তুর্কি বণিকরা যখন ইউরোপিয়ান বণিকদের সাথে বাণিজ্যে জড়িত হয়ে পড়ে, সে সময় ইউরোপিয়ান ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রসমূহে বিমার ব্যাপক প্রচলন ঘটে। তৎকালীন আলেমদের নিকট এ ব্যাপারে বিভিন্ন প্রশ্ন আসতে থাকে। যেমন ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রশিদ্ধ ফকীহ আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ফাতাওয়ায়ে শামী-তে " নিরাপত্তা বিধান সংক্রান্ত আলোচনায় " سوكرة " নামে বিমার কথা উল্লেখ করে বলেন :-
وبما قررنا يظهر جواب ما كثر السوال عنه في زماننا وهو أنه جرت العادة أن التجار اذا استاجروا مركبا من حربي يدفعون له أجرته ويدفعون أيضا مالا معلوما لرجل حربي مقيم في بلاده يسمي ذالك المال "سوكرة" علي أنها مهما هلك من المال الذي في المركب بحرق أو غرق أو نهب أو غيره. فذالك الرجل ضامن له بمقابلة ما يأخذه منه وله وكيل عنه مستامن في دارنا يقيم في البلاد السواحل الاسلامية باذن السلطان يقبض من التجار مال السوكرة، وأذا هلك مالهم في البحر شيئ يودي ذالك المستامن من التجار بدله تماما. ( رد المحتار ٤/١٧٠)
অর্থঃ "আমাদের আলোচনার মাধ্যমে ঐ প্রশ্নের উত্তরও সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে প্রশ্নটি আজকাল অনেক বেশি উত্থাপিত হচ্ছে। তা হল - বর্তমান সময়ে একটা পদ্ধতির প্রচলন ঘটেছে যে, কোন হারবী ব্যক্তি যখন কোন সামুদ্রিক পণ্যবাহী জাহাজ ভাড়ায় নেয় সে ঐ ভাড়া পরিশোধ করার সাথে সাথে দারুল হারবের কোন বাসিন্দা যে দারুল হারবেই অবস্থান করে থাকে, তাকে কিছু অর্থ এই শর্তে দেয় যে, জাহাজের মালামাল জাহাজ ডুবিতে বা অগ্নিকাণ্ডে অথবা লুটতরাজের কারণে বিনষ্ট হলে সে ব্যক্তি উক্ত মালের আর্থিক ক্ষতিপূরণ বহন করবে। সে অর্থ কে "আরবী " বিমা অর্থ বলে অভিহিত করা হত। তার দায়িত্বশীল ব্যক্তি ইসলামী রাষ্ট্রের সমুদ্র বন্দরে সরকারী নির্দেশ মাফিক নিরাপত্তা লাভ করতঃ অবস্থান করত। সে বণিকদের থেকে বিমার অর্থ উসুল করত এবং মালামালের ক্ষয়ক্ষতি হলে ব্যবসায়ীকে ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থ প্রদান করত।" (ফাতাওয়ায়ে শামী ৩/৩৪৫)
উক্ত ইবারতের মাধ্যমে বুঝা যায় তৎকালীন সময়ে সামুদ্রিক বিমার প্রসার বেশ ভালভাবেই হয়েছিল। ইউরোপ থেকে যে সকল জাহাজ ভাড়ায় আনা হত সেগুলোকে আবশ্যকীয়ভাবে বিমা করাতে হত।
ভূমিকায় আরেকটি কথা না বললেই নয়; তাহল - বিমার সূচনা যে উদ্দেশ্য নিয়ে হয়েছিল তা ছিল সম্পূর্ণ সঠিক। বিমার মাধ্যমে শুধুমাত্র ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তা করাই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। যেন অন্যান্য বণিকদের মতই একজন বণিক নিয়তির পরিহাসে নিঃস্ব হয়ে মানবেতর জীবন যাপন না করে। আর একথা তো সুস্পষ্ট যে, পারস্পরিক সাহায্যের মাধ্যমে সহায়-সম্বলহীন ব্যক্তিকে সহায়তা করা নিঃসন্দেহে অতিপ্রশংসনীয় উদ্যোগ। ইসলাম ধর্ম বরাবরই এব্যাপারে গুরত্ব প্রদান করে আসছে। কিন্তু বড় পরিতাপের বিষয় হল এই যে, তৎকালীন যুগেই বিমার এ মহৎ উদ্দেশ্যটি আপন অবস্থায় বাকী থাকেনি। বিমা যখন ইহুদীদের হাতে যাওয়ার পর তারা এর মাঝে সুনিপুণভাবে সুদ ও জুয়ার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে দিল। যেমন শায়েখ আবু যুহরা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেনঃ
اگرچہ اسکی اصلیت تو تعاون محض تھا لیکن اسکا انجام بھی ہر اس ادارہ کا سا ہوا جو یہودیوں کے ہاتھ میں پڑا کہ یہودیوں نے اس نظام کو جس کی بنیاد تعاون علی البر والتقوی پر تھی، اسے ایک ایسے یہودی نظام میں تبدیل کردیا جس میں قمار (جوا) اور ربوا (سود) دونوں پائے جاتے ہیں،
(لواء الاسلام)
অর্থঃ- বিমার মূলভিত্তি যদিও পারস্পরিক সহযোগিতার উপর ছিল কিন্তু তার শেষ ফল ঠিক ঐসকল সংস্থার ন্যায় হয়েছে যা ইহুদীদের অন্তর্গত ছিল। তারা যে ব্যবস্থার ভিত্তি ছিল ( تعاون علي البر والتقوي ) অর্থাৎ নেককাজ ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অপরকে সাহায্য করা। এর উপর, সেই ব্যবস্থাকে এমন ইহুদি ব্যবস্থায় পরিবর্তন করে দিয়েছে যার মধ্যে জুয়া ও সুদ উভয়টির উপস্থিতি বিদ্যমান।
বিমার প্রকারভেদঃ- উপরিউক্ত আলোচনার পর বিমার সুরত বা পদ্ধতি আরো সুস্পষ্টভাবে জানার জন্যে বিমার প্রকারভেদ জেনে নেওয়াটা জরুরী। বর্তমান সময়ে বিমার অনেক প্রকার ও শাখা-প্রশাখা বিদ্যমান। প্রত্যেক কোম্পানি গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী বিমা প্যাকেজ তৈরি করে থাকে। তবে মৌলিকভাবে বিমাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। সেগুলো হলঃ-
১. সম্পত্তি বিমা (Good Insurance)
২. দায় বিমা বা তৃতীয় পক্ষ বিমা (Third Party Insurance)
৩. জীবন বিমা (Life Insurance)
উপরোক্ত বিষয়গুলোর প্রত্যেকটির সাথে যেহেতু ইসলামী বিধিবিধান জড়িত রয়েছে, তাই বিষয়গুলো খুলে খুলে আলোচনা করার দাবি রাখে। নিচে তার আলোচনা করা হলঃ-
১. সম্পত্তি বিমা (Good Insurance) আরবীতে বলা হয় تأمين الاشياء এর পক্রিয়া বা পদ্ধতি হলঃ- কোন ব্যক্তি কোন পণ্যের বিমা করাতে চাইলে সে নির্দিষ্ট হারে বিমা কোম্পানি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ফিস হিসেবে পরিশোধ করতে থাকে যা অফেরৎযোগ্য। এই নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ যা ফিস হিসেবে পরিশোধ করা হয় তাকে প্রিমিয়াম (Premium) বলা হয়। প্রিমিয়াম যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধাপে ধাপে পরিশোধ করা হয়ে থাকে, এজন্য আরবীতে তাকে (আরবী) কিস্তি বলে। এখন সেই পণ্যটি দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেলে বিমা কোম্পানি তার আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিবে। আর যদি সে পণ্যটি কখনোই কোনরূপ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তাহলে বিমা কোম্পানি তাকে কিছুই প্রদান করে না। বিমা গ্রহীতা যে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রিমিয়ামরূপে জমা পরিশোধ করেছিল তাও ফেরত পায় না। যেমন কেউ কোন বিল্ডিংয়ের উপর বিমা করল। এজন্য সে বিমা কোম্পানিকে এক বছরে প্রতিমাসে ৫ হাজার টাকা হারে ৬০,০০০ হাজার টাকা প্রিমিয়াম পরিশোধ করল। এখন উক্ত বিল্ডিংয়ে কোন ক্ষয়ক্ষতি হলে, যেমন আগুন লাগলে বা ভূমিকম্প দ্বারা ক্ষতি হলে বিমা কোম্পানি ক্ষতিপূরণ বহন করবে। আর যদি নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে বিল্ডিংয়ের কোন ক্ষতি না হয় তাহলে গ্রাহক যে প্রিমিয়াম জমা করেছে তা ফেরত পাবে না।
এমনিভাবে সামুদ্রিক জাহাজের বিমা করা হয়। তার প্রক্রিয়া এমনঃ- জাপান থেকে সমুদ্র পথে কোন পণ্য আমদানি হবে বাংলাদেশে। কিন্তু সমুদ্র পথে জাহাজ ডুবে গিয়ে আমাদানিকারীর সমূহ ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশংকা রয়েছে। এজন্য আমদানিকারী সেই জাহাজ ও তার মালামালের বিমা করে থাকে। এক্ষেত্রে বিমা প্রতিষ্ঠানকে সে নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রিমিয়াম আদায় করে আর বিমা কোম্পানি তাকে এই নিশ্চয়তা দিয়ে দেয় যে, তার পণ্যবাহী জাহাজ যদি ক্ষতিগ্রস্থ হয় তাহলে বিমা কোম্পানি সে ক্ষয়ক্ষতির দায়ভার গ্রহণ করবে।
তদ্রূপ গাড়ীর বিমাও করা হয়। তা এভাবে যে, গাড়ী চুরি হয়ে গেলে বা আগুনে বিনষ্ট হয়ে গেলে বিমা কোম্পানি তার দায়ভার গ্রহণ করবে। বদলে গাড়ির মালিক বিমা কোম্পানিকে নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রিমিয়াম পরিশোধ করবে। নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে গাড়ির কোন ক্ষতি হলে তো বিমা কোম্পানি তা বহন করবে, আর যদি কোন ক্ষয়ক্ষতি না হয় তাহলেও গাড়ির মালিক তার প্রিমিয়াম থেকে কোন অর্থ ফেরত পাবে না।
বর্তমানে প্রায় প্রত্যেকটি বস্তুর বিমা করার প্রচলন শুরু হয়েছে। এমনকি বিভিন্ন খেলোয়াড়, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের করিয়ে রেখেছেন। এর পদ্ধতি অনেকটা এমন যে, কোন অভিনেতা বিমা কোম্পানিকে তার শরীরের কোন অঙ্গের বিমাস্বরূপ নির্দিষ্ট অংকের টাকা প্রিমিয়াম পরিশোধ করবে। অতঃপর নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে যদি উক্ত অঙ্গের কোন ক্ষতি হয় তাহলে বিমা কোম্পানি সে অঙ্গের ক্ষতিপূরণ আদায়ে বাধ্য থাকবে। আর ক্ষতি না হলে গ্রাহক যে অর্থ প্রিমিয়াম হিসেবে জমা করেছে, বিমা কোম্পানি তার মালিক হয়ে যাবে গ্রাহক কোন টাকা ফেরৎ পাবে না। যেমন মার্কিন গায়িকা মারায়া ক্যারির তার দুই পা বিমা করেছেন দশ কোটি ডলারে। অন্য মার্কিন গায়িকা ও অভিনেত্রী জেনিফার লোপেজ তার নিতম্ব বিমা করিয়ে রেখেছেন ৩০ কোটি ডলারে। (বাংলা নিউজ২৪, ১৮ মার্চ ২০১৫ইং)
২. দায় বিমা বা তৃতীয় পক্ষ বিমা : আরবীতে এটাকে " تأمين المسئولية " এর পদ্ধতি হল কারো উপরে ভবিষ্যতে কোন দায়িত্ব আরোপিত হতে পারে, এ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্যে বিমা করা হয়। এটাকে তৃতীয় পক্ষ বিমা (Third Party Insurance) বলা হয়। যেমন কোন ব্যক্তি রোডে গাড়ী নামাবে। এই গাড়িতে এক্সিডেন্ট হয়ে অন্যকোন ব্যক্তি বা বস্তুর প্রাণহানি বা ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। এজন্য গাড়ীর ক্রেতা উক্ত ক্ষতিপূরণ থেকে দায়মুক্ত হওয়ার লক্ষে গাড়ীর বিমা রাখেন এবং নির্দিষ্ট হারে প্রিমিয়াম পরিশোধ করতে থাকেন। অতঃপর উক্ত গাড়ী যদি কখনো এক্সিডেন্ট করে আর তাতে কারো প্রাণহানি বা ক্ষয়ক্ষতি হয়, তখন গাড়ীর মালিকের পক্ষ থেকে বিমা কোম্পানি সে প্রাণহানি বা ক্ষয়ক্ষতির দায়ভার গ্রহণ করবে এবং গাড়ীর মালিকের উপর যে জরিমানা আরোপিত হবে বিমা কোম্পানি তা পরিশোধ করে দিবে। আর যদি সেরূপ কোন দুর্ঘটনা না ঘটে তাহলে গাড়ীর মালিককে বিমা কোম্পানি কোন অর্থই দিতে হবে না। এমনকি প্রিমিয়াম হিসেবে যা জমা দিয়েছে তাও গাড়ীর মালিক ফেরৎ পাবে না।
আমেরিকাসহ অন্যান্য অনেক দেশে রাতে প্রচুর পরিমাণে তুষারপাত (Snowfall) হয়। বরফে রাস্তাঘাট সবকিছুই ঢাকা পড়ে যায়। রাস্তা থেকে বরফ না সরালে চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়ে। অনেক সময় বরফে পা পিছলে অঙ্গহানি বা প্রাণহানি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এজন্য সরকারী উদ্যোগে রাস্তা থেকে বরফ সরানোর ব্যবস্থা করা হয়। তবে বাড়ির আঙ্গিনায় যে বরফ থাকে পতিত থাকে তা প্রত্যেক বাড়ির মালিককে ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিষ্কার করতে হয়। যদি কোন ব্যক্তি তার বাড়ির আঙ্গিনা বরফমুক্ত না করে আর তাতে পা পিছলে কারো ক্ষতি হলে বাড়ির মালিক সে ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ আদায় করতে বাধ্য। পশ্চিমা অনেক দেশে এ ব্যাপারে নীতিমালা প্রণয়ন করতঃ আইন পাশ করা হয়েছে। মসজিদ গীর্জাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে একই আইন। অর্থাৎ মসজিদের আঙ্গিনায় বরফ পড়ে থাকলে আর সে বরফে পা পিছলে কেউ ক্ষতিগ্রস্থ হলে মসজিদ তার ক্ষতিপূরণ আদায় করতে বাধ্য থাকবে। এজন্য বাড়ির মালিকেরা বিভিন্ন কোম্পানির সাথে এই শর্তে বিমা করে থাকেন যে, কখনো বরফের কারণে কোন ক্ষতিপূরণের দায় বর্তালে বিমা কোম্পানি সে দায়ভার নিবে। এজন্য প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রিমিয়াম আদায় করবে। আর যদি এরকম কোন দুর্ঘটনার সম্মুখীন না হয় তাহলে মেয়াদ শেষে বিমা কোম্পানি উক্ত অর্থের মালিক বনে যাবে। এটা হল তৃতীয় পক্ষ বিমা। আজকাল সবদেশেই গাড়ীর ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষ বিমা করাটা বাধ্যতামূলক। বিমা করা ছাড়া কোন গাড়ি রোডে নামানোর অনুমতি নেই।
৩. জীবন বীমা (Life Insurance) আরবীতে "تأمين الحياة " বলে অভিহিত করা হয়। এর নিয়ম এমন যে, বিমা কোম্পানি গ্রাহকদের নিকট এই আহবান করে যে, আপনারা আমাদের নিকট কিছু প্রিমিয়াম জমা করবেন। আমরা সে অর্থ আপনারা একাউন্টে সঞ্চয় করে রাখব। বীমা কোম্পানি এই কিস্তির মেয়াদ ধার্য করে গ্রাহকের বেঁচে থাকার বিবেচনায়। অর্থাৎ তারা বিমা গ্রহীতার সুস্থতা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করতঃ অনুমান করে থাকে যে, বিমা গ্রহীতা সাধারণভাবে আর কত বছর পর্যন্ত জীবিত থাকবে? ধরুন আব্দুল খালেক সাহেব জীবন বিমা করতে ইচ্ছুক। তখন বিমা কোম্পানি প্রথমে তার স্বাস্থ্য চেকআপ ইত্যাদি করার পর আন্দাজ করা গেল যে, আব্দুল খালেক সাহেব আর দশ বছর বেঁচে থাকতে পারেন। এখন বিমা কোম্পানি তার সাথে এভাবে চুক্তি করবে যে, আপনি দশ বছর পর্যন্ত প্রতিমাসে একশ টাকা হারে আমাদের কাছে প্রিমিয়াম জমা দিবেন। এভাবে বছরে বারশ আর দশ বছরে বার হাজার টাকা সঞ্চয় হবে। এখন যদি দশ বছর পূর্ণ হবার পূর্বেই আপনি মারা যান তবে বিমা কোম্পানি আপনার স্ত্রী সন্তান বা মনোনীত ব্যক্তিকে এককালীন দশ লাখ টাকা প্রদান করবে। আর মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে যদি গ্রাহক মারা না যান তবে মেয়াদ শেষে আপনার সঞ্চয়কৃত টাকা সুদসহ ফেরত পাবেন। এটাকেই জীবন বিমা বলা হয়। এর আরো অনেক পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে।
আজকাল জীবন বিমা ব্যাপকহারে করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে নাকি মানুষের এই প্রশান্তি অর্জন হয় যে, আমার মৃত্যুর পর সন্তান সন্ততি না খেয়ে মারা যাবে না। কিছুদিন হলেও আমার বিমাকৃত অর্থে তাদের দিনাতিপাত হয়ে যাবে ইত্যাদি। আর জীবন বিমার ক্ষেত্রে যেহেতু গ্রাহকের জমাকৃত অর্থ সংরক্ষিত থাকে এবং মেয়াদ শেষে যেহেতু গ্রাহক তার অর্থ অবশ্যই ফেরত পায় তাই এখানে অর্থ হারানো বা লসের কোন আশংকা নেই। এজন্য মানুষ এর প্রতি বেশী আগ্রহ দেখাচ্ছে।
বিমা কোম্পানির পরিচয়ঃ- উপরিউক্ত আলোচনার পর বিমা কোম্পানির পরিচয় বা ধরণ জেনে নেওয়াটাও জরুরী বলে মনে হয়। কেননা ইতিপূর্বে আমরা জেনেছি বিমার সূচনা হয়েছিল পারস্পরিক সহায়তার উপর। সে সূত্রে বুঝা যায় বিমা কোম্পানি উদ্দেশ্য কেবল মুনাফা অর্জনই ছিল না বা নয়। সকল বিমা কোম্পানির উদ্দেশ্য এক নয়। এজন্য বিমা কোম্পানির পরিচয় জানার পর তাদের প্রকারভেদ জানাও জরুরী। বিমা কোম্পানির পরিচয় তো অনেকটা জানা গেছে বিমার সংজ্ঞা আলোচনায়। এক কথায় এভাবেও বুঝানো যায় যে, বিমা সুবিধা যে কোম্পানি বা সংস্থা প্রদান করে থাকে তাকে বিমা কোম্পানি বলা হয়। বিমা কোম্পানি সাধারণত তিন প্রকারের হয়ে থাকে। ১. সংঘবদ্ধ বিমা (Group Insurance)
২. সহায়তামূলক বিমা (Mutual Insurance)
৩. ব্যবসায়িক বিমা (Commercial Insurance)
১. গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স অর্থাৎ সংঘবদ্ধ বিমা যাকে আরবীতে বলা হয় التأمين الاجتماعي এর পদ্ধতি হলঃ- কোন এক ধরণের পেশায় নিয়জিত বা কোন এক প্রতিষ্ঠানের কর্মরত লোকদের আয়ের একাংশ মাসিক প্রিমিয়াম হিসেবে জমা করা হয়। উদ্দেশ্য থাকে - এ প্রতিষ্ঠানের কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী ঘটনা-দুর্ঘটনার কবলে পড়লে এই ফাণ্ড থেকে তাকে সহায়তা প্রদান করা হবে। কোন কোন সরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিদের জন্য সরকারী উদ্যোগে এরূপ গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স এর ব্যবস্থা রয়েছে। কোন কর্মচারীর আকস্মিক মৃত্যু হলে তার উত্তরাধিকারীদেরকে উক্ত ফাণ্ড থেকে মোটা অংকের অর্থ অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়। অথবা যদি কোন কর্মচারী দুর্ঘটনার শিকার হয় তাকেও গ্রুপ ইন্স্যুরেন্সের ফাণ্ড থেকে মোটা অংকের টাকা অনুদান দেওয়া হয়। তবে কাকে কী পরিমাণ টাকা পরিশোধ করবে তা উক্ত ব্যক্তির চাকরীর র্যাংক, মেয়াদকাল ইত্যাদির বিচারে ফাণ্ড পরিচালনা বোর্ড নির্ধারণ করে থাকে। যার পদবি মেয়াদকাল বেশি তাকে তুলনামূলক কম জনের চেয়ে বেশি অংকের টাকা পরিশোধ করা হয়। আজকাল সাধারণত এ ফাণ্ডের টাকা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদেরকে বিভিন্ন মেয়াদে সুদের উপর ঋণ প্রদান করা হয়ে থাকে।
২. মিউচুয়াল ইন্স্যুরেন্স (Mutual Insurance) অর্থাৎ পারস্পরিক সহযোগিতা বিমা। আরবীতে একে التأمين التعاوني বলা হয়। বিমার এই প্রকারের মধ্যে কোন ব্যবসা উদ্দেশ্য হয় না। বরং একে অপরের বিপদে এগিয়ে আসা ও দুর্ঘটনা কবলিত ব্যক্তিকে সহায়তা করাই মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে থাকে।
এর পদ্ধতি অনেকটা এরকম, কিছু লোক একত্রিত হয়ে একটা ফাণ্ড তৈরি করল। এই ফাণ্ডের উদ্দেশ্য হয় এমন যে, সদস্যদের কেউ কোন দুর্ঘটনায় পড়লে তাকে এ ফাণ্ড থেকে অনুদান প্রদান করা হবে। যেমন একশ জনে মিলে সহযোগিতা বিমা স্বরূপ সবাই ১ হাজার টাকা হারে এক লক্ষ টাকা সঞ্চয় জমা করল। অতঃপর তারা সকলেই মিলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে, আমাদের একশ সদস্যের কেউ কোন দুর্ঘটনার শিকার হলে এই ফাণ্ড থেকে তাকে অনুদান প্রদান করতঃ তার বিপদ দূর করতে সহযোগিতা করা হবে। কখনো এমন হয় যে বিপদের সংখ্যা বেশি হয় বা ধরণ অনেক বড় হয়। ফলে উক্ত ফাণ্ড দিয়ে যাবতীয় দুর্ঘটনায় অনুদান প্রদান করা সম্ভব হয় না। তখন ফান্ডের মেম্বার থেকে পূণরায় নির্দিষ্ট হারে চাঁদা উত্তোলন করা হয় এবং দুর্ঘটনার পূর্ণ সহায়তা প্রদান করতে চেষ্টা করা হয়। আবা কখনো এমন ঘটে যে, যাবতীয় দুর্ঘটনায় সহায়তা প্রদানের পরও ফাণ্ডের টাকা অবশিষ্ট থাকে। তখন বাকী টাকা সদস্যদের মাঝে বন্টন করা হয় বা পরবর্তি মেয়াদে বিমার জন্য চাঁদা স্বরূপ রেখে দেওয়া হয়। এখানে কোন ব্যবসা উদ্দেশ্য হয় না। একমাত্র উদ্দেশ্য হয় একে অপরকে সহায়তা প্রদান।
৩. কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স (Commercial Insurance) অর্থাৎ ব্যবসায়ী বিমা। আরবীতে যাকে التأمين التجاري বলা হয়। এখানে একটা কোম্পানি থাকে যা মূলত বিমার উদ্দেশ্যেই প্রতিষ্ঠিত করা হয়ে থাকে। এ কোম্পানির কর্মপদ্ধতি নিম্নরূপঃ-
বর্তমান বিশ্বে এক ধরণের বিশেষ পন্থার হিসেব পদ্ধতি রয়েছে। যাকে পরিভাষায় একচুয়ারী (Actuary) বলা হয়। এর মাধ্যমে এটা হিসেব করা হয় যে, একটা দেশে যে পরিমাণ প্রাকৃতিক অপ্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ঘটনার অবতারণা হয় মাধ্যমিকভাবে তার বাৎসরিক পরিমাণ কত হতে পারে? যেমন আমাদের বাংলাদেশে যে পরিমাণ প্রাকৃতিক অপ্রাকৃতিক দুর্ঘটনা ঘটে তার বাৎসরিক পরিমাণ কত? অর্থাৎ এক বছরে সাধারণত কত জায়গায় আগুন লাগতে পারে, এক বছরে কী পরিমাণে গাড়ী এক্সিডেন্ট হতে পারে, কত জায়গায় রেলগাড়ি লাইনচ্যুত হয়ে বা অন্যভাবে কী পরিমাণে ক্ষতি হতে পারে? কত জায়গায় জাহাজ ডুবি হতে পারে? কয়টি বিল্ডিংয়ে আগুন লাগতে পারে? কত জায়গায় ভূমিকম্প হয়ে কী পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে ইত্যাদি। এভাবে আগামী একবছরের যাবতীয় সম্ভাব্য দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতির হিসেব করার পর পূণরায় আরেকটি হিসেব কষা হয়। তা হল- আগামী এক বছরের যাবতীয় সম্ভাব্য দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে কী পরিমাণ অর্থ লাগবে? ধরা হোক যে, আগামী এক বছরের যাবতীয় সম্ভাব্য দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ আদায় প্রদান করতে প্রয়োজন ১০০ মিলিলিয়ন ডলার বা এক হাজার কোটি টাকা। এখন বিমা কোম্পানি এরূপ চিন্তা করবে যে, দশ হাজার কোটি টাকা খরচ করতঃ আগামী এক বছরের সম্ভাব্য দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হলে বিমা গ্রাহকদের থেকে কি পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করতে হবে, যার দ্বারা ক্ষতিপূরণ প্রদান করাও সম্ভব হবে এবং কোম্পানির নুন্যতম ৫০ কোটি টাকা লভ্যাংশ অবশিষ্ট থাকবে। এ হিসেব কষার পর বিমা কোম্পানি উক্ত দশ হাজার কোটি টাকা ও অতিরিক্ত ৫০ কোটি উসুলের জন্য মাসিক বা বাৎসরিক কিস্তি (Premium) নির্ধারণ করবে। যে ব্যক্তি উক্ত কোম্পানিতে বিমা করবে সে কোম্পানিকে নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ মাসিক বা বাৎসরিক প্রিমিয়াম পরিশোধ করবে। এভাবে সমস্ত টাকা উসুল হয়ে যাবে অর্থাৎ দশ হাজার কোটি টাকা ও অতিরিক্ত ৫০ কোটি টাকা একসময় কোম্পানির হাতে চলে আসবে। কোম্পানি সেই দশ হাজার কোটি টাকা দিয়ে এক বছরের সম্ভাব্য ক্ষতিপূরণ প্রদান করবে আর পঞ্চাশ কোটি তো লাভস্বরূপ কোম্পানির পকেটে আছেই। ব্যবসায়িক বিমা কোম্পানিগুলোর কর্মপদ্ধতির মোলিক অবকাঠামো এরূপই হয়ে থাকে। এসব বিমা কোম্পানি বিভিন্ন ধরণের স্কীম চালু করে থাকে। বিমার সাথে আরো ভালভাবে পরিচিত হওয়ার জন্যে বাংলাদেশের প্রশিদ্ধ এক বিমা কোম্পানির স্কীমগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলঃ-
০১. মেয়াদী বিমা : এটি জনসাধারণের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চয়তা বিধান করে। এই বিমার মেয়াদ দশ বছর থেকে ত্রিশ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে কোন ক্রমেই বিমা গ্রহীতার মেয়াদপূর্তি কালীন বয়স ৭০ বছরের বেশি হওয়া যাবে না। বিমার অংক সর্বনিম্ন ৩০ হাজার টাকা হতে হবে। ডাক্তারি পরিক্ষায় উন্নতমান শ্রেনীভুক্তদের বেলায় প্রবেশকালীন বয়স সর্বোচ্চ ৫৫ বছর পর্যন্ত শিথিলযোগ্য। অর্থাৎ ৫৫ বছরের ঊর্ধ্বে কোন ব্যক্তি এ বীমার গ্রাহক হতে পারবে না। মেয়াদ শেষে হ্রাসকৃত বীমা অংক বীমা গ্রহীতাকে লাভসহ প্রদান করা হবে। বিমা গ্রহীতার অকাল মৃত্যুতে হ্রাসকৃত বিমা অংক বিমা গ্রহীতার ওয়ারিস বা মনোনীত ব্যক্তি লাভসহ প্রদান করা হবে।
০২. হজ্ব বিমা এটি পবিত্র হজ্ব ও ওমরা পালন সুবিধার্থে করা হয়ে থাকে। এটি ১০, ১৫, ২০ বছর এর যেকোন এক মেয়াদে হতে পারে। এ প্রকল্পের অধীনে সর্বনিম্ন বীমা অংক এক লক্ষ টাকা মাত্র। মেয়াদ শেষে মুনাফাসহ বিরাট অংকের টাকা পাওয়া যায়।
০৩ পেনশন বিমা এটি জনসাধারণের অবসরকালীন জীবন স্বাচ্ছন্দ্য ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চয়তা বিধান করে। এই প্রকল্পে অবসরকালীন বয়স থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নির্দিষ্ট হারে পেনশন দেওয়া হয়। পেনশন শুরুর দশ বছরের মধ্যে যদি বিমা গ্রহীতা মৃত্যু বরণ করেন তবে তার ওয়ারিস বা মনোনীত ব্যক্তিকে দশ বছরের অবশিষ্ট সময়ের পেনশন প্রদান করা হয়।
০৪. দেনমোহর বিমাঃ- এটি সঞ্চয়ী বিমা প্রকল্প। এ প্রকল্পের গ্রাহক অবশ্যই পুরুষ হতে হবে এবং তার স্ত্রীই হবে একমাত্র নমিনী বা সুবিধাভোগী। দেনমোহরের টাকা ১০-২০ বছরের মেয়াদে নির্দিষ্ট হারে প্রিমিয়াম হিসেবে পরিশোধ করা হয়। বিমা অংকের পরিমাণ কমপক্ষে ত্রিশ হাজার টাকা। সম্পাদিত বিমা অংকের উপর প্রতি বছর আকর্ষণীয় হারে মুনাফা যোগ হয়। অন্যান্য সুবিধা তো রয়েছেই।
০৫. শিশু নিরাপত্তা বিমাঃ- এই বিমা পলিসি যৌথভাবে প্রিমিয়ামদাতা ও শিশুর জীবনের উপর গ্রহণ করা হয়। পিতা অথবা শিক্ষিত উপার্জনক্ষম মাতা শিশুর প্রিমিয়াম দাতা হবেন। পলিসি গ্রহণ করার সময় শিশুর বয়স সর্বোচ্চ ১৫ বছর এবং সর্বনিম্ন ৬ মাস হতে হবে। মেয়াদ শেষকালীন বয়স ১৮ বছর ও ২৫ বছরের বেশি হবে না। পলিসির মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর পূর্ব পর্যন্ত প্রতি বছর মূল বিমা অংকের শতকরা দশভাগ মেয়াদের শুরুতে সহায়ক বৃত্তি হিসেব অগ্রিম প্রদান করা হয়ে থাকে। আর মেয়াদ শেষে অর্জিত মুনাফাসহ বিমার পুরো টাকা প্রদান করা হয়ে থাকে। এ ছাড়াও রয়েছে এক কিস্তি বিমা, দুই কিস্তি বিমা, তিন কিস্তি বিমা, ইসলামী মানি ব্যাংক প্রকল্প, ইসলামী মেয়াদী প্রকল্প, শিশু শিক্ষা ও বিবাহ মেয়াদী বিমা, স্বামী স্ত্রী যুগল মেয়াদী বিমা ইত্যাদি।
বাংলাদেশে বিমাঃ- বিমা ক্রমবিকাশ লাভ করে ১৪০০ সাল থেকে। তবে উপমহাদেশে ১৯২৮ সালে (The Indian Insurance Company Act.) নামে সর্বপ্রথম বিমা আইন প্রণীত হয়। পরবর্তিতে ১৯৩৮ সালে তা সংশোধিত ও পরিমার্জিত হয়। এই আইন সর্বদা কার্যকর হত। এরপর ২০০৯ সালে বাংলাদেশে নতুনভাবে বিমা আইন প্রণয়ন করা হয় যা 'বিমা আইন - ২০০৯' নামে পরিচিত। দেশে বর্তমান ৬২ টির বেশি বিমা কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে দুটি সরকারী, বাকী অন্যান্যগুলি বেসরকারি। বাংলাদেশে জীবন বিমা কোম্পানি শুধু জীবন বিমার কাজ করে থাকে। বাকি অন্য সকল বিমা যেমন অগ্নি বিমা, নৌ বিমা ইত্যাদির জন্যে সাধারণ বিমা কোম্পানি কাজ করে থাকে। বেসরকারি খাতে বিমা কোম্পানি প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেওয়া হয় ১৯৮৪ সাল থেকে। বিমা কোম্পানিতে কাউকে মৃত বলে ঘোষণা দেওয়া হয় সাত বছর ধরে নিখোঁজ থাকলে।
বিমার উপকারিকা-অপকারিতাঃ- অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ দৃষ্টিতে বিমার অনেক সুফল পরিলক্ষিত হয়। আর এই দিকগুলোকেই বিমা কোম্পানি বা সাধারণত যারা বিমার পক্ষে কাজ করে তারা রংচং মাখিয়ে অত্যন্ত জোরেশোরে প্রচার করতে থাকে। বাহ্যত দৃষ্টিতে যদিও অর্থনীতিতে বিমার সুফল কিছুটা দেখা যায়, কিন্তু তা কেবল বিশেষ শ্রেণীর লোকদের জন্যে। অন্য দিকের বিরাট জনসাধারণ বিমার দ্বারা কেবলই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সামনে এর আলোচনা তুলে ধরা হবে ইনশাআল্লাহ! প্রথমে বিমার পক্ষে যারা সাফাই গায় তারা যেসব উপকারিতা বর্ণনা করে সেগুলো তুলে ধরা হলঃ-
১. নির্ভরতাঃ- বর্তমান বিশ্বের গরীব রাষ্ট্রসমূহে ১০ শতাংশেরও কম মানুষ স্বাবলম্বী জীবন যাপন করে। যাদেরকে উচ্চবিত্তের মানুষ বলা হয়। বাকী ৯০ শতাংশের বেশি মানুষই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিধির অন্তর্ভুক্ত। নিম্নবিত্তের কথা না হয় বাদই দিলাম দিলাম। যারা মধ্যবিত্তের আওতাভুক্ত রয়েছে তারাও বেশ ভালভাবেই জানে যে, মুদ্রাসংকটের এ সময়ে তাবৎ দুর্দিন আর দুর্যোগ মোকাবেলা করে ছয় সদস্যের একটি পরিবার কত ভাল করেই বা দিন গুজরান করে। এর মধ্য দিয়ে পুঁজি সঞ্চয় করে উন্নত জীবন অবলম্বনের পথে এগিয়ে যাওয়া কয়জনের ভাগ্যে জোটে। আবার পরিবারের উপার্জনক্ষম সদস্য যদি হয় একজন, ঘটনাক্রমে সেও যদি উপার্জন অক্ষম হয়ে পড়ে তাহলে কেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তা সহজেই অনুমেয়। এজন্যই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের কর্ণধারেরা খুঁজে ফেরেন নির্ভরতা। ছোট ছোট সন্তানের অভিভাবক চায় যে, আমার কোন অঘটন ঘটলে বা দুর্ঘটনা হলে আমার অনুপস্থিতিতে ছোট সন্তানেরা অন্যের সহায়তায় মানবেতর জীবন যাপন না করে। এজন্য সকলেই সকলেই তার ভবিষ্যত প্রজন্মের উন্নত জীবন কামনায় খুঁজে ফেরেন নির্ভরতা। বিমা মানুষকে সেই নির্ভরতাটাই প্রদান করে। বিমা পলিসিতে অংশ নেওয়ার পর মানুষ এতটুকু নির্ভরতা পায় যে, তার অবর্তমানে তার সন্তানগুলো একেবারে অন্ধকারে থাকবে না। বিমার টাকায় তাদের কোন না কোন ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বিমার কারণে মানুষ এই নির্ভরতা কেবল সন্তানের ভবিষ্যতের ক্ষেত্রেই পায় না। আরো অন্যান্য ক্ষেত্রেও মানুষ নির্ভরতা খুঁজে পায়। যেমন শিক্ষা বিমায় সন্তানদের লেখাপড়ার খরচের ব্যাপারে নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। যার কিছুটা আলোচনা গত হয়েছে। শিশু নিরাপত্তা বিমায় শিশুর আর্থিক প্রয়োজন পূরণের নিশ্চয়তা ইত্যাদি।
২. পুঁজি গঠনে সহযোগিতাঃ- বিমার সুফলের মধ্যে এটাও বর্ণনা করা হয় যে, বিমার মাধ্যমে জনগণের নিকট বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পুঁজি একত্রিত হয়ে বৃহত্তর উৎপাদনী কাজে ব্যবহৃত হওয়ার জন্যে মূলধন হিসেবে মওজুদ হয়। আর এই মূলধন ব্যবহার করে বৃহতমানের উৎপাদনী উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব। যেমন একটা বিমা কোম্পানির নিকট থেকে উসূলকৃত প্রিমিয়ামের পরিমাণ ধরা হোক ১০ কোটি টাকা। এই দশ কোটি টাকা ক্ষুদ্রাকারে যখন হাজারো গ্রাহকের নিকট ছিল তখন সে বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র পুঁজির দ্বারা বৃহৎ আকারের কোন উৎপাদনী উদ্যোগ করা অসম্ভব ছিল। কিন্তু বিমা কোম্পানির মাধ্যমে হাজারো গ্রাহক থেকে সংগ্রহীত টাকার মাধ্যমে বড় কোন কিছু উৎপাদন করা সম্ভব। এতে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধি লাভ করবে। মানুষ উপকৃত হবে। সামগ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধিত হবে।
৩. উৎপাদনী উপকরণসমূহ সচল থাকেঃ- অর্থাৎ কোন দেশের কারখানা অগ্নিদগ্ধ হয় বা অন্যকোন বিপর্যয়ের শিকার হয়, এমতাবস্থায় যদি কারখানার উদ্যোক্তার নিকট তা পূণঃপ্রতিষ্ঠার ও মেরামত করার পুঁজি না থাকে তখন কারখানাটি অচল হয়ে পড়ে এবং উৎপাদনী উপকরণ নিশ্চল ও স্থবির হয়ে যায়। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হয়। এর প্রভাব পড়ে জনসাধারণের মাঝে। কিন্তু উক্ত কোম্পানির বিমা করা থাকলে বিমা কোম্পানি কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষতিপূরণবাবদ অর্থ দ্বারা কারখানাটি পূণরায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। তার উৎপাদনী কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। ফলে জনগণের মাঝে তেমন কোন বিরূপ প্রভাব পড়ে না।
৪. অধিক বিনিয়োগে আগ্রহী করা ও বিপদাপদে নির্ভরতা দেওয়াঃ- অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর মাঝে এই আশংকা আর উৎকণ্ঠা থাকে যে, কখনো তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন লেগে বা অন্যকোন কারণে তার বিনিয়োগ প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যার পরিণতিতে তাকে সর্বস্ব হারিয়ে অসহায়ের দিন কাটাতে হতে পারে। এজন্য বিনিয়োগকারীরা নিশ্চিন্ত মন নিয়ে সর্বাধিক পুঁজি দিয়ে বিনিয়োগ করতে তেমন আগ্রহী হয় না। এক্ষেত্রে বিনিয়োগ প্রকল্পের বিমা করা থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পথে বসার উৎকণ্ঠা থেকে বিনিয়োগকারী বেঁচে থাকতে পারে। ফলে সে নিশ্চিন্ত মনে যেকোন খাতে সর্বাধিক পুঁজি বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হয়। কেননা ক্ষতিগ্রস্থ হলে বিমা কোম্পানি তো ক্ষতিপূরণ দিতে দায়বদ্ধ আছেই।
৫. মুদ্রামান নিয়ন্ত্রণঃ- কোন দেশে যখন মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় তখন মানুষের হাতে টাকা বেশি থাকে। এ সময় যদি তারা অতিরিক্ত টাকা বিমার উদ্দেশ্যে জমা করে তাহলে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পায়। আবার যখন মুদ্রাসংকট দেখা দেয় তখন মানুষের হাতে টাকা কম থাকে। এসময় বিমা কোম্পানি মানুষকে ঋণ সরবারহ করে। ফলে মুদ্রাসংকট হ্রাস পায়। এভাবে বিমার মাধ্যমে একটি দেশের মুদ্রামান নিয়ন্ত্রিত থাকে। অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা পায়।
৫. পূর্ণ নিশ্চয়তা ও গ্যারান্টিঃ- অনেক সময় এমন হয় যে, কোন প্রতিষ্ঠানকে কেউ ঋণ দিতে চায় না। এমনকি সুদের ভিত্তিতেও সে প্রতিষ্ঠানকে কেউ ঋণ দিতে ততক্ষণ পর্যন্ত রাজি হয় না যতক্ষণ না ঋণ ফিরে পাওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। এই নিশ্চয়তার জন্যে ঋণ গ্রহীতা থেকে অন্যকোন সম্পদ বন্ধক রাখা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটি সমস্যা দেখা দেয়। তা হল - ঋণগ্রহীতা থেকে গ্রহণকৃত বন্ধকী বস্তু ঋণদাতার নিকট রক্ষিত অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা ধ্বংস হলে ঋণদাতাকেই বহন করতে হবে। ফলে বন্ধকী রাখাও নিরাপদ মনে করা হয় না। কিন্তু যদি যে দ্রব্য বন্ধক রাখা হবে যদি তার বিমা করা থাকে তাহলে তা বন্ধক হিসেবে গ্রহণ করতে ঋণদাতার কোন দ্বিধান্বিত ভাব থাকে না। নিশ্চিন্ত মনে বন্ধকী রেখে ঋণ প্রদান করা যায়। এভাবে বিমার মাধ্যমে সকল ক্ষেত্রে অধিক নিশ্চয়তা লাভ করা যায়।
৭. সার্বজনীন নিরাপত্তাঃ- বিমা সব শ্রেণীর মানুষের জন্যেই নিরাপত্তার প্রতীক হয়ে থাকে। কেননা শিল্পপতি তার শিল্পের বিমা করে নিশ্চিন্ত মনে উৎপাদন করতে পারে। পুঁজি বিনিয়োগকারীও তার বিনিয়োগকৃত পুঁজি আকস্মিক ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ভাবনা থেকে নিরাপত্তা লাভ করে। পণ্যের বিমা করা থাকলে ক্রেতা-বিক্রেতারা নিরাপদে ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে। শ্রমিক ও কর্মচারীদের বিমা করা থাকলে ভাবনাহীন মনে শ্রম দিয়ে যেতে পারে। এভাবে বিমার মাধ্যমে সকল শ্রেণীর মানুষ ভাবনাহীন নিরাপত্তার জীবন লাভ করতে পারে।
বিমার অপকারীতাঃ- বিমার এমন উপকারিতা জানার পর মনে হয় যে বিমা শুধু কল্যাণ আর উপকারিতাই বয়ে আনে। বিমায় হয়তো কোন কুফল নেই। কিন্তু না! বিষয়টা মোটেও তেমন না। বাহ্যত নজরে বিমার অর্থনৈতিক কিছু সুফল আছে বলে মনে হলেও বিমার কুফল অনেক বেশি মারাত্মক। বিমার বাস্তবতা সম্পর্কে যারা জ্ঞান রাখে তারা ভালভাবেই জানেন এর কারণে কী পরিমাণে ক্ষতি হতে পারে বা হচ্ছে। অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদরা বিমার যেসব অপকারীতা বর্ণনা করেন তার কিছু নিম্নে বর্ণিত হলঃ-
১. দ্বীনি ক্ষতিঃ- সর্বপ্রথম আলোচনায় আসে ধর্মীয় বিষয়। যেমনঃ-
(ক) সুদী কারবারে লিপ্ত হওয়া। সাধারণত ব্যবসায়ী বিমাসমূহে সুদী প্রক্রিয়া অবলম্বন হতে থাকে। ব্যবসায়ী বিমাতে সঞ্চিত অর্থ থেকে গ্রাহককে ঋণ প্রদান করা হয় আর গ্রাহক সেই ঋণ পরিশোধ করে সুদসহ। তথ্যানুসন্ধান করে দেখা যায় বর্তমানে সব বিমা কোম্পানি যাদের উদ্দেশ্য থাকে মুনাফা অর্জন, তারা কোন না কোন ভাবে সুদী কারবারের সাথে সংযুক্ত। এভাবে সুদী লেনদেনের সাথে জড়িত থাকা বিমা কোম্পানির পলিসি গ্রহণ করা প্রকারান্তরে সুদী লেনদেনে জড়িয়ে পড়ার মতই। আর সুদী লেনদেনে জড়িত থাকা বাহ্যিকভাবে যত লাভজনকঈ হোক না কেন, এর অর্থ হল হারামে লিপ্ত হওয়া। আর আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হওয়ার ক্ষতি বহুমুখী। দুনিয়ার বরকত থেকে বঞ্চিত হওয়া, বিপদাপদে জড়িয়ে পড়া, লাঞ্ছনা ও বিড়ম্বনার শিকার হওয়া ও পরকালে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হওয়া। উপরোল্লিখিত নিশ্চিত ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে থেকে "ক্ষতি হতে পারে" এই আশংকা নিয়ে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে জীবন পথ পাড়ি দেওয়া একজন মুমিনের নিকট অধিক শ্রেয়।
(খ) জুয়ায় লিপ্ত হওয়া। জুয়া বলা হয় এমন লেনদেনেকে যাতে এক পক্ষের ক্ষতির উপর অপর পক্ষের লাভ বা লোকসান হওয়া নির্ভর করে। বিমা মূলত সে ধরণেরই একটি চুক্তি। কেননা এ দ্বারা কোন সময় বিমা গ্রহীতা জিতে যায় আবার কোন সময় বিমা কোম্পানি জিতে যায়। সুতরাং এটি নিষিদ্ধ জুয়ার অন্তর্ভুক্ত। আর জুয়ার দ্বারা অর্থনৈতিক ও সামাজিক কী কী ক্ষতি হয় তার সামান্য কিছু উল্লেখ করা হলঃ-
১. জুয়ার দ্বারা একদল সম্পদ খোয়াতে খোয়াতে পথের ফকির হয়ে যায় আর অন্যদল আঙ্গুল ফুলে কলা হয়ে যায়। এতে করে সম্পদ কিছু লোকের হাতে বাজেয়াপ্ত ও কুক্ষিগত হতে থাকে। যা অর্থনৈতিক ভারসাম্যকে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করে।
২. জুয়ারি সর্বস্ব হারানোর পর কুল কিনারা না পেয়ে চুরি ডাকাতির ন্যায় জঘন্য কাজ করে সামাজিক নিরাপত্তা ও শৃংখলাকে বিঘ্নিত করে। আর এ পথে না বাড়লেও একজন জুয়ারি পরনির্ভর হয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে।
৩. জুয়ার মাধ্যমে পরস্পরে ঝগড়া বিবাদ আত্মকলহ মারামারি ও হত্যাকাণ্ডের ন্যায় জঘন্য অপরাধ সংঘটিত হয়।
৪. জুয়ারির অন্তরে অন্যের ক্ষতি করে নিজে লাভবান হওয়ার লালসা সর্বদা জাগরূক থাকে। এই লালসা তাকে অন্যায় পন্থা অবলম্বন করতে উৎসাহিত করে।
৫. জুয়ার মাধ্যমে পারস্পরিক সংবেদনশীলতা, ভদ্রতা ও ন্যায় নিষ্ঠা ধ্বংস হয়ে যায়। অপরের কল্যাণকামিতার মনোবৃত্তি নিঃশেষ হয়ে যায়।
৬. জুয়ারি ভাগ্যক্রমে সম্পদ পেয়ে গেলে সে সম্পদ দ্বারা ভাল কোন কার্য সম্পাদনে সক্ষম হয় না। সৎ কাজে তার সম্পদ ব্যয়িত হয় না। জুয়া থেকে অর্জিত সম্পদ হয়ত আবার জুয়ায় লাগায় বা সে সম্পদ অপচয় করতঃ যাবতীয় গুনাহের কাজে ব্যয় করা হয়। এক্ষেত্রে সম্পদ অপচয়ের গুনাহের সাথে সাথে অন্যান্য গুনাহের কাজও সংঘটিত হয়।
(জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া ৩/২৭)
উপরোল্লিখিত ক্ষতি ছাড়াও আরো ক্ষতি রয়েছে যা সামাজিক ও অনৈতিকতার জন্য মারাত্মক ধ্বংসাত্মক পরিণাম বয়ে আনে। তাছাড়া জুয়া অবৈধ ও হারাম হওয়ার ব্যাপারে কুরআনুল কারীমে একাধিক আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। মহান রাব্বুল আলামীন সূরায়ে বাক্বারাতে ইরশাদ করেনঃ-
يسئلونك عن الخمر والميسر قل فيهما اثم كبير و منافع للناس واثمهما اكبر من نفعهما
﴿ سورة البقرة - ٢١٨ ﴾
অর্থঃ- তারা আপনার কাছে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। আপনি বলে দিন যে এ দুটোর মাঝে বিরাট পাপ নিহিত আছে। আর যৎসামান্য উপকার রয়েছে। তবে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণই বেশি। (সূরায়ে বাক্বারাহ, আয়াত নং ২১৮)
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছেঃ-
انما يريد الشيطان أن يوقع بينكم العداوة والبغضاء في الخمر و الميسر و يصدكم عن ذكر الله وعن الصلاة فهل انتم منتهون ﴿ سورة المائدة - ٩٠ ﴾
অর্থঃ- নিশ্চয় শয়তান শরাব ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মাঝে শত্রুতা ও ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়াতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ও নামায থেকে বিরত রাখতে চায়। সুতরাং তোমরা কি বিরত থাকবে? (সূরায়ে মায়েদা, আয়াত নং ৯০)
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে,
انما الخمر والميسر والانصاب والازلام رجس من عمل الشيطان فاجتنبوه
অর্থঃ নিশ্চয় শরাব, জুয়া, ভাগ্য নির্ধারক শর অপবিত্র এবং শয়তানের কাজ। অতএব তোমরা তা থেকে বিরত থাক।
(গ) প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া। বিমার প্রচারণা থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে অসংখ্য প্রতারণা বিদ্যমান। বিমার প্রচারকরা সকল ক্ষেত্রের সম্ভাব্য আশংকাগুলো এমনভাবে তুলে ধরে যে সে বিপদ আসবেই। আর তা থেকে আত্মরক্ষার জন্য এখনি প্রস্তুতি গ্রহণ করা অতিব প্রয়োজন। আগে থেকে আত্মরক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ না করা হলে বিপদে ধ্বংস হওয়া সুনিশ্চিত বা সহায় সম্বল হারিয়ে অবশ্যই অবশ্যই পথের ভিখারি হতে হবে। তাদের এই মিথ্যা প্রচারণার ফাঁদে পড়ে মানুষ বিমা কোম্পানিকে টাকা দেয়। অথচ বাস্তব জীবনে সেই আশংকা বা বিপদ কখনোই আসে না।
বিমা কোম্পানির প্রচারকরা এভাবে কথা বলে যেন বিমা গ্রহীতা ক্ষতিগ্রস্থ হলেই ঘরে বসে ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়ে যাবে। অথচ বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিমা কোম্পানি থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে গিয়ে দেখা যায় যে, সেখানে এমন শর্তের মারপ্যাঁচ রয়েছে যে, সেই মারপ্যাঁচ উৎরে খুব কম লোকই ক্ষতিপূরণ পেয়ে থাকে। আবার বর্তমান যুগ তো ঘুষের স্বর্ণালী কাল। বলা হয়ে থাকে ঘুষ বিনে এক টেবিলের ফাইল অন্য টেবিলে যাওয়া তো দূরের কথা, নড়ে না পর্যন্ত। সুতরাং দুর্ঘটনায় যে মারা গেল তার এতিম ছোট বাচ্চারা উৎকোচের বিশাল অংক কোত্থেকে সংগ্রহ করবে। অতঃপর বাবার বিমার টাকা হাতে পাবে। তেমনিভাবে আগুন লেগে যার জীবনের সমস্ত সঞ্চয় নষ্ট হয়ে তার জন্যে উৎকোচ সংগ্রহ করাটা 'মরার উপর খারার ঘা' প্রবাদের বাস্তব প্রতিফলন নয় কি? এতশত ঝামেলার দেওয়াল টপকে তারপর বিমা গ্রহীতার সফলতা হাতে পায়।
তাছাড়া ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণের টাকা যাতে না দিতে হয় সে জন্যে বিমা কোম্পানি বিভিন্ন প্রতারণা ও ছলচাতুরী ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে থাকে। অপরদিকে যারা বিমা করে, বিমা কোম্পানি থেকে টাকা আদায়ের জন্যে তারাও বিভিন্ন ধরণের ধোঁকা ও প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। এজন্য বিমার উভয় দিকের কোনটাই প্রতারণা থেকে মুক্ত নয়।
২. অর্থনৈতিক ক্ষতিঃ- বিমার দ্বীনি ক্ষতি যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে অর্থনৈতিক ক্ষতিও। নিম্নে তার কয়েকটা আলোচনা করা হলঃ-
(ক) সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে পড়াঃ- বিমার দ্বারা সম্পদ গুটিকতক ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। আর সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে পড়লে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে ব্যাপক বিপর্যয় দেখা দেয়। অন্য সকলকে এর জের বহন করতে হয়। একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টা আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। ধরা যাক একটি দেশের মোট জনসংখ্যা ১০০ জন। সে দেশের মোট সম্পদের পরিমাণ ১০০০০ (দশ হাজার) টাকা। অতএব সাধারণ অবস্থায় মাথাপিছু সম্পদের পরিমাণ দাঁড়াবে ১০০ টাকা। কিন্তু যদি সে দেশের দশ জন লোকের প্রত্যেকেই ৫০০ টাকা করে নিজ নিজ তহবিলে সঞ্চিত করে ফেলে তাহলে এই দশ জনের হাতে কুক্ষিগত সম্পদের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০০০ টাকা। ফলে তাদের মাথাপিছু সম্পদের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০০ টাকা আর বাকী নব্বই জন লোকের হাতে থাকবে অবশিষ্ট ৫০০০ টাকা। ফলে এদের মাথাপিছু সম্পদের পরিমাণ হবে ৫৫.৫৫ টাকা। মাথাপিছু সম্পদের পরিমাণ নেমে আসবে অর্ধেকের কাছাকাছি। এখন উক্ত দশজন যদি সম্পদ কুক্ষিগত করেই রাখে তাহলে দেশের অন্যান্য জনগণ যথাপ্রাপ্যের অর্ধেক সম্পদ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে বাধ্য হবে। এতে করে একটি দেশের নব্বই শতাংশ লোক তাদের নূন্যতম চাহিদা পূরণ করতে হিমশিম খাবে। সুতরাং সম্পদ পুঞ্জিভূত হওয়ার দ্বারা বিমার কুফল একদম সুস্পষ্ট। এভাবে সম্পদ কুক্ষিগত করার দ্বারা মানুষ ধনী ও গরীব দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়বে আর ধনীদের যাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে অভাবীরা তাদের গোলামে পরিণত হতে বাধ্য হবে।
(খ) বিমা বিনিময়হীন শোষণঃ- যারা বিমা করে তারা অর্থনৈতিক দিক থেকে মারাত্মকভাবে শোষিত হয়। বিমা করে লাভবান হয়েছে এমন লোকের সংখ্যা খুবই নগণ্য। যে সম্ভাব্য ক্ষতির আশংকায় বিমা কোম্পানিতে মানুষ টাকা জমায় সে ক্ষতির দশ ভাগও সংঘটিত হয় না। আর যদিও মানা হয় যে দশভাগ ক্ষতি অবশ্যই হয় তাহলে বলা হবে যে, শুধু এই দশ ভাগ লোকই ক্ষতিপূরণ হিসেবে অর্থ পাচ্ছে। বাকি নব্বই শতাংশ লোকের টাকা বিমা কোম্পানি কোনরূপ বিনিময় ছাড়াই শুধু বিপদের আশংকা দেখিয়েই হাতিয়ে নিচ্ছে। এটাও এক এধরণের ডাকাতি। ডাকাতরা অস্ত্রের ভয় দেখি মানুষের পকেটের টাকা হাতিয়ে নেয় আর বিমা কোম্পানি বিপদের আশংকা আছে এই ভয় দেখিয়ে মানুষের পকেট খালি করে। যদি সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষার জন্যে কথাই চিন্তা হয় তাহলে টাকা বিমা কোম্পানিকে না দিয়ে নিজের কাছে রেখেও সম্ভাব্য ক্ষতির মোকাবেলা করতে পারে। উপরোন্তু এই টাকা ব্যবসায় লাগিয়ে নিজে অধিকহারে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
(গ) বিমা সর্বগ্রাসী শোষণঃ- বিমা কোম্পানিগুলো জমাকৃত টাকা উচ্চসূদে উদ্যোক্তাদেরকে ঋণ দেয়। সুদের ভিত্তিতে ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীরা পণ্য উৎপানের পর তারা উৎপাদন ব্যায়ের সাথে সুদ ও লাভ দুটোই যোগ করে পণ্য বাজারজাত করে আর এই পণ্য ক্রয় করে সুদের ভর্তুকি দেয় দেশের জনগণ। সহজে বুঝার জন্যে একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরা হোক একটি সাবান কারখানার প্রতি সাবানের উৎপানে খরচ হয় ১৫ টাকা। কোম্পানিটি ব্যাবসা করার জন্যে যে ঋণ গ্রহণ করেছিল তার সুদ পরিশোধ করার জন্যে ১ টাকা মূল্য বৃদ্ধি করা হল। এখন সাবান প্রতি উৎপাদনী খরচ দাঁড়াল ১৬ টাকা। এবার কোম্পানি সাবান প্রতি এক টাকা লাভে বাজারে সাবান সেল করলে। এই সাবান খুচরা বিক্রেতা হাতে যখন পৌঁছল তখন তার মূল্য দাঁড়াল ১৭ টাকা। এখন জনসাধারণ উক্ত সাবান ক্রয় করবে নূন্যতম ১৮ টাকা দিয়ে। এখানে লক্ষণীয় হল এই যে, ১৮ টাকার মধ্যে ১ টাকা হল সুদের মাসুল যা গ্রহণ করেছিল ব্যবসায়ী, কিন্তু তার ভর্তুকি দিচ্ছে দেশের জনসাধারণ। এভাবে বিমার মাধ্যমে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ শোষিত হচ্ছে।
(ঘ) বিমার দ্বারা সম্পদ ধ্বংসের প্রবণতা বাড়েঃ- যারা বিমা করে তাদের অনেকেই বিমা কোম্পানি থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করার উদ্দেশ্যে বিমাকৃত দ্রব্য ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করে থাকে। অর্থাৎ যখন বিমাকৃত দ্রব্যটি বাজারে অচল হয়ে যায়, কিংবা তার স্বাভাবিক মেয়াদ উত্তির্ণ হয়ে যায় অথবা তাতে কোন প্রকারের ত্রুটি দেখা দেয়, তখন অনেকেই সে দ্রব্যটি এই উদ্দেশ্যে ধ্বংস করে দেয় যে, বিমা কোম্পানি থেকে তার ক্ষতিপূরণ আদায় করে নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করা যাবে। এর জন্যে লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। আবার অনেক সময় গুদামে অল্প মালামাল রেখে নিজেই আগুন ধরিয়ে দিয়ে অধিক পরিমাণে পণ্য ছিল বলে দাবি করে। এভাবে বিমা কোম্পানি থেকে অধিক পরিমাণে ক্ষতিপূরণ আদায় করার চেষ্টা করে। এভাবে দেশের অনেক সম্পদ অকারণে ধ্বংস হয়। সম্পদ ধ্বংসের এই প্রবণতা দেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে।
(ঙ) বিমা বাধ্যবাধকতার কারণে উৎপাদনী উদ্যোগ ব্যাহত হয়। পৃথিবীর অনেক দেশেই আজকাল ব্যবসা বা কারিগরি প্রতিষ্ঠানে বিমা করা বাধ্যতামূলক। বিমা না করলে সরকারীভাবে অনুমোদন দেওয়া হয় না। আবার বিমার ঝামেলাও কম নয়। একদিকে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে বিপুল মূলধনের প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে বিমা করতেও প্রায় সমপরিমাণ অর্থ বিমা কোম্পানিকে জমা দিতে হয়। ফলে এটা উদ্যোক্তাদের উপর অনেক সময় বোঝা হয়ে যায়। বিশেষতঃ ক্ষুদ্র পুঁজির মালিকদের বেলায় এই সমস্যা বেশি হয়ে থাকে। ফলে ঐসব ব্যক্তিদের উৎপাদনী উদ্যোগের অর্থনৈতিক সুফল থেকে দেশ বঞ্চিত থাকে। এভাবে বিমার বাধ্যবাধকতার কারণে উৎপাদনী উদ্যোগ ব্যাহত হয়।
(চ) সম্পদ সংরক্ষন ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়। মানুষ স্বভাবজাত তাড়নায় নিজের সম্পদ সংরক্ষণের জন্য চুড়ান্ত ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। কিন্তু যখন দ্রব্যের বিপরীতে বিমা করা থাকে তখন মানুষ নিজের সম্পদ সংরক্ষণের তাগিদ নিজের মাঝে অনুভব করে না। কারণ ধ্বংস হয়ে গেলে তার পরিবর্তে ক্ষতিপূরণ তো পাবেই। এতে করে সম্পদ সংরক্ষণের ব্যবস্থা শিথিল হয়ে পড়ে।
(ছ) আন্তর্জাতিক ক্ষতিঃ- বিমার ফলে আন্তর্জাতিক শোষণ ব্যাপিত হয়। কারণ বিমা না হলে কোন দেশ রপ্তানি প্রক্রিয়া সম্পাদন করে না। ফলে আমদানিকারক দেশগুলো বাধ্য হয়েই বিমা করতঃ আমদানি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। এভাবে বিমার মাধ্যমে রপ্তানিকারক দেশসমূহ আমদানিকারক দেশগুলোকে শোষণ করতে থাকে। যেমনঃ- বাংলাদেশ জাপান থেকে সমুদ্রপথে মোটরসাইকেল আমদানি করতে ইচ্ছুক। কিন্তু জাপানি কোম্পানি বিমা করা ছাড়া বাংলাদেশে মোটরসাইকেল রপ্তানি করবে না। এখন বাধ্য হয়েই বাংলাদেশী কোম্পানিকে প্রথমে বিপুল অর্থ খরচ করে বিমা করতে হবে। তারপর আমদানি করতে হবে। এভাবেই আন্তর্জাতিকভাবে বিমার কারণে আমদানিকারক দেশগুলো ব্যাপক শোষিত হয়।
৩. বিমার নৈতিক ক্ষতিঃ- বিমার ক্ষতি কেবল দ্বীনি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। নৈতিক ক্ষেত্রেও বিমার ভয়াবহতা মারাত্মক। তার দু একটা দিক তুলে ধরা হলঃ-
(ক) খুনখারাবির প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। বিমা মানুষকে খুন ও হত্যার ন্যায় মারাত্মক অপরাধে উৎসাহিত করে। বিমাকারীর ওয়ারিস বা বিমাকারীর যাকে নমিনী নিযুক্ত করে, সে নমিনী বা ওয়ারিস ততক্ষণ বিমা টাকার মালিক হয় না যতক্ষণ খোদ বিমাকারী জীবিত থাকে। অনেক সময় টাকার লোভ ও সম্পদের নেশায় মানুষ এতটাই কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে যায় যে, সন্তান বাবাকে হত্যা করে বিমা থেকে বিপুল অর্থ পাওয়ার লোভে। স্বামী স্ত্রীকে হত্যা করে স্ত্রীর বিমাকৃত অর্থ পাওয়ার নেশায়। স্বামীর বিমার টাকা পাওয়ার লালসায় স্ত্রী স্বামীকে বিষ খাইয়ে হত্যা করে। এভাবে মানুষ একজন আরেকজনকে হত্যা করে বা একজন আরেকজনের মৃত্যু কামনায় প্রহর গুণতে থাকে। অনেকে বিমা কোম্পানিকে নিশ্চিত করার জন্যে লোকজন সহকারেই গুদামে আগুন ধরিয়ে দেয়। কাপ্তান ও মাঝিমাল্লাসহ মালবাহী জাহাজ সমুদ্রে ডুবিয়ে দেয়। এভাবে মানুষ হত্যার প্রবণতা বাড়ে। সম্পদের নেশা মানুষের মমত্ববোধকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। মানুষকে হিংস্র দানবে পরিণত করে। এগুলো কেবল এখন আশংকা নয়। উন্নত বিশ্বে যেখানে বিমার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে সেখানে অহরহ ঘটছে এধরণের ঘটনা। বাংলাদেশেও সাম্প্রতিককালে সন্তানের হাতে পিতামাতা হত্যার ঘটনা এবং স্বামীর হাতে স্ত্রীর হত্যা, স্ত্রীর হাতে স্বামী হত্যা হওয়ার ঘটনা সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রকাশ পাচ্ছে।
(খ) অন্যের প্রাপ্য হক নষ্ট করার প্রবণতা বৃদ্ধি হওয়া। বিমা কোম্পানির নিকট যখন কেউ বিমাকৃত দ্রব্যের ক্ষতিপূরণ দাবি করে, তখন বিমা কোম্পানি সম্ভাব্য সকল পন্থায় চেষ্টা করে যেন ক্ষতিপূরণের টাকা না দিতে হয়। এজন্য যারা দুর্ঘটনা তদন্ত করে বা যে ডাক্তার পরিক্ষা নিরিক্ষা করে; কিংবা যে বিচারক এর ফয়সালা করেন, তাদেরকে ঘুষ দিয়ে হলেও ক্ষতিপূরণ চাওয়ার দাবি অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করা হয়। অনুরূপ প্রচেষ্টা বিমাকারীর পক্ষ থেকেও হয়ে থাকে। এভাবে একে অপরের হক বিনষ্ট করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
৪. বিমার সামাজিক ক্ষতিঃ- বিমার কারণে সামাজিক অনেক ক্ষতি সাধিত হয়। নিম্নে তার দুএকটি বর্ণনা করা হলঃ-
(ক) বিমা মানুষকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উৎকণ্ঠায় ফেলে দেয়। ভবিষ্যতের উৎকণ্ঠা মানুষের কর্মোদ্যোগে জটিলতা সৃষ্টি করে। অথচ ভবিষ্যতে কী ঘটবে মানুষ তা আদৌ জানে না। এজন্য আল্লাহর উপর পরম নির্ভরশীলতায় সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে মানুষকে কর্মোদ্যোগী হতে হবে। ইসলামের শিক্ষা এমনি। কখনো কোন দুর্ঘটনা ঘটে গেলে তা তাকদীরের উপর হাওয়ালা করে নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাবে এবং ভবিষ্যৎ গড়ার চেষ্টা করবে। এটাই তো স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু বিমা কোম্পানির প্রচারকরা তাদের প্রচারণার দ্বারা মানুষের খোদা নির্ভর তাওয়াক্কুল ও বিশ্বাসকে ভেঙ্গে দিয়ে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অহেতুক উৎকণ্ঠায় ফেলে দেয়। এই উৎকণ্ঠা সামগ্রিক জীবনে মারাত্মক অশুভ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। মানুষ জীবন যাপন করে সম্ভাব্য বিপদের শংকা নিয়ে। এভাবে মানুষ আর নির্ভরতা খুঁজে পায় না। সদা সর্বদা উদ্বেগ আর টেনশনের মাঝে সময় কাটাতে হয়। এতে জীবনের প্রশান্তি মারাত্মকভাবে বিপন্ন হয়।
(খ) জীবন সংগ্রামের মুখোমুখি হওয়ার শক্তি বিলুপ্ত হয়। জীবন সংগ্রামের মুখোমুখি হয়ে ঝুঁকি গ্রহণ করে অগ্রসর হওয়ার যে আত্মশক্তি মানুষকে সংকট কেটে অগ্রসর হতে সাহায্য করে বিমার কারণে সে শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। ফলে ঝুঁকি নিয়ে মানবতার কল্যাণে মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করার শক্তি ও সাহস মানুষের মন থেকে হারিয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে বিমাকারী পরনির্ভরশীল অলস জীবন যাপন করতে চায়। আত্মনির্ভরশীল হতে সাহস পায় না।
(গ) সামাজিক প্রীতি বন্ধন বিনষ্ট হয়। সমাজের মানুষ পরস্পরে সহযোগিতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়। জীবন চলার ক্ষেত্রে একজন অপরজনের উপর নির্ভর হয়ে থাকে। এভাবে পরস্পরের মাঝে গভীর প্রীতি বন্ধন গড়ে ওঠে। কিন্তু বিমাকারীরা চরম পরনির্ভরশীল হয়েও নিজেকে স্বাবলম্বী মনে করে। ফলে তারা অন্যের সহযোগিতার প্রয়োজন অনুভব করে না। আর অন্যকে সহযোগিতা করা আগ্রহও নিজেদের মাঝে খুঁজে পায় না। ফলে স্বাভাবিকভাবে সমাজের মানুষের মাঝে প্রীতি বন্ধনের সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়।
বিমার শরয়ী বিধান
ইসলাম মানুষের জন্যে পূর্ণাঙ্গ হেদায়াত এবং সার্বজনীন জীবন ব্যবস্থা। পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সর্বকালের মানুষই ইসলামের মাঝে খুঁজে পাবে তাদের জীবনের নানাবিধ সমস্যার উপযুক্ত সমাধান। মহান আল্লাহ তায়ালার বাণী পবিত্র কুরআন ও তার ব্যাখ্যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস গবেষণায় সর্বযুগের সমকালীন দ্বীনি সমস্যার সমাধান প্রদান করা সম্ভব। মহান আল্লাহ তায়ালা এভাবেই ইসলামের নীতিমালাকে প্রণীত করেছেন ও সাজিয়েছেন। ইসলামী শরীয়তের প্রত্যেক যুগে এমন কিছু আলেম এবং ইমাম মুজতাহিদকে আল্লাহ তায়ালা তৈরি করেছেন যারা কুরআন হাদীসের আলোকে তৎকালীন যুগের ধর্মীয় সমস্যার সমাধানে সচেষ্ট থাকেন। ইমামদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ যুগের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন। যুগের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন মাসয়ালার সমাধানের জন্যে তিনি একটি ফিকহী বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেখানে বিভিন্ন জ্ঞানে অভিজ্ঞ আলেমদেরকে সমন্বিত করা হয়েছিল। তাদের প্রত্যেকেই বিশেষ জ্ঞানের পণ্ডিত ছিলেন। যেমন ইলমে হাদীসে পণ্ডিত ছিলেন ইয়াহইয়া বিন আবু যায়েদা, হাফস বিন গিয়াস, কাজী আবু ইউসুফ, দাঊদ তায়ী ও প্রমুখরা। মাসয়ালা উদ্ভূত করার ইলমে পারদর্শী ছিলেন ইমাম যুফার রাহিমাহুমুল্লাহ। আরবী সাহিত্যে পাণ্ডিত্য অর্জিত ছিল কাসেম বিন মাআন ও মুহাম্মাদ রাহিমাহুমাল্লাহ এর। এভাবে ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ এর ফিকহী বোর্ডের চল্লিশ সদস্যের প্রত্যেকেই কোন না কোন জ্ঞানে সমৃদ্ধ ছিলেন। ইমাম আযম রাহিমাহুল্লাহ উক্ত ফিকহী বোর্ডের মাধ্যমে তৎকালীন যুগের নানা সমস্যার শরয়ী সমাধান পেশ করতেন। এভাবে প্রত্যেক যুগেই নব উদ্ভাবিত মাসয়ালার সমাধানে ইসলামী বিশেষজ্ঞরা এগিয়ে আসতেন। তবে যুগের আবর্তনে যেহেতু মাসয়ালাগুলো পদ্ধতিগতভাবে ভিন্ন ও নতুন হত। এজন্য উলামাদের মাঝে সমাধানের ক্ষেত্রে সামান্য মতবিরোধ প্রাথমিকভাবে দেখা দিত। কিন্তু পরবর্তি সময়ে উলামায়ে উম্মতের ঐক্যমতে তার স্থায়ী সমাধান বের হয়ে আসত।
সেই ধারাবাহিকতায় বিমার মাসয়ালাও একটি আধুনিক গুরুত্বপূর্ণ মাসয়ালা। উলামায়ে কেরাম উক্ত মাসয়ালার শরয়ী সমাধানের জন্য মাশাআল্লাহ! অনেক মেহনত করেছেন। এ ব্যাপারে আরবীয় শায়েখদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। মিসর, সিরিয়া ও সৌদী আরবসহ অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলোয় বিমার মাসয়ালা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা পর্যালোচনার সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। নানাভাবে গবেষণার পর বিমার মাসয়ালায় উলামায়ে কেরামের সর্বসম্মত ফয়সালা বের হয়ে আসে। উপমহাদেশে আধুনিক মাসয়ালার প্রধান গবেষক আল্লামা মুফতি তাকী উসমানী মুদ্দা জিল্লুহু এব্যাপারে যথেষ্ট সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের আলেম সম্প্রদায়ের উপর যারপরনাই অনুগ্রহ করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল ইযযাত সবাইকে উত্তম বিনিময় দান করুন।
বিমার মৌলিক হুকুম ও উলামাদের মতামতঃ- ইংরেজি ১৯৬০ সনের পূর্বে ফিলিস্তিনের প্রধান মুফতি সাইয়েদ আমীন আল হুসাইনী এর তত্ত্বাবধানে ফিলিস্তিনে বিমার মাসয়ালা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যালোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সিরিয়ার প্রসিদ্ধ শায়েখ মুস্ততা আয যারক্বা এবং অপর শায়েখ আবু যাহরা এর মাঝে পারস্পরিক দ্বিমুখী নানা পর্যালোচনা অনুষ্ঠান সংঘটিত হয়। উক্ত আলোচনা পর্যালোচনা পর মোটামুটিভাবে তিনটি প্রধান মত বের হয়ে আসে। নিম্নে তা বর্ণনা করা হলঃ-
১ম মতঃ- গুটিকয়েক আলেমের মতে বিমা সর্বসাকুল্যভাবে জায়েয। চাই তা যেকোন প্রকারের বিমা হোক না কেন। তাদের দলীল নিম্নরূপঃ-
(ক) বিমা হল পারস্পরিক সহযোগিতার একটি পদ্ধতি মাত্র আর ইসলাম পারস্পরিক সহযোগিতার জন্যে যথেষ্ট গুরত্বারোপ করেছে। যেমন কুরআন পাকে ইরশাদ হচ্ছেঃ-
تعاونوا علي البر والتقوي
অর্থ : তোমরা সৎকাজ ও তাকওয়া অর্জনে একে অপরকে সহযোগিতা কর।
(খ) بيع بالوفاء যেভাবে বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে অথচ তাতে ফাসেদ শর্ত বিদ্যমান। তেমনি বিমার মধ্যে কিছুটা ধোকা থাকা সত্ত্বেও তা বৈধ হওয়ার দাবী রাখে।
(গ) বিমা কোম্পানিকে ক্ষতিগ্রস্থ ঋণগ্রহীতারা মূল অংকের সাথে যে সুদ প্রদান করে তা শরয়ী সুদ নয়। অতএব বিমা নাজায়েয হওয়ার কোন কারণ নেই। সুতরাং বিমা জায়েয।
২য় মতঃ- এ মতটি শায়েখ মুস্ততা আয যারক্বা ও শায়েখ আলী আল হাফীফ এর। এদের মতটি পূর্বোক্ত মতের মতই। তবে এরা বলেন বিমার মধ্যে সুদ ও জুয়ার কোন স্থানই নেই। আর সুদবিহীন বিমা বৈধ। তাদের যুক্তিগুলো নিম্নরূপঃ-
(ক) বিমা হল নির্ধারিত লেনদেনের চুক্তি আর জুয়া হল খেলা। সুতরাং দুটোর মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। অতএব জুয়া বৈধ না হলেও বিমা বৈধ হতে পারে।
(খ) বিমায় ক্ষতিপূরণ হিসেবে যে টাকা দেওয়া হয় তা গ্রাহকের প্রিমিয়ামের টাকার বিনিময়ে নয়। বরং এখানে প্রিমিয়াম হিসেবে যে টাকা গ্রাহক জমা করে তা মূলত বিমা কোম্পানির নিরাপত্তা প্রদানের বিনিময়। আর কেউ নিরাপত্তা দান করলে তাকে বিনিময় দেওয়া জায়েয। যেমন পাহারাদার বাড়িওয়ালাকে নিরাপত্তা দেয়, বিনিময়ে সে মাসিক বেতন গ্রহণ করে। তার এই টাকা নেওয়াটা সম্পূর্ণ বৈধ। তদ্রূপ কোম্পানি গ্রাহকের মালের নিরাপত্তা দেয় বিনিময়ে গ্রাহক থেকে যে অর্থ গ্রহণ করে তা মজুরীস্বরূপ। তাই পরবর্তীতে গ্রাহককে যে ক্ষতিপূরণ প্রদান করে থাকে তা অনুদান বলে গণ্য হবে। এজন্য কমবেশি করা সুদ হিসেবে গণ্য হবে না। সুতরাং বিমায় কোন সুদ নেই বলে বিমা সম্পূর্ণ জায়েয।
(গ) বিমার মাসয়ালা 'আকদে মুওয়ালাত' এর সাথে সম্পৃক্ত করা যায়। আকদে মুওয়ালাতের মধ্যে একজন অপরজনের দিয়ত জরিমানা ইত্যাদির যামিন হয়। এর বিনিময়ে একজন অপরজনের মিরাসের সম্পত্তি ভোগ দখলের অধিকারী হয়। যেমন তুহফাতুল ফুক্বাহায়ে বলা হয়েছেঃ-
وتفسير عقد الموالاة أن من أسلم على يدي رجل وقال له أنت مولاي ترثني إذا مت وتعقل عني إذا جنيت وقال الآخر قبلت فينعقد بينهما عقد الموالاة وكذا إذا قال واليتك وقال الآخر قبلت وكذلك إذا عقد مع رجل غير الذي أسلم على يديه وكذلك اللقيط إذا عقد مع غيره عقد موالاة وشرط صحة عقد الموالاة أن لا يكون للعاقد وارث مسلم وإذا انعقد عقد الموالاة يصير مولى له حتى لو مات ولم يترك وارثا يكون ميراثه لمولاه ولو جنى يكون عقله عليه ويلي عليه في الجملة (تحفة الفقهاء ٢/٢٨٩)
অর্থঃ- আর আকদে মুয়ালাতের তাফসির হলঃ- কোন ব্যক্তি কারো হাতে ইসলাম গ্রহণ করবে এবং তাকে বলবে যে আপনি আমার মাওলা। যদি আমি মারা যাই তবে আপনি আমার উত্তরাধিকার হবেন আর আপনি আমার পক্ষ থেকে দিয়ত আদায় করবেন যদি আমি অপরাধ করি। এখন যদি অন্যজন গ্রহণ করে নেয় তাহলে তাদের মাঝে আকদে মুওয়ালাত সংঘটিত হয়।......................(আকদে মুওয়ালাতের হুকুম হচ্ছে) যখন আকদে মুওয়ালাত সম্পন্ন হয়ে যায় তাহলে সে তার মাওলা পরিণত হয়। এখন যদি উক্ত ব্যক্তি মারা যায় এবং তার কোন ওয়ারিস না থাকে তাহলে তার মিরাসের মালিক হয়ে যাবে সে। এমনিভাবে যদি কখনো অপরাধ করে তাহলে তার যিমানের দায়িত্বও তার।
(ঘ) তাদের চতুর্থ যুক্তি হলঃ- বিমার কার্যক্রম পরিচালনার জন্যে কোম্পানির কর্মকর্তা ও কর্মচারীর নিয়োগ করতে হয়। তাদের বেতন ভাতা দিতে হয়। বিমা কোম্পানি যা লাভ করে তা কর্মচারীদের শ্রমের পারিশ্রমিক হিসেবে নেওয়া হয়।
(ঙ) তাদের পঞ্চম যুক্তি হলঃ- বিমা একটি নতুন ধরণের চুক্তি আর শরীয়তের দৃষ্টিতে যেকোন চুক্তিই বৈধ যদি তাতে শরীয়ত পরিপন্থী কিছু না থাকে। আর আমরা বিমার যে বব্যাখ্যা দিয়েছি তাতে শরীয়ত পরিপন্থী কিছুই নেই। সুতরাং বিমা চুক্তি বৈধ হওয়ারই দাবি রাখে।
৩য় মতঃ- এমতটি জুমহুর উলামায়ে কেরাম ও শায়েখ আবু যাহরা এর। এদের মত হল বিমা সর্বসাকুল্যভাবে না জায়েয ও অবৈধ। তাদের যুক্তি নিচে বর্ণিত হলঃ-
(ক) বিমার মধ্যে দুইটি দিক রয়েছে। প্রথমতঃ বিমাকারী মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই মারা গেলে সাধারণত বিমাকারী পূর্ণ টাকা পায় ক্ষতিপূরণের সাথে সাথে। এ সুরত স্পষ্টত জুয়ার অন্তর্ভুক্ত। কেননা মেয়াদপূর্তির আগে মৃত্যু হওয়া বা না হওয়া উভয় সম্ভাবনা বিদ্যমান। মৃত্যু হলে বিমাকারীর নমিনীর বাম্পার ফলাফল। কিন্তু মেয়াদপূর্তির আগে মৃত্যু না হলে নয়। কিন্তু মৃত্যু হওয়াটা নিশ্চিত নয়। দেখা গেল জুয়া মূল চিত্র এখানে উপস্থিত। আর জুয়া হারাম হওয়াটা কুরআন এর একাধিক আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং বিমার এ দিকটা হারাম জুয়াকে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ায় নাজায়েয সাব্যস্ত হল।
বিমার দ্বিতীয় দিক হলঃ মেয়াদপূর্তির পূর্বে বিমাকারী মারা না গেলে মেয়াদ শেষে মূল টাকা অতিরিক্ত সুদসহ ফেরত ফেরত পায়। এক্ষেত্রে সুদের উপস্থিতি বিদ্যমান আর ষরয়ী পরিভাষায় সুদ হারাম লেনদেনের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং বিমার এদিকটাও নাজায়েয।
(খ) বিমার মধ্যে صفقتان في صفقة অর্থাৎ এক চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার আগেই অন্য চুক্তি সম্পাদন পাওয়া যায় আর লেনদেনের এ ধারাটি হাদীস দ্বারা নিষিদ্ধ। এর উপর চার ইমামের ঐক্যমত স্থাপিত হয়েছে। বর্ণিত হয়েছেঃ-
عن ابن مسعود عن ابيه قال: نهي رسول الله ﷺ عن صفقتين في صفقة واحدة. ﴿ مسند احمد ٤/٣٠﴾
অর্থঃ- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ আপন পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার আগেই তম্মধ্যে অন্য চুক্তি করতে নিষেধ করেছেন। (মুসনাদে আহমদ খণ্ড নং- ৪, পৃষ্ঠা নং- ৩০)
বিমার মধ্যে গ্রাহকের সাথে কোম্পানি প্রথমতঃ একটি চুক্তি করে থাকে। অতঃপর সেই চুক্তির মেয়াদেই উক্ত গ্রাহকের সাথে বিমা কোম্পানি অন্যান্য চুক্তিও করে থাকে। যেমনঃ- কোন গ্রাহক বিমা কোম্পানিকে প্রিমিয়াম পরিশোধ করবে, বদলে বিমা কোম্পানি তার পণ্যের যামিন হবে। এটি একটি চুক্তি। ধরা হোক এর মেয়াদ দুই বছর। এই দুই বছরের মধ্যে গ্রাহক উক্ত চুক্তির মধ্যে অন্য কোন চুক্তি করতে পারবে না। কিন্তু তা হয় না। এখানে আরো বিভিন্ন প্রকার চুক্তি হয়। যেমনঃ- গ্রাহক যে প্রিমিয়াম জমা দিচ্ছে তা থেকে ঋণ আবেদন করলে কোম্পানি দিতে বাধ্য থাকবে। তেমনিভাবে দুর্ঘটনা এই এই প্রকারের হতে হবে ইত্যাদি। এভাবে বিভিন্ন কায়দায় صفقتان في صفقة উপস্থিতি থাকে। সুতরাং এ কারণে বিমা ওবৈধ হওয়ার দাবী রাখে।
(গ) বিমা এমন এক চুক্তি যে চুক্তির কারণে কখনো কখনো একজনের সম্পদ বিনিময় ছাড়াই শুধুমাত্র শর্তের কারণে অন্যজন লাভ করে থাকে। কেননা নৌ বিমায় অধিকাংশ সময় এমন হয় যে, বিমাকৃত জাহাজের কোন ক্ষতিই হয় না। অথচ বিমা কোম্পানি উক্ত জাহাজের বিপরীতে বিপুল অর্থের মালিক হয়ে যায় শুধুমাত্র শর্তের কারণে। কিন্তু ব্যবসায়ী লেনদেনে বিনা বিনিময়ে অন্যের মাল গ্রহণ করা হারাম। কারণ ব্যবসার মূলই তো مبادلة المال بالمال بالتراضي অর্থাৎ সন্তুষ্টচিত্তে সম্পদের বিনিময়ে সম্পদ গ্রহণ করা।
অপরদিকে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেনঃ-
يا ايها الذين آمنوا لا تأكلوا اموالكم بينكم بالباطل. ﴿ سورة البقرة - ١٨٨ ﴾
অর্থঃ- হে মুমিনগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।
সূরায়ে বাক্বারাহ, আয়াত নং- ১৮৮, সূরায়ে নিসা, আয়াত নং- ২৯
ইমাম আবূ জাফর মুহাম্মাদ বিন জারীর আত তাবারী রাহিমাহুল্লাহ উক্ত আয়াতের তাফসির করতে গিয়ে বলেনঃ-
واكله بالباطل اكله من غير الوجه الذي أباحه الله لأكليه
অর্থঃ- অন্যায়ভাবে গ্রাস করার দ্বারা উদ্দেশ্য হল- আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক অনুমোদিত পন্থা ও পদ্ধতি ব্যতিরেকে ভিন্ন পন্থায় সম্পদ ভক্ষণ করা।
সূত্রঃ জামিউল বয়ান ফী তাফসীরিল কুরআন, ১৪ নং খণ্ড, ৩৩১ নং পৃষ্ঠা
সুতরাং এ কারনেও বিমা অবৈধ হওয়ার দাবীদার।
(ঘ) বিমা চুক্তি মূলত সম্পদ বিনিময়ের এমন এক ধরণের চুক্তি যাতে মারাত্মক ধরণের প্রতারণা ও অজ্ঞতা جهل বিদ্যমান। কেননা যে সম্ভাব্য দুর্ঘটনার ভিত্তিতে এ চুক্তি সম্পাদিত হয় তা কখনো ঘটতেও পারে আবার নাও ঘটতে পারে। আবার কত টাকা ক্ষতির বিনিময় হিসেবে কতটাকা ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করা হবে তাও অজানা। সুতরাং এ চুক্তিতে লেনদেনের পরিমাণ সম্পর্কে যথেষ্ট অস্পষ্টতা جهل বিদ্যমান। আর যে লেনদেনে অস্পষ্টতা থাকে তা শরীয়তের দৃষ্টিতে অবৈধ। যেমনঃ- ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়াতে উল্লেখ করা হয়েছেঃ-
ومنها أن يكون المبيع معلوما والثمن معلوما علما يمنع المنازعة فبيع المجهول جهالة تفضي اليها غير صحيح. (الفتاوي الهندية - ٣/٢)
অর্থঃ- ক্রয় বিক্রয় চুক্তি শুদ্ধ হওয়ার জন্যে জরুরী হল মূল্য ও পণ্য এমনভাবে জানা থাকা, যাতে বিবাদের আশংকা না থাকে। অতএব অস্পষ্ট বস্তু যাতে বিতর্কের সম্ভাবনা রয়েছে, তার বিক্রিয় চুক্তি অবৈধ। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া, ৩ নং খণ্ড, ২ নং পৃষ্ঠা)
(ঙ) বিমা চুক্তি মূলত টাকার বিনিময়ে টাকা লেনদেনের চুক্তি। কেননা পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে যে, জীবন বিমায় গ্রাহক যে প্রিমিয়াম পরিশোধ করে, মেয়াদ শেষে বিমা কোম্পানি তা সুদসহ ফেরত দেয়। বুঝা গেল বিমা চুক্তিটি একটি কাঁচা টাকার বিনিময় চুক্তি। পরিভাষায় যাকে "بيع صرف" অর্থাৎ মুদ্রা লেনদেন চুক্তি বলে অভিহিত করা হয়। বাইয়ে সরফ বৈধ হওয়ার জন্যে প্রধান দুটি শর্ত রয়েছে।
(১) লেনদেনের মধ্যে কমবেশি করা যাবে না। কমবেশি হলে সেটা ربوالفضل অধিক প্রদানজনিত সুদ হয়ে যাবে।
(২) লেনদেন হাতে হাতে অর্থাৎ উপস্থিত বৈঠকেই সম্পন্ন হতে হবে। অন্যথা সেটা ربوالنسيئة অর্থাৎ সময়ের ব্যবধানজনিত সুদ সাব্যস্ত হবে। সুদের উভয় প্রকারই হারাম। যেমন ফিকহে হানাফীর প্রসিদ্ধ কিতাব হিদায়ায় উল্লেখ করা হয়েছেঃ-
فإن باع فضة بفضة او ذهبا بذهب لايجوز الا مثلا بمثل... ولابد من قبض العوضين قبل الافتراق. (الهداية - ٣/٨٨)
অর্থঃ- যদি স্বর্ণ বিক্রয় করা হয় (যেটাকে বাইয়ে সরফ বলে) তাহলে সমানে সমান বিক্রি করতে হবে এবং ক্রেতা- বিক্রেতা উভয়ে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পূর্বেই নিজ নিজ পণ্য আয়ত্ব করে নিতে হবে। (হিদায়া ৪খণ্ড ৮৮ পৃষ্ঠা)
সুতরাং বিমা কোম্পানি মেয়াদ শেষে যদি জমাকৃত প্রিমিয়ামের চেয়ে অতিরিক্ত টাকা প্রদান করে তবে সেটা সুদ বলে গণ্য হবে। আবার মেয়াদ শেষে যদি অতিরিক্ত টাকা না দিয়ে কেবল মূল টাকা পরিশোধ করে, তথাপি সেখানে (রিবান নাসিয়া) অর্থাৎ সময়ের ব্যবধানজনিত সুদ বিদ্যমান। অতএব বিমা নাজায়েয হওয়াটাই যুক্তিযত।
(চ) বিমার মধ্যে একজনের দায়ভার অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। কেননা বিমা কোম্পানি নিজে কোন দুর্ঘটনা ঘটায় না বা কোন দুর্ঘটনা হওয়ার কারণও হয় না। সুতরাং বিমা কোম্পানির উপর দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায়ভার চাপানো শরীয়তসম্মত নয়। এমতাবস্থায় তাকে ক্ষতিপূরণ প্রদানে বাধ্য করা জুলম এর অন্তর্ভুক্ত যা সম্পূর্ণ হারাম। হ্যাঁ, কাউকে স্বেচ্ছায় ক্ষতিপূরণ দেওয়া ভিন্ন কথা। সেটাকে অনুদান হিসেবে ধরা হয়। তবে এক্ষেত্রে দাতাকে অনুদান প্রদানে বাধ্য করা বা চুক্তি দ্বারা দাতাকে চাপের মুখে ফেলে অনুদানের নামে ক্ষতিপূরণ আদায় করার অনুমতি নেই। মামলা মোকদ্দমা তো রইল অনেক দূরের কথা।
(ছ) বিমা কোম্পানির ক্লাইন্ট সংগ্রহের পদ্ধতিতে মারাত্মক ধরণের আত্মসাৎ রয়েছে। তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে- যেসব প্রচারকারী ক্লাইন্ট সংগ্রহ করে তাদেরকে বিমাকারীদের জমাকৃত টাকার সর্বোচ্চ ৭৫% কমিশন হিসেবে দেওয়া হয়। অবশিষ্ট ২৫% টাকা মোটে ব্যবসায় খাটান হয়।
(জ) বিমা পলিসির কারণে মিরাস সম্পত্তিতে অনেকটা ধোঁকাবাজি ও প্রতারণা হয়ে থাকে। কেননা বিমা কোম্পানি বিমাকারীর মৃত্যুতে ঐ ব্যক্তির কাছে টাকা হস্তান্তর করে যাকে হিসেবে নিযুক্ত করে যায় বিমাকারী। মৃত্যুর পর সে নমিনীই বিমার টাকার মালিক হয়। এক্ষেত্রে কখনো কখনো নমিনী বিমাকারীর ওয়ারিস বাদ দিয়ে অন্য কাউকে বানানো হয়। সে সময় মৃত বিমাকারীর মিরাসের সম্পদ তার ওয়ারিসের মালিকানায় না গিয়ে চলে যায় সেই নমিনীর মালিকানায়। যা একধরণের মারাত্মক প্রতারণা এবং ওয়ারিসকে তার প্রাপ্য হক থেকে বঞ্চিত করার কৌশল বটে। অথচ কুরআন ও হাদীসের আলোকে অন্যের হক নষ্ট করা বা প্রাপ্য ব্যক্তিকে তার হক থেকে বঞ্চিত করা সম্পূর্ণ হারাম সাব্যস্ত হয়েছে।
(ঝ) ইসলামী আকিদা-বিশ্বাস অনুযায়ী তাকদীরের উপর পূর্ণ আস্থা স্থাপন করা প্রত্যেক মুসলমানের একান্ত কর্তব্য। ভবিষ্যতে যে ঘটনা-দুর্ঘটনার আভির্ভাব হবে তা সম্পূর্ণ আল্লাহর ইখতিয়ারে। বান্দার কী ক্ষতি হবে, আবার তার ক্ষতিপূরণ কোত্থেকে আসবে; এসব ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা উপর এমন বিশ্বাস রাখা কর্তব্য যে, বান্দাকে যে মহাপরাক্রমশালী খোদা বিপদে আপতিত করেছেন তিনি অবশ্যই অবশ্যই পূনরায় বিপদমুক্ত করবেন। প্রত্যেক মুমিনের অন্তরের অবস্থা এমনটা হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বিমাকারীরা আল্লাহর উপর এমন আস্থা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে। কেননা তারা তো বিপদে আস্থার সোপান বানিয়েছে বান্দার উপর। তাই বিমাকারীরা বিপদে সম্পূর্ণ বান্দা নির্ভর হয়ে পড়ে। একজন মুসলমান হিসেবে যা মোটেও কাম্য নয়।
(ঞ) এছাড়াও পূর্বে বিমার যেসব ক্ষতি উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোও বিমা অবৈধ হওয়ার দাবীদার। তাই ধর্মীয়, নৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতির দিক বিবেচনা করতঃ আধুনিককালের ফিকাহবিদগণ বিমাকে অবৈধ ও হারাম বলে ঘোষণা করেছেন।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, এতক্ষণ যাবত বিমা হারাম হওয়ার ব্যাপারে যে আলোচনা করা হল তা শুধু কমার্শিয়াল বিমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অর্থাৎ কমার্শিয়াল বিমা যা মূলত ব্যবসায়ী বিমা বলে অভিহিত ; যার শাখাপ্রশাখা আর প্রকারভেদ হল - লাইফ ইন্স্যুরেন্স বা জীবন বিমা, থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্স, পণ্যের বিমা ইত্যাদি। ফুকাহায়ে কেরাম বিমার এজাতীয় প্রকারের সবগুলোকেই হারাম সাব্যস্ত করেছেন। এই কমার্শিয়াল বিমা হারাম হওয়ার উপর বিগত ৪/৪/১৩৯৮ হিজরীতে সৌদির রিয়াদে অনুষ্ঠিত বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরামের এক অধিবেশনে এবং ১৩৯৮ হিজরীর শাবান মাসে অনুষ্ঠিত 'মাজমাউল ফিকহ আল ইসলামি' এর প্রথম অধিবেশনে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বর্তমানে আরব জাহানের আলেমগণসহ পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের প্রাজ্ঞ উলামায়ে কেরাম কমার্শিয়াল বিমা হারাম হওয়ার ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন। আর বিমার অবশিষ্ট দুই প্রকারঃ- (১) গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স বা দলগত বিমা (২) পারস্পরিক সহযোগিতা বিমাকে মূলগতভাবে বৈধ বলেছেন। তবে এখানেও এই শর্তারোপ করা হয়েছে যে, আনুষঙ্গিক ক্ষেত্রে সুদের কোন প্রক্রিয়ার সাথে সেগুলোকে জড়িয়ে ফেলা যাবে না। কেননা সুদ যে ক্ষেত্রেই যুক্ত হবে তা অবৈধ হয়ে যাবে। আবার গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স ও সহযোগিতা বিমা মূলত দুর্ঘটনা কবলিত ব্যক্তির কল্যাণে স্বতঃস্ফূর্ত অনুদান। এ লক্ষ্যে গ্রুপ ইন্স্যুরেন্সের মাধ্যমে টাকা সঞ্চয় এবং পারস্পরিক সহযোগিতার জন্যে ফাণ্ডে টাকা ওয়াকফ করা, উভয়টিই শরীয়তের দৃষ্টিতে নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আর যেহেতু এখানে কোন ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য থাকে না, কেবল শহযোগিতাই উদ্দেশ্য হয় বিধায় এটি অবৈধ হওয়ার কোন মৌলিক কারণ উপস্থিত নেই। অতএব তা জায়েয। কিন্তু এ ফাণ্ডের টাকাও যদি ওবৈধ খাতে বিনিময় করে মুনাফা অর্জন বা সুদের ভিত্তিতে ঋণ-লোন প্রদান করা হয় তাহলে তা হারাম সাব্যস্ত হবে।
ইসলাম আওর জাদীদ মাআশী মাসায়েল - ৩/৩১২
ইসলামী অর্থনীতির আধুনিক রূপায়ন - ৪২৩
আধুনিক লেনদেনের ইসলামী বিধান - ১/১৭৪
কমার্শিয়াল বিমা জায়েয প্রবক্তাদের দলীল খণ্ডনঃ- বিমার মৌলিক শরয়ী বিধান ও তার দলীলাদি জানার পর এবার বিপক্ষদলের দলীলের উত্তরের প্রতি অগ্রসর হওয়া যাক।
প্রথমতঃ তারা দাবী করেছিল বিমা পারস্পরিক সহযোগিতা। কুরআন শরীফে একে অপরকে সাহায্যের কথা আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং বিমা অবৈধ হওয়ার কোন বিষয় নয়। এর উত্তর কিছুক্ষণ পূর্বেই হয়ে গেছে। বিমা যদি কেবলই সহযোগিতার জন্যে হয় যেমন মিউচুয়াল ইন্স্যুরেন্স (Mutual Insurance) তাহলে তা ওবৈধ হবে না। কিন্তু কমার্শিয়াল বিমায় সহযোগিতা নাম মাত্র। মূল উদ্দেশ্য হয়ে থাকে ব্যবসা আর ব্যবসা তখনি হালাল হবে যখন তা শরীয়তসম্মত কোন মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক না হবে। অন্যথা তা অবৈধ ও হারাম বলে বিবেচিত হবে। হাদীস শরীফে এসেছেঃ-
ثم قام رسول الله ﷺ في الناس فحمد الله وأثني عليه ثم قال أما بعد! مابال رجال يشترطون شروطا ليست في كتاب الله. ماكان من شروط ليس في كتاب الله فهو باطل وان كان مأة شرط. قضاء الله أحق و شرط الله أوفق. ( صحيح البخاري - ٢/٩٨١)
অর্থঃ- ... এর পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জনসম্মুখে দাঁড়িয়ে আল্লাহর হামদ ও ছানা বর্ণনা করলেন। অতঃপর বললেন - লোকদের কী হল যে, তারা এমন শর্তারোপ করে যা আল্লাহর কালামে নেই। আল্লাহর কালামে যে শর্তের উল্লেখ নেই তা বাতিল বলে গণ্য হবে, শত শর্ত হলেও। আল্লাহর ফয়সালাই সঠিক। আল্লাহর শর্তই সুদৃঢ়।
বুখারী শরীফ- ২/৯৮১, মুসলিম শরীফ- ১/৪৯৪, ফাতহুল বারী - ৯/৪১২
আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রাহিমাহুল্লাহ উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেনঃ-
وفيه بطلان الشروط الفاسده في المعاملات (فتح الباري - ٩/٤١٢)
আরবী অর্থঃ- উল্লেখিত হাদীসে লেনদেনের মধ্যে ফাসেদ শর্তের অবৈধতা বর্ণিত হয়েছে।
ফাতহুল বারী - ৯/৪১২
অতএব উপরিউক্ত হাদীস ও তার ব্যাখ্যার দ্বারা একথা সুস্পষ্ট যে ব্যবসা বৈধ হওয়ার জন্যে নাজায়েয কোন কিছু ব্যবসায় থাকা যাবে না।
তারা আরেকটি যুক্তি দিয়েছিল যে, বিমা কোম্পানি বিমা গ্রহীতাকে যে অতিরিক্ত টাকা দেয় তা শরয়ী সুদ নয়। বরং সেটা মুনাফা। আমাদের কথা হল শুধুমাত্র নাম পরিবর্তন করা দ্বারা বস্তুর মূল ও বিধান কোনটাতেই পরিবর্তন আসে না। কোন এলাকায় মদকে যদি ফলের জুস বলে অভিহিত করে তবে সে মদ ফলের জুস হয়ে হালাল হয় না। তদ্রূপ স্পষ্ট সুদকে মুনাফা নামে অভিহিত করলে সুদ বৈধ হয় না। বিমা কোম্পানির দেয়া অতিরিক্ত অর্থ যে সুদ তা আমরা ইতিপূর্বেই আলোচনা করেছি। এ ব্যাপারে মুফতিয়ে আযম পাকিস্তান আল্লামা শফী রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ-
ظاہر ہے کہ محض نام بدل دینے سے کسی معاملہ کی حقیقت نہیں بدلتی. بیمہ کمپنی کے منافع بلاشبہ سود و ربا کی تعریف میں داخل ہیں. )جواہر الفقہ - ۲/۱۸۱ (
অর্থঃ- একথা তো সুস্পষ্ট যে, শুধুমাত্র নাম পরিবর্তন করার দ্বারা কোন লেনদেনের বাস্তবতা পরিবর্তন হয় না। বিমা কোম্পানি থেকে যে লাভ প্রদান করা হয় তা নিঃসন্দেহে সুদের অন্তর্ভুক্ত।
জাওয়াহিরুল ফিকহ - ২/১৮১
তাদের আরেকটি দলীল ছিল - بیع بالوفاء যেমন ফাসেদ শর্ত থাকা সত্ত্বেও বৈধ তেমনি বিমায় কিছুটা ধোঁকা থাকলেও প্রয়োজনবোধে বিমা বৈধ। আমরা বলব, এটি একটি অযৌক্তিক ও অমূলক কিয়াস মাত্র। যার কোন গুরুত্ববহতা নেই। কেননা বিমার মধ্যে কেবল সামান্য ধোঁকা নিহিত আছে বলাটা মোটেও ঠিক না। বিমার অপকারিতা আলোচনার দিকে দৃষ্টিপাত করলে বুঝে আসে। এত বিশাল অপকারিতা সম্বলিত বিমাকে بیع بالوفاء এর সাথে তুলনা করে জায়েয বলা যায় না। আবার بیع بالوفاء এর বিধানে যথেষ্ট মতানৈক্য রয়েছে। যেমন হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ-
رہن قصدا اور بیع ظاہرا کو بیع بالوفاء کہتے ہیں، سو اصل قواعد مذہب کی رو سے یہ بھی رہن ہے اور انتفاع اس سے حرام ہے، اور اگر وہ بیع ہے تو بھی بوجہ مشروط ہونے کے بیع فاسد ہے، تب بھی حرام لیکن بعض متأخرین نے اجازت دی ہے، بس بلا اضطرار شدید تو اسکا ارتکاب نہ کرے اور اضطراب شدید میں بائع کو اختیار ہے کہ فتوی متأخرین پر عمل کرے، اگرچہ مشتری کو اضطرار نہیں ہے،
অর্থঃ- বাইয়ে ওফা হল, যা প্রকাশ্যভাবে ক্রয় বিক্রয় আর উদ্দেশ্যগত হিসেবে বন্ধকী চুক্তি। অতএব শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে মৌলিকভাবে এটা রাহন অর্থাৎ বন্ধকী চুক্তি। আর বন্ধকী চুক্তিতে উপকৃত হওয়া হারাম। আবার যদি তাকে বিক্রয় চুক্তি ধরা হয় তখনো তাতে ফাসেদ শর্ত যুক্ত হওয়ার কারণে তা হারাম। কিন্তু কিছু পরবর্তী আলেমগণ বাইয়ে ওফার অনুমতি প্রদান করেছেন। এজন্য গুরুতর অনোন্যপায় অবস্থা ছাড়া বিক্রেতার জন্যে বাইয়ে ওয়াফা এর অনুমতি নেই। তবে ক্রেতার জন্যে সেরূপ জরুরত প্রমানীত নেই।
ইমদাদুল ফাতাওয়া - ৩/১০৮
এই হল বাইয়ে ওয়াফার অবস্থা। আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রাহিমাহুল্লাহ তার প্রসিদ্ধ কিতাব 'রাদ্দুল মুহতারে' বলেনঃ-
و بيع الوفاء ذكرته هنا تبعا للرد و صورته أن يبيعه العين بألف علي أنه اذا رد عليه العين... قيل هو رهن قدمنا آنفا عن جواهر الفتوي أنه الصحيح و قيل بيع يفيد الانتفاع به، هذا محتمل لأحد القولين الاول أنه بيع صحيح مفيد لبعض احكامه من حل الانتفاع به الا أنه لايملك بيعه وقال الزيلعي في الاكراه وعليه الفتوي، الثاني القول الجامع لبعض المحققين أنه فاسد في حق بعض الاحكام كحل الانزال و منافع المبيع و رهن في حق البعض حتي لم يملك المشتري بيعه من أخر ولا رهنه الخ ﴿رد المحتار ٥/٢٧٧﴾
অর্থঃ- আর বাইয়ে ওয়াফা এখানে উল্লেখ করলাম প্রতিহত করার জন্যে। তার পদ্ধতি হল, কোন বস্তুকে এক হাজার টাকার বিনিময়ে এই শর্তে বিক্রয় করা যে, যখন এর মূল্য ফেরত দেওয়া হবে তখন ক্রেতা সে বস্তুটি বিক্রেতাকে ফেরত দিবে। কেউ বলেন এটি বন্ধকী চুক্তি। এটি জায়েয আছে। যেমন জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার কেউ বলেন, এটি বিক্রয় চুক্তি যা লাভ অর্জনের ফায়দা দেয়।
আল্লামা শামী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এটি দুই সম্ভাবনার যেকোন একটি হতে পারে। অর্থাৎ হয়তো এটি একটা শুদ্ধ ক্রয় বিক্রয় চুক্তি। সুতরাং তা লাভ অর্জনের ফায়দা দেয়। তবে সে তা বিক্রয়ের অধিকার রাখে না। যাইলাঈ রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ- এ মতটির উপরেই ফাতাওয়া। দ্বিতীয়ত মুহাক্কাকদের মত অনুযায়ী এটি কিছু বিধানের বেলায় বাইয়ে ফাসেদ আর কিছু বিধানের ক্ষেত্রে বন্ধকীর হুকুমে। কেননা ক্রেতা এটা অন্যত্র বিক্রয় বা বন্ধক কোনটাই করতে পারে না।
রাদ্দুল মুহতার - ৫/২৭৭
উপরিউক্ত আলোচনায় বুঝা গেল, বাইয়ে ওয়াফা মূলত বৈধ নয়। প্রয়োজনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র বিক্রেতার জন্যে অনুমতি রয়েছে। অতএব এটি জরুরতের মাসয়ালার অন্তর্ভুক্ত একটি মাসয়ালা। এর উপর বিমার মাসয়ালাকে কিয়াস করা মোটেই উচিৎ নয়। বিমার মধ্যে জরুরত তো দূরের কথা হাজতের অস্তিত্বও নেই। সুতরাং বিমা বৈধ হওয়ার এ যুক্তি ভ্রান্ত।
বিমা বৈধ ঘোষণাকারীদের মূল দলীল ছিল - জুয়া হল খেলা আর বিমা হল লেনদেন। সুতরাং বিমা জুয়া নয়। আমাদের কথা হল জুয়া হওয়ার জন্যে খেলা হতে হবে এ কথার কোন ভিত্তি নেই। জুয়ার হাকিকত যার মধ্যে পাওয়া যাবে তাই জুয়ার অন্তর্ভুক্ত। এ ব্যাপারে শায়খুল মুফতি আল্লামা তাকী উসমানী সাহেব দামাত বারাকাতুহু বলেনঃ-
والذي يتبين من النظر في احكام القران و السنة والفقه الاسلام بشأن القمار، أن القمار يتركب من أربعة عناصر:
الاول: أنه عقد معاوضة بين جهتين أو فردين
الثاني: أن كل فريق في هذا العقد يعلق ملكه علي الخطر
الثالث: أن حصول المال الزائد في هذا العقد موقوف علي واقع يحتمل الوقوع وعدمه
الرابع: أن المال المعلق علي الخطر في القمار يضع من صاحبه بدون عوض أو يجلب مالا كثيرا . فيث وجدت هذه العناصر الاربعة تحقق القمار .
(بحوث في قضاي فقهية معاصرة، ٢/٢٣٠)
অর্থঃ- ক্বিমার (জুয়া) নিয়ে কুরআন ও সুন্নাহের বিধিবিধান ও ফিকহে ইসলামী গবেষণা করলে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ক্বিমার চারটি উপাদান দ্বারা গঠিত হয়। যথাঃ-
(১) এটা একাধিক পক্ষ বা ব্যক্তির মাঝে সংগঠিত বিনিময় চুক্তি عقد معاوضه (Commutative Contract)
(২) এ চুক্তিতে প্রত্যেক পক্ষ তার মালিকানাকে ঝুঁকির সাথে ঝুলিয়ে রাখে। (অর্থাৎ এর মধ্যে একটি বিনিময় দেওয়া নিশ্চিত থাকে কিন্তু অপর বিনিময়টা নিশ্চিত থাকে না।
(৩) এ চুক্তিতে অতিরিক্ত অর্থ লাভের বিষয়টা এমন এক অনিশ্চিত বাস্তবতার উপর নির্ভরশীল যা ঘটার সম্ভাব্যতা ও অসম্ভাব্যতা উভয় দিকই রয়েছে। হতেও পারে আবার নাও হতে পারে।
(৪) জুয়ার মধ্যে ঝুঁকির ভিত্তিতে প্রদানকৃত মালটা তার মালিকানা থেকে হয়তো কোন বিনিময় ছাড়াই নষ্ট হয়ে যায় অর্থাৎ অন্যের মালিকানায় চলে যায় বিনিময় ছাড়া অথবা অতিরিক্ত মাল অন্যের মালিকানা থেকে কোন বিনিময় ছাড়াই নিজের মালিকানায় চলে আসে। অতএব চারটি উপাদান যে চুক্তিতে সে চুক্তিই জুয়ার অন্তর্ভুক্ত।
বুহুস ফি কাযায়া ফিকহিয়্যাহ মুয়াসারাহ ২/২৩০-৩১
প্রতিপক্ষরা আরো একটি যুক্তি উত্থাপন করেছিল যে বিমায় ক্ষতিপূরণ হিসেবে যে টাকা প্রদান করা হয় তা গ্রাহকের জমাকৃত টাকার বিনিময় নয়। বরং নিরাপত্তা দানের বিনিময় স্বরূপ প্রিমিয়াম পরিশোধ করে থাকে। সুতরাং তা বৈধ। যেমন চৌকিদারের নিরাপত্তা দানের বিনিময়ে তাকে বেতন দেওয়া বৈধ।
এর জবাবে আমরা বলবঃ- নিরাপত্তা দানের বিনিময়েও কোন অর্থনৈতিক সুবিধা ভোগ করা জায়েয নেই। কেননা নিরাপত্তা অর্থের বিনিময় হওয়ার যোগ্য কোন বস্তু নয়। বিমা কোম্পানির নিরাপত্তার দেওয়াটা প্রিমিয়ামের বিনিময় নয়; যেকথা তারা বলেছে। বরং সে প্রিমিয়ামের বিনিময় হল ক্ষতিপূরণের টাকা আর এই ক্ষতিপূরণের টাকার ফলাফল হল গ্রাহকের নিরাপত্তা পাওয়া। উদাহরণে চৌকিদারের মজুরী হল তার টহলদান ও শ্রমের বিনিময়ে। নিরাপত্তা দানের বিনিময়ে নয়। নিরাপত্তা হল তা সুফল। আর শ্রম যেহেতু বিনিময়যোগ্যতা রাখে সুতরাং সে চুক্তি বৈধ হবে। পক্ষান্তরে বিমায় ক্ষতিপূরণের টাকা মূলতঃ প্রিমিয়ামের বিনিময়ে হয়ে থাকে। এজন্য এটি টাকার বিনিময়ে টাকা এর অন্তর্ভুক্ত, যা বাইয়ে সারফ বলে অভিহিত। আর বাইয়ে সারফে কমবেশী করে বিনিময় করা এবং বাকীতে বিনিময় করা উভয়টি সুদের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এ যুক্তিটিও অমূলক।
তাদের আরেকটি যুক্তি ছিল বিমা আকদে মুওয়ালাতের মতই একটি আকদ। সুতরাং এটিও জায়েয হওয়ার দাবীদার।
আমাদের কথা এ ব্যাপারে এই যে, বিমাকে আকদে মুওয়ালাতের সাথে তুলনা করা ঠিক হবে না। কেননা একটি পূর্বেই আমরা জানতে পারলাম যে, নিরাপত্তা প্রদানের বিনিময় হয় না। বিনিময় হয় শ্রমের। আর বিমায় কোম্পানি যে প্রিমিয়াম গ্রহণ করে থাকে মূলতঃ তার বিনিময়েই ক্ষতিপূরণ দেয়। আবার এটাও হয় যে, বিমা কোম্পানি অনেক সময় কোন বিনিময় ছাড়াই প্রিমিয়ামের মালিক বনে যায় যেমনটি আমরা ইতিপূর্বে জেনেছি। অথচ আকদে মুওয়ালাতের মধ্যে উভয় পক্ষ উভয়ের যামিন হয়। কিন্তু বিমায় তেমনটা হয় না। আর আকদে মুওয়ালাতের মাঝে যে মিরাসের মালিক হওয়ার বিষয়টা রয়েছে সেটা কোন বিনিময় নয়, বরং ফলাফল স্বরূপ। অনেক ক্ষেত্রে সম্পদ সম্পত্তি কিছুই থাকে ফলে সেখানে সম্পত্তির মালিকানার বিষয়টি থাকে না। সুতরাং আকদে মুওয়ালাতের সাথে কিয়াস সহীহ নয়।
তাছাড়া ফুকাহায়ে কেরাম আকদে মুওয়ালাত বৈধ করেছেন অনেকগুলো শর্ত সাপেক্ষে। যেমন আল্লামা কাসানী রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ-
واما شرائط العقد فمنها عقل العاقد ومنها أن لايكون للعاقد وارث ومنها ان لايكون من العرب ومنها ان لايكون من موالي العرب ومنها ان لايكون معتق أحد ومنها ان لايكون قد عقل عنه بيت المال الخ ﴿بدائع الصنائع ٤/١٧٠﴾
অর্থঃ- আকদে মুওয়ালাতের শর্ত সমূহ হলঃ- (ক) জ্ঞানী হওয়া (খ) চুক্তিকারীর কোন সন্তান না থাকা। (গ) আরব না হওয়া বা আরবদের আযাদকৃত গোলাম না হওয়া ইত্যাদি....
বাদায়েউস সানায়ে, ৪/১৭০
উপরিউক্ত ইবারতের মধ্যে একাধিক বিভিন্ন প্রকারের শর্তের উল্লেখ দ্বারা এ কথা বুঝা যায় যে, আকদে মুওয়ালাত বৈধ করা হয়েছে জরুরতের কারণে। কেননা যদি কারো অবস্থা এমন হয় যে, তার পক্ষে দাঁড়ানোর কেউ নেই। সে মারা যাওয়ার পর তার ওয়ারিস হওয়ার জন্যেও কেউ নেই। বিপদে সাহায্য কারীও কেউ নেই, তাহলে এমন একক ব্যক্তির কেউ ব্যবসা ইত্যাদি করতে চাইবে না। ফলে তার জীবন যাপন করা দুষ্কর হয়ে উঠবে। এজন্য আকদে মুওয়ালাতের মাধ্যমে একজন যিম্মাদার নির্ধারণ করা হত। যাতে তার আগে পিছে কেউ একজন থাকে। মদীনায় হিজরতের পর মুহাজির সাহাবাদের অনেকের কোন নিকট আত্মীয় ছিল না। তাদের স্বাভাবিক জীবন-যাপন যেন বিপর্যস্ত না হয়, এজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহাজির ও আনসারদের মাঝে "مواخاة " ভাতৃত্ব বন্ধন স্থাপন করে দিয়েছিলেন। এমন একটা ফরমান লিপিবদ্ধ করেছিলেন। যেখানে এই বিধান ছিল যে - মুহাজির ও আনসারদের কেউ ক্ষতিগ্রস্থ তার ক্ষতিপূরণ সবাই বহন করবে। যেমনঃ- বর্ণিত হয়েছেঃ-
عن ابن عباس رضي الله عنه قال: كتب رسول الله ﷺ كتابا بين المهاجرين والانصار أن يعقلوا معاقلهم وأن يفيدوا عاينهم بالمعروف والاصلاح ، ﴿ نصب الراية- ٤/٦١٢﴾
অর্থঃ- জনাব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসার ও মুহাজিরদের জন্যে একটি ফরমান জারী করেছিলেন। যার মধ্যে এ কথা উল্লেখ ছিল, মুহাজির ও আনসাররা একদল অপর দলের দিয়ত আদায় করবে। কেউ বন্দি হলে তার ফিদিয়া প্রদান করবে। এ ফরমানটি পারস্পরিক সংশোধনের ভিত্তিতে ছিল। নাসবুর রায়াহ - ৪/৬১২
সুতরাং আলোচনার দ্বারা প্রতীয়মান হল যে, আকদে মুওয়ালাত জরুরতের ভিত্তিতে জায়েয ও প্রচলিত হয়েছে। তাই এর উপর কিয়াস করে এমন চুক্তির ব্যাপারে দলীল উত্থাপন করা যাবে না যার মধ্যে কেবল ধোঁকা নিহিত রয়েছে।
তাদের আরেকটি যুক্তি ছিল যে, গ্রাহক থেকে যে লাভ নেওয়া হয় তা বিমা কোম্পানির কর্মচারীদের বেতন ভাতা স্বরূপ গ্রহণ করা হয়। এ যুক্তিটিও একদম অকাজের। যেহেতু সুদি কারবারে জড়িত কোম্পানির মুনাফাও সুদ মিশ্রিত মুনাফা। আর পারিশ্রমিক দিয়ে সুদের কার্যক্রম সম্পাদন করা জায়েয নেই।
তাদের অন্যতম দলীলটি ছিলঃ- বিমা একটি নতুন চুক্তি আর শরীয়তের দৃষ্টিতে নতুন চুক্তির মৌলিকতা হল জায়েয হওয়া, যদি তাতে শরীয়ত পরিপন্থী কিছু না থাকে।
আমরা বলব, বিমার যে স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে তাতে শরীয়ত পরিপন্থী একাধিক কারণ এ শর্তের উপস্থিতি বিদ্যমান। সুতরাং তা নাজায়েয ও অবৈধ। ইতিপূর্বে এ ব্যাপারর হাদীস বর্ণীত হয়েছে।
উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, কমার্শিয়াল বিমা যেখানে বিভিন্ন ফাসিদ শর্তের উপস্থিতি রয়েছে, তা কোনভাবেই জায়েয হতে পারে না। অতএব কমার্শিয়াল বিমার ব্যাপারে এক কথায় হুকুম দেওয়া যায় যে, তা নাজায়েয ও হারাম। এ ব্যাপারে বর্তমান যুগের ফকীহ আলেমগণ একমত পোষণ করেছেন। এখন আমরা বিমার ব্যাপারে বিভিন্ন ফাতাওয়ার কিতাবে উল্লেখিত কিছু ফাতাওয়া উল্লেখ করব ইনশাআল্লাহুল আযীয।
বিমার ব্যাপারে আল্লামা শামীর ফাতাওয়া
والذي يظهر لي: أنه لا يحل للتاجر أخذ بدل الهالك من ماله لأن هذا التزام ما لا يلزم. فإن قلت: إن المودع إذا أخذ أجرة على الوديعة يضمنها إذا هلكت قلت ليست مسألتنا من هذا القبيل لأن المال ليس في يد صاحب السوكرة بل في يد صاحب المركب، وإن كان صاحب السوكرة هو صاحب المركب يكون أجيرا مشتركا قد أخذ أجرة على الحفظ، وعلى الحمل، وكل من المودع والأجير المشترك لا يضمن ما لا يمكن الاحتراز عنه كالموت والغرق ونحو ذلك. فإن قلت: سيأتي قبيل باب كفالة الرجلين قال لآخر اسلك هذا الطريق، فإنه آمن فسلك، وأخذ ماله لم يضمن ولو قال: إن كان مخوفا وأخذ مالك فأنا ضامن ضمن وعلله الشارح هنالك بأنه ضمن الغار صفة السلامة للمغرور نصا اهـ أي بخلاف الأولى، فإنه لم ينص على الضمان بقوله فأنا ضامن، وفي جامع الفصولين الأصل أن المغرور إنما يرجع على الغار لو حصل الغرور في ضمن المعاوضة أو ضمن الغار صفة السلامة للمغرور فيصار كقول الطحان لرب البر: اجعله في الدلو فجعله فيه، فذهب من النقب إلى الماء، وكان الطحان عالما به يضمن؛ إذ غره في ضمن العقد وهو يقتضي السلامة. اهـ. قلت: لا بد في مسألة التغرير من أن يكون الغار عالما بالخطر كما يدل عليه مسألة الطحان المذكورة، وأن يكون المغرور غير عالم إذ لا شك أن رب البر لو كان عالما بنقب الدلو يكون هو المضيع لماله باختياره، ولفظ المغرور ينبئ عن ذلك لغة لما في القاموس غره غرا وغرورا فهو مغرور وغرير خدعه وأطمعه بالباطل فاغتر هو. اهـ. ولا يخفى أن صاحب السوكرة لا يقصد تغرير التجار، ولا يعلم بحصول الغرق هل يكون أم لا، وأما الخطر من اللصوص، والقطاع فهو معلوم له، وللتجار لأنهم لا يعطون مال السوكرة إلا عند شدة الخوف طمعا في أخذ بدل الهالك، فلم تكن مسألتنا من هذا القبيل أيضا،
অর্থঃ- (বিমার ব্যাপারে উত্তর হল) সমুদ্রপথে মাল ধ্বংস হলে ক্ষতিপূরণ নেওয়াটা ব্যবসায়ীদের জন্যে জায়েয হবে না। কেননা এটি 'এমন বস্তুকে আবশ্যক করে নেওয়া যা মূলতঃ আবশ্যক নয়' সেই মাসয়ালার অন্তর্ভুক্ত।..................
বুহুস ফি ক্বাযায়া ফিকহিয়্যাহ মুআছারা
اما بعد! فقد اتفق معظم العلماء المعاصرين والمجامع والندوات الفقهية علي حرمة التأمين التجاري التقليدي لما يشمل عليه من الغرر والقمار والربا
﴿بحوث في قضايا فقهية معاصرة - ٢/١٨٧﴾
অর্থঃ- বর্তমান যুগের আলেমদের বড় অংশ ফিকহী বোর্ড ও সেমিনারে কমার্শিয়াল বিমা হারাম হওয়ার উপর একমত পোষণ করেছেন। যেহেতু এ জাতীয় বিমার মধ্যে ধোঁকাবাজি, জুয়া ও সুদের উপস্থিতি বিদ্যমান থাকে।
(বুহুস ফি ক্বাযায়া ফিকহিয়্যাহ মুআছার, ২/১৮৭)
ফাতাওয়ায়ে ইসলামিয়ার ইবারত
يجوز للانسان أن يساهم في هذه الشركات اذا كانت لا تتعامل بالربا فان كان تعاملها بالربا فلايجوز وذاك لثبوت تحريم التعامل بالربا في الكتاب و السنة و الاجماع وكذالك لايجوز للانسان أن يساهم في شركات التأمين التجاري لأن عقود التأمين مشتملة علي الغرر والجهالة والربا والعقود المشتملة علي الغرر والجهالة والربا محرمة في الشريعة الاسلامية، ﴿الفتاوي الاسلامية - ٢/٣٩٢ ﴾
অর্থঃ- কোন ব্যক্তির জন্যে ব্যাংক ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করা তখনি জায়েয হবে যখন তা সুদ মুক্ত হবে। এটা এজন্যই যেহেতু সুদের হারাম হওয়া কুরআন সুন্নাহ ও ইজমায়ে উম্মত দ্বারা সাব্যস্ত। এমনিভাবে মানুষের জন্যে কমার্শিয়াল বিমায় অংশগ্রহণ করা জায়েয নেই। যেহেতু কমার্শিয়াল বিমার চুক্তি ধোঁকা অস্পষ্টতা ও সুদের অন্তর্ভুক্ত, বিধায় তা হারাম।
(ফাতাওয়া ইসলামিয়া, ২/৩৯২)
ইমদাদুল ফাতাওয়া এর ইবারত
ان اشتہاری و تجارتی بیموں میں کمپنیا جو خاص مالک کو خاص صورتوں میں معاوضہ دیتی ہے صورةً تو وہ عوض ہے ان مال تلف شدہ کا مگر وہ واقع میں عوض ہے اس رقم کا جو ماہانہ یا سالانہ داخل کی جاتی ہے کیونکہ ان کو مقصود وہی ہے ورنہ مال ضائع سے ان کو کیا نفع ہو سکتاہے، پس باعتبار صورت کے تو یہ قمار ہے لأنه تعليق الملك علي الخطر والمال في الجانبن اور باعتبار حقیقت کے سود ہے لعدم اشتراط المساواة في الجانبين فيما يجب فيه المساواة. پس یہ معاملہ قطعاً حرام ہے، اسی طرح جان کا بیمہ وہ صورة رشوت ہے لأن المال فيه عوض من غير متقوم و هو النفس اور حقیقۃً سود ہے
অর্থঃ- এ সকল ব্যবসায়ী বিমা কোম্পানি গ্রাহককে যে বিশেষ সুরতে বিনিময় প্রদান করে থাকে, বাহ্যিকভাবে যদিও সেড়া ধ্বংসপ্রাপ্ত মালের ক্ষতিপূরণ কিন্তু বাস্তবে সেটা ঐ টাকার বিনিময় যা গ্রাহক মাসিক বা বাৎসরিক প্রিমিয়াম আকারে পরিশোধ করে ছিল।.... অতএব বাহ্যিকভাবে এটা জুয়া.... আর বাস্তবে সেটা সুদ.....। অতএব বিমা চুক্তিটি নিঃসন্দেহে হারাম। এমনিভাবে জীবন বিমা (হারাম) কেননা তা বাহ্যিকভাবে ঘুষ....আর বাস্তবে সুদ।
(ইমদাদুল ফাতাওয়া, ৩/১৬১)
কিফায়াতুল মুফতি এর ইবারত
سوال: زندگی کا بیمہ کرانا کیسا ہے؟
جواب: زندگی کا بیمہ کرانا جائز نہیں ہے؟
سوال: جان و مال کا بیمہ کرانا کیسا ہے؟
جواب: بیمہ ایک قسم کا قمار ہے اسلئے ناجائز ہے؟ ﴿کفایۃ المفتی-۸/۸۲.۸۳ ﴾
অর্থঃ- প্রশ্ন, জীবন বিমা করার বিধান কী
উত্তর, জীবন বিমা করানো জায়েয নেই
প্রশ্ন, জান ও অর্থ সম্পদের বিমা করা জায়েয আছে কি?
উত্তর, বিমা এক ধরণের জুয়া। এজন্য জান ও অর্থ সম্পদের বিমা করা জায়েয নেই।
(কিফায়াতুল মুফতি, ৮ / ৮২, ৮৩)
ফাতাওয়ায়ে উসমানী এর ইবারত
انشورنش کے جو طریقے اس وقت تک مروج ہیں وہ سب سود اور قمار پر مشتمل ہیں اور حرام ہیں، مختلف انشورنس کمپنیا جن علماء کے بیانات شائع کرتی رہتی ہے ان میں دو قسم کے بیانات ہوتے ہیں، بعض مرتبہ ان کمپانیوں نے بعض علماء کی طرف سے غلط بیانات منسوب کئے ہیں اور بعض مرتبہ علماء کی طرف بیانات کی نسبت غلط نہیں ہوتی لیکن جن علماء نے موجودہ انشورنس کو جائز کہا ہے ان کی بات بحیثیت مجموعی عالم اسلامی کے علماء نے قبول نہیں کی، لہذا وہ شاذ اقوال کی حیثیت رکھتے ہیں اور ان کے دلائل بھی نہایت کمزور ہیں، مجمع الفقہ الاسلامی جدہ میں ساری دنیا کے علماء نے جمع ہوکر اس مسئلے پر مفصل بحث کی اور بالاخر انشورنس کی مروجہ طریقوں کی حرمت کا فتوی دیا اور بعض علماء کے شاذ اقوال کو باطل قرار دیا، اس اجتماع میں ۱۴۵ اسلامی ملکوں کے تقریبا ۱۵۰ علماء شریک تھے، ﴿ فتاوی عثماني - ۳/۳۲۸ ﴾
অর্থঃ- ইন্স্যুরেন্স (বিমার) বর্তমান প্রচলিত যত প্রকার রয়েছে সবগুলো সুদ ও জুয়ার অন্তর্ভুক্ত, বিধায় তা হারাম। ... কিছু আলেমের বৈধ হওয়ার মত থাকলেও সে মতটি খুবই দুর্বল ও ক্ষীণ। তাদের দলীলাদিও অনেক দুর্বল ও কমজোর। 'মাজমাউল ফিকহ ইসলামি' জেদ্দাতে পুরো দুনিয়ার ইসলামি রাষ্ট্রের আলেমগণ একত্রিত হয়ে এ ব্যাপারে সুদীর্ঘ আলোচনা পর্যালোচনা করেছেন। অবশেষে বর্তমান প্রচলিত ইন্স্যুরেন্স হারাম হওয়ার উপর ফাতাওয়া দেওয়া হয় এবং কতক আলেমের বৈধ হওয়ার মতকে বাতিল সাব্যস্ত করা হয়। সেই সেমিনারে ১৪৫ টি ইসলামি রাষ্ট্র থেকে প্রায় ১৫০ জন আলেম অংশগ্রহণ করেন।
ফাতাওয়ায়ে উসমানী, ৩/৩২৮
আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল এর ইবারত
بیمہ کی جو موجودہ صورتیں رائج ہیں وہ شرعی نقطۂ نظر سے صحیح نہیں، بلکہ قمار اور جوا کی ترقی یافتہ شکلیں ہیں اسلئے اپنے اختیار سے بیمہ کرانا تو جائز نہیں، اور اگر قانونی مجبوری کی وجہ سے بیمہ کرانا پڑے تو اپنی ادا کردہ رقم سے زیادہ سے وصول کرنا درست نہیں، چونکہ بیمہ کا کاروبار درست نہیں، اسلئے بیمہ کمپنی میں ملازمت بھی صحیح نہیں،
﴿آپ کے مسائل اور انکا حل ۶/۱۹۶ ﴾
অর্থঃ- বিমার বর্তমান প্রচলিত সকল সুরতই শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ নয়। বরং বিমা হল জুয়ার উন্নত একটি পদ্ধতি মাত্র। এজন্য নিজ ইচ্ছায় বিমা করা বৈধ নয়। যদি আইনগত বাধ্য হয়ে বিমা করতেই হয় তবে নিজের জমাকৃত টাকার অতিরিক্ত টাকা গ্রহণ করা জায়েয হবে না। যেহেতু বিমার কার্যক্রম বৈধ নয় এজন্য বিমা কোম্পানিতে চাকরি করাও বৈধ নয়।
(আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল, ৬/১৬৯)
কিতাবুল ফাতাওয়া এর ইবারত
جان و مال کا انشورنس أصل میں جائز نہیں کیونکہ اگر پالسی مکمل کی تو وہ پالسی لینے والا جتنی رقم ادا کرتا ہے کمپنی اس سے زیادہ رقم واپس کرتی ہیں اور یہ سود ہے اور اگر پالسی مکمل ہونے سے پہلے حادثہ حادثہ پیش آگیا تو رقم پوری مل جاتی ہے حالانکہ اس نے چاند قسطیں ہی جمع کی ہیں گویا پالسی لینےوالے کو اپنی پالسی کا انجام معلوم نہیں، کسی کو دو تین قسطیں کی آدائیگی پر پوری رقم مل جائگی اور کسی کو تمام قسطیں ادا کرنی ہوگی، ظاہر ہے کہ یہ صورت قمار میں داخل ہے، پس انشورنس سود اور قمار سے مرکب صورت ہے اور شریعت ان دونوں کی ممانعت ہے، اسلئے اصلا یہ صورت جائز نہیں ﴿ کتاب الفتاوی - ۵/۳۵۶﴾
অর্থঃ- জান ও সম্পদের ইন্স্যুরেন্স মৌলিকভাবেই জায়েয নেই। কেননা যদি বিমাকারী পলিসি পূর্ণ করে তবে যত টাকার পলিসি করেছিল বিমা কোম্পানি তাকে তার বেশী টাকা প্রদান করে। এটা সুস্পষ্টভাবে সুদ। আর যদি বিমাকারী মেয়াদপূর্তির আগেই মারা যায় তাহলে তার নমিনী পূর্ণ টাকা পেয়ে যায়। অথচ বিমাকারী মাত্র কয়েকটা কিস্তি পরিশোধ করেছিল। তাহলে বুঝা গেল, বিমাকারী নিজেও জানে না যে বিমার কী ফলাফল হবে। কাউকে পূর্ণ কিস্তি পরিশোধ করতে হয় আবার কেউ দুই তিনটি কিস্তি দিয়েই পূর্ণ টাকা পেয়ে যায়। আর স্পষ্টত এটা জুয়ার অন্তর্ভুক্ত। বুঝা গেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি সুদ ও জুয়ার দ্বারা গঠিত একটি পদ্ধতি মাত্র আর শরীয়তে সুদ ও জুয়া উভয়টি নিষিদ্ধ। তাই বিমা মূলগতভাবেই জায়েয নয়।
(কিতাবুল ফাতাওয়া, ৫/৩৫৬)
ফাতাওয়ায়ে হাক্কানিয়ার ইবারত
اگر در حقیقت بیمۂ زندگی کی حقیقت یہی ہو جیساکہ ہمارا خیال ہے تو اسکو ہم درج ذیل وجوہ کی بنا پر ناجائز اور حرام سمجھتے ہیں:
(ا) پہلی وجہ یہ ہے کہ اس عقد میں ایک طرف سود پایا جاتاہے ...
(ب) وجہ دوم: دوسری طرف یہ عقد میسر اور قمار پر مشتمل ہے...
(ج) اس بیمہ دار شخص کی موت کی صورت میں کمپنی کو اسکی ادا کردہ رقم کا مالک صرف وہ شخص ہوتا ہے جو اس نے نامزاد کیا ہے اور باقی تمام ورثاء اس رقم سے یکسر محروم ہوجاتا ہیں، حالانکہ اسلامی قانون وراثت کی رو سے اس رقم میں وہ تمام ورثاء بھی حقدار ہیں...
(د) بیمہ کمپنی کے ساتھ تعاون علی الاثم والعدوان بھی پایا جاتا ہے جو قرآن کریم کی رو سے یہ عمل ناجائز ہے... الخ ﴿فتاوي حقانيۃ ۶/۲۲۰— ﴾
অর্থঃ- (পূর্বে পদ্ধতি আলোচনার পর) যদি জীবন বিমার পদ্ধতি এমন হয়ে থাকে যেমন আমাদের ধারণা, তাহলে বিমা নিম্নলিখিত কারণে অবৈধ ও হারাম।
১. বিমা চুক্তিতে সুদের অস্তিত্ব রয়েছে।
২. বিমার চুক্তি জুয়ার অন্তর্ভুক্ত।
৩. বিমাকারীর মৃত্যুর পর জমাকৃত টাকার মালিক হয় নমিনী হিসেবে যার নাম উল্লেখিত রয়েছে সে। অথচ ইসলামি ফারায়েয অনুযায়ী উক্ত টাকায় সমস্ত ওয়ারিসের নির্দিষ্ট অংশ রয়েছে।
৪. বিমা কোম্পানিতে যুক্ত হওয়ার দ্বারা تعاون علی الاثم والعدوان অর্থাৎ গুনাহের কাজে সহায়তা করা হয়। অথচ কুরআন মাজীদে تعاون علی الاثم والعدوان গুনাহের কাজে সহায়তা করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
(ফাতাওয়ায়ে হাক্কানিয়া, ৬/২২০)
বিমার ব্যাপারে কিছু ফাতাওয়ার কিতাবের ইবারত উল্লেখ করা হল। উক্ত ইবারতগুলোর বক্তব্য অতি সুস্পষ্ট। তা হল, বিমার প্রচলিত রূপ যেটাকে কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স বলে অভিহিত করা হয়, তা জায়েয নেই। এখন আমরা বিমা সংক্রান্ত কিছু বিচ্ছিন্ন জরুরী মাসয়ালা উল্লেখ করে বিমার বিকল্প ইসলামি ব্যবস্থার স্বরূপ সংক্ষেপে আলোচনা করে প্রবন্ধের ইতি টানবো ইনশাআল্লাহ!
প্রশ্ন নং - ০১। বিমা যদি সুদমুক্ত হয় তবে তার বিধান কী?
উত্তরঃ- বিমা সুদমুক্ত হলেও জুয়া অন্তর্ভুক্ত থাকেই। এজন্য বৈধ নয়।
(ফাতাওয়া উসমানী, ৩/৩২৮)
প্রশ্ন নং - ০২। কোথাও যদি বিমা আইনগতভাবে জরুরী হয় তাহলে কী করণীয়?
উত্তরঃ- যেখানে বিমা করা আবশ্যক, বিমা করা ছাড়া মানুষ তার প্রয়োজন সারতে সক্ষম নয় সেখানে বিমা করার অবকাশ আছে বটে। যেমন থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্স যা প্রায় সকল দেশেই আবশ্যকীয়। যা না করলে রাস্তায় গাড়ী নামানো অসম্ভব। এ ক্ষেত্রে যদি গাড়ী দুর্ঘটনার পর বিমা কোম্পানি গ্রাহককে ক্ষতিপূরণ দেয় তাহলে গ্রাহকের জন্যে ততটুক নেওয়া জায়েয হবে যে পরিমাণ অর্থ প্রিমিয়াম হিসেবে কোম্পানিতে পরিশোধ করেছে। তার বেশী গ্রহণ করা জায়েয হবে না।
(ইসলাম আওর জাদীদ মাআশী মাসায়েল, ৩/৩১৭)
প্রশ্ন নং - ০৩। বিমা কোম্পানিতে এজেন্ট হয়ে কাজ করে কমিশন গ্রহণ করা জায়েয হবে কি?
উত্তরঃ- বিমা কোম্পানির বর্তমান কার্যক্রম যেহেতু সুদি লেনদেনের সাথে জড়িত তাই এতে এজেন্ট হয়ে কমিশন গ্রহণ করা সুদী কাজে সহযোগিতা করে বিনিময় গ্রহণ করা। সুতরাং তা না জায়েয।
(আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল, ৩/১৯৮)
প্রশ্ন নং - ০৪। সরকারের পক্ষ থেকে চাকুরীজীবীদের মাঝে যে গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স হয়ে থাকে, তার বিধান কী?
উত্তরঃ- গ্রুপ ইন্স্যুরেন্সের নিয়মকানুন জনার পর বুঝা গেল যে, এই ইন্স্যুরেন্সে প্রত্যেক চাকুরিজীবীর মাসিক বেতনের কিছু অংশ সরকার স্বেচ্ছায় অনিচ্ছায় কেটে রাখে। এটা সরকারের জন্যে যদিও ঠিক নয় তথাপি যে কর্মচারীদের বেতনের কিছু অংশ সরকার কেটে রাখে তাতে দুই সুরতঃ- ১. যদি এই টাকা উক্ত কর্মচারীকে সরকার ফেরত না দেয় তবে এটা (গসব) ছিনতাই বলে সাব্যস্ত হবে।
২. যদি দুর্ঘটনাবশত বা অন্য কারণে সরকারের পক্ষ থেকে উক্ত কর্মচারীকে তার বেতন থেকে জমা টাকার চেয়ে বেশি টাকা প্রদান করে তাহলে এটা প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের অতিরিক্ত টাকার মতই সুদবিহীন বলে গণ্য হবে। কেননা কর্মচারী থেকে তার অনিচ্ছায় জবরদস্তিমূলক বেতনের কর্তিত অংশ دین ضعیف হওয়ার কারণে কর্মচারীর পরিপূর্ণ মালিকানা তাতে থাকে না। এজন্য সরকার উক্ত টাকায় হস্তক্ষেপ করে যে প্রবৃত্তি ঘটায় তা কর্মচারীর মালিকানাভুক্ত গণ্য হয় না। এখন সরকারী হস্তক্ষেপে অর্জিত লভ্যাংশ থেকে যদি সরকার কোন কর্মচারীকে কিছু দেয় তবে সেটা অনুদান বলে গণ্য হবে। সুদের অন্তর্ভুক্ত হবে না। সুতরাং কর্মচারীর পক্ষে তা গ্রহণ করা জায়েয আছে। কিন্তু সরকার উক্ত টাকা দ্বারা অবৈধ পন্থায় মুনাফা অর্জন করার সম্ভাবনার রয়ে যায় বিধায় কর্মচারী কেবল মূল টাকা গ্রহণ করবে। অতিরিক্ত টাকা গরীবদের মাঝে সাদকাহ করে দিবে। এটাই অধিক সতর্কতা। (ফাতাওয়ায়ে উসমানী, ৩/৩৩৬)
প্রশ্ন নং - ০৫। বিদেশ সফরে কখনো কখনো জীবন বিমা আবশ্যক হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে
করণীয় কী?
উত্তরঃ- বিমা যদিও বৈধ নয় কিন্তু যদি বিমা ছাড়া বিদেশ সফর অসম্ভব হয়ে পড়ে তাহলে অপারগ হয়ে বিমা করার অবকাশ আছে বটে। কিন্তু ক্ষতিপূরণ ততটুকু গ্রহণ করবে যে পরিমাণ অর্থ প্রিমিয়াম হিসেবে জমা করেছে। (ফাতাওয়ায়ে উসমানী, ৩/৩৩৫)
প্রশ্ন নং - ০৬ যদি কেউ লাভের টাকা নিয়ত ছাড়া দানের উদ্দেশ্যে খরচ করার মানসে বিমা করে তাহলে জায়েয হবে কী?
উত্তরঃ- এ সুরতেও বিমা করা জায়েয হবে না। (জাওয়াহিরুল ফিকহ, ২/২৩৭)
প্রশ্ন নং - ০৬। কোন মুসলমান দারুল হারবে অবস্থান করে। তার জন্যে কি দারুল হারব অর্থাৎ অমুসলিম রাষ্ট্রের বিমা কোম্পানিতে শরীক হওয়া ও মুনাফা গ্রহণ করা জায়েয হবে?
উত্তরঃ- দারুল হারবে কাফেরদের সাথে عقود فاسدہ এর অনুমতি অন্যান্য ইমামগণ দিলেও ইমামে আযম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি নাজায়েয বলেছেন। ইমা
আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি জায়েয হওয়ার জন্যে একটি শর্ত উল্লেখ করেছেন। তাহল কোন মুসলমান তাতে শরীক থাকতে পারবে না। উপরোন্তু সুদ ও জুয়ার হুরমত কুরআনের নসের মাধ্যমে সাব্যস্ত। সুতরাং দারুল হারবেও এ সকল।চুক্তি থেকে বিরত থাকা কর্তব্য। হ্যাঁ, অনোন্যপায় হলে ভিন্ন কথা।
(জাওয়াহিরুল ফিকহ, ৩/১৮৬, ২৩২
প্রশ্ন নং - ০৮। Mutual Insurance তথা পারস্পরিক সহযোগিতা বিমার বিধান কী?
উত্তরঃ- মিউচুয়াল ইন্স্যুরেন্সে যেহেতু ব্যবসার উদ্দেশ্য থাকে না। বরং পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহায়তা করা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে আর এ ক্ষেত্রে জমাকৃত টাকার মালিক হয় ফাণ্ড। সুতরাং এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। ইসলাম একে অপরকে সহায়তা করতে উৎসাহ প্রদান করেছে। সুতরাং বিমার এ সুরতটি সর্বসম্মতভাবে জায়েয। তবে প্রত্যেক জায়েয বস্তু ততক্ষণ জায়েয হিসেবে বাকী থাকে যতক্ষণ তাতে শরীয়ত পরিপন্থী কোন শর্তের অনুপ্রবেশ না ঘটে। এজন্য দিকটা খেয়াল রাখা বেশ জরুরী।
(ইসলাম আওর জাদীদ মাআশী মাসায়েল, ৩/৩১৩)
কমার্শিয়াল বিমার বিকল্প শরয়ী রূপরেখা
এ যাবত আলোচনায় বিমা শরীয়তসম্মত না হওয়ার বিষয়টা যেমন সুস্পষ্ট হয়েছে তেমনি মানুষের প্রয়োজনীয়তাও ফুটে উঠেছে। এ জন্যে মানুষের প্রয়োজন পূরণের স্বার্থে বিমার বিকল্প ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত অপরিহার্য ও জরুরী বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। উলামায়ে কেরাম পারস্পরিক সহযোগিতা বিমাকে কমার্শিয়াল বিমার বিকল্প হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। এই মিউচুয়াল ইন্স্যুরেন্স বা পারস্পরিক বিমার পরিশোধিত ও উন্নত রূপায়নই হল "শিরকাতে তাকাফুল" যা বিভিন্ন ইসলামী রাষ্ট্রে আত্মপ্রকাশ করেছে। যা তাকাফুলে ইসলামী "شركاة التكافل الاسلامي" নামে প্রসিদ্ধ।
তাকাফুলে ইসলামীঃ- আল্লামা তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহু শিরকাতে তাকাফুলে ইসলামীর গঠনপ্রণালী ও কার্যক্রম যেভাবে উল্লেখ করেছেন তার সারমর্ম নিম্নরূপঃ- শিরকাতে তাকাফুলে ইসলামির মূল ভিত্তি হবে অনুদান ও সহায়তা প্রদান। বিনিময় চুক্তি কোন উদ্দেশ্য হতে পারবে না। কিছু লোক মিলে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে যে মূলপুঁজি হবে তা হালাল ব্যবসায় লাগাবে। তারা গ্রাহকদের থেকে যে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করবে তাও হালাল ব্যবসায় লাগাবে। অতপর সেই ব্যবসার লাভ থেকে একটি ভিন্ন ফাণ্ড তৈরি করবে এই উদ্দেশ্যে যে, কেউ ক্ষতিগ্রস্থ হলে তাকে এই ফাণ্ড থেকে সাহায্য-সহায়তা করা হবে। যাকে তাকাফুল ফাণ্ড বলে অভিহিত করা হবে। এই ফাণ্ড থেকে শেষ সময় পর্যন্ত সহায়তা করার পর কিছু অবশিষ্ট থাকলে সেটা চাইলে শরীকদের মাঝে বণ্টন করে দিতে, আবার চাইলে তা দান করতে পারে। তবে বিশুদ্ধ পন্থা হল 'তাকাফুল ফাণ্ড' দানের জন্যে ওয়াকফ করে দিবে। এ পদ্ধতিতে দুবাই, বাহরাইন ও তিউনিসিয়ার কিছু ইসলামী বিমা কোম্পানি প্রচলিত আছে।
বিমার বিকল্প হিসেবে মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া দামাত বারাকাতুহু সুন্দর একটি রূপরেখা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, "পারস্পরিক সহযোগিতা বিমাই হচ্ছে প্রচলিত বিমার বলিষ্ঠ বিকল্প। পারস্পরিক সহযোগিতা বিমাকে ব্যাপক ভিত্তিতে সবক্ষেত্রে চালু করা গেলে এবং বৃহৎশিল্প, ক্ষুদ্রশিল্প, কৃষিকর্ম, চাকুরিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষ পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা গেলে; কমার্শিয়াল বিমা দ্বারা জনগণের ও অর্থনীতিতে যে কল্যাণ হয় বলে মনে করা হয় তা সহজে অর্জন করা সম্ভব হবে। অবশ্য এর জন্যে সরকারী আইন, তত্ত্বাবধান ও আর্থিক সহযোগিতার প্রয়োজন হবে।
বৃহৎশিল্প, ক্ষুদ্রশিল্প ও কৃষিকর্মের ময়দান পর্যন্ত পারস্পরিক সহযোগিতা বিমার যে রূপরেখা দাঁড়াবে, তা নিম্নরূপঃ-
একটি সুষ্ঠু ও ব্যাপক পরিকল্পনার আওতায় সরকারী তত্ত্বাবধানে সরকারী প্রতিনিধি, অর্থনীতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি, শিল্প মালিক প্রতিনিধি এবং কৃষি ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কেন্দ্রীয় পারস্পরিক সহযোগিতা সংস্থা গঠন করা হবে। সংস্থার লক্ষ্য হবে নিম্নরূপঃ-
১. সারাদেশে গ্রামীণ অবকাঠামো পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মাঝে বিভিন্ন পর্যায়ে সহযোগিতা সংস্থা গড়ে তোলার জন্যে একটি করে সুষ্ঠু সুচিন্তিত রূপরেখা প্রণয়ন করত তার ব্যাপক প্রচার করা এবং ক্ষুদ্র ইউনিট পর্যায়ে পারস্পরিক সাহায্য সংস্থা গড়ে তুলে সেগুলোকে শ্রেণীভিত্তিক নেটওয়ার্কের আওতায় এনে কেন্দ্রীয় সংস্থার সংশ্লিষ্ট করা।
২. দুর্ঘটনা কবলিত ব্যক্তিদের পুঁজি যোগদানের ব্যবস্থা করা। এজন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা।
৩. মজুর শ্রেণীর মানুষের অভাব-অনটনে সুদমুক্ত সাময়িক ঋণদানের ব্যবস্থা করা।
৪. দেশে বেকার সমস্যা নিরসনের পন্থা উদ্ভাবন করা।
৫. ব্যবসায়িক বিপর্যয় রোধে জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ।
৬. আর্থিক সংকটকালে সরকারকে সুদবিহীন সহযোগিতা করা।
৭. প্রাকৃতিক বিপদে ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তা প্রদান ইত্যাদি।
উপরিউক্ত মূলনীতির আলোকে পেশাভিত্তিক লোকদের সমন্বয়ে আলাদা সহযোগিতা সংস্থা গড়ে তোলা।
উপসংহার
মোদ্দাকথা হল ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী এ ধরণের সহযোগিতা সংস্থা গড়ে তুললে এর দ্বারা মানুষ জুলুমাত্মক শোষণ থেকে মুক্তি পাবে। আবার ক্ষতিপূরণ পাওয়া ও দুর্যোগ মোকাবেলা করার ব্যাপারে নিশ্চয়তা লাভ করবে। তদুপরি ভবিষ্যতের জন্যে তাদের সঞ্চয়ও জমা হবে। কিছু কিছু দেশে ইসলামী বিমা বা ইসলামী তাকাফুল ইত্যাদির নামে এ ধরণের সহযোগিতা সংস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা হচ্ছে। এ চেষ্টা সফল হলে মানুষ হারাম বিমা থেকে মুক্ত থাকার বিকল্প পথ সহজে পেয়ে যাবে। তাদের সে প্রচেষ্টা সফল হোক এবং মানুষ তার মাধ্যমে হারাম বিমা থেকে বেঁচে থাকুক। মহান আল্লাহ তৌফিক দান করুন।
প্রত্যায়নঃ-
মুফতি মুহাম্মাদ জাহাঙ্গীর হুসাইন সাহেব
সিনিয়র মুফতি, জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া টঙ্গী, পূর্ব আরিচপুর, গাজিপুর
বিমার ইংরেজি প্রতিশব্দ ইন্স্যুরেন্স (Insurance) যার অর্থ হল নিরাপত্তা দেওয়া বা গ্যারান্টি প্রদান করা। নিশ্চয়তা প্রদান করার অর্থেও শব্দটির বহুল ব্যবহার প্রচলিত। উউলামায়ে কেরামের ভাষায় বিমার আলাদা আলাদা কিছু পারিভাষিক পরিচয়ও রয়েছে। যেমন বাংলাদেশের শাণিত কলমের অধিকারীদের একজন মাওলানা আবুল ফাতাহ ইয়াহইয়া সাহেব -মুদ্দা জিল্লুহু- বলেন, "বিমা হল এক ধরণের অর্থ লেনদেনের চুক্তি, যাতে ভবিষ্যতে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে তার ক্ষতিপূরণ দেয়ার গ্যারণ্টির ভিত্তিতে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত কিস্তিতে টাকা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। যে সংস্থা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার শর্তে টাকা গ্রহণ করে তাকে বলা হয় বিমা কোম্পানি।"
আরেক বরেণ্য ব্যক্তিত্ব আল্লামা তাকী উসমানী দা.বা. বিমার পরিচয় তুলে ধরেন এভাবে যে, "মানুষের ভবিষ্যতে সম্ভাব্য দুর্ঘটনা যা ঘটতে পারে, কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সে সকল দুর্ঘটনার আর্থিক ক্ষতিপূরণের দায়িত্ব গ্রহণ করা।"
মাওলানা ইসহাক সাহেব রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বিমার বাস্তবতা ও পরিচয় অত্যন্ত সুন্দর ও সাবলীলভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন- বিমা মূলতঃ বিমা কোম্পানি ও আবেদনকারীর মধ্যবর্তী এক চুক্তি। এর পদ্ধতি হল, বিমা কোম্পনি নির্দিষ্ট মেয়াদে গ্রাহক থেকে নির্ধারিত হারে কিস্তির আকারে এক নির্দিষ্ট অংকের অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। মেয়াদ শেষে উক্ত নির্দিষ্ট অংকের টাকার সাথে আরো কিছু টাকা বৃদ্ধি করে গ্রাহককে বা গ্রাহক কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তিকে ফেরৎ প্রদান করা হয়ে থাকে। উক্ত বাড়তি টাকাকে পরিভাষায় বোনাস অভিহিত করা হয়। যেমনঃ কোন গ্রাহক থেকে যদি পাঁচ বছরে কিস্তি আকারে ৬,০০০ টাকা সংগ্রহ করে থাকে তাহলে মেয়াদ শেষে উক্ত গ্রাহককে ৬,০০০ টাকার সাথে আরো এক দেড় হাজার টাকা বৃদ্ধি করে দিয়ে দেওয়া হয়। পরিভাষায় এই অতিরিক্ত বাড়তি টাকাকেই বোনাস বলা হয়। সাথে সাথে কখনো কোন গ্রাহক যদি দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয় তাহলে সেই বিমা কোম্পানি তাকে আর্থিক সহায়তাও প্রদান করে থাকে। এটা হল গ্রাহকের লাভের দিক। এক্ষেত্রে কোম্পানির লাভের দিকটা হল - গ্রাহক থেকে গ্রহণকৃত অর্থ উচ্চসুদে লাগিয়ে বিশাল অংকের মুনাফা অর্জন করা। চাই সেটা ব্যবসার মাধ্যমে হোক বা অন্যকোন খাতের মাধ্যমে। আর গ্রাহকের অর্থ দ্বারা অর্জিত সেই বিশাল মুনাফার সামান্যতম অংশ গ্রাহককে বোনাস হিসেবে প্রদান করে থাকে। কখনো প্রয়োজন হলে সেই সামান্যতম অংশ দ্বারাই দুর্ঘটনাকবলিত ব্যক্তিকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে থাকে। কিন্তু মূল উদ্দেশ্য থাকে মুনাফা অর্জন।
বিমার সূচনা :
বর্ণিত আছে বিমার সূচনা ঘটে চতুর্দশ শতকের দিকে। তৎকালীন সময়েও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বর্তমান সময়ের মত সাগর পথে মালামাল আমদানি রপ্তানি হত। অনেক সময় পণ্যবাহী জলজাহাজ দুর্যোগে ডুবে যেয়ে মাল সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেত। এতে করে ব্যবসায়ীরা নিঃসম্বল অসহায় হয়ে পড়ত। এর কোন সুরাহা করা যায় কি না? এ নিয়ে তদানীন্তন সময়ে ব্যাপক গবেষণার পর সর্বপ্রথম ইটালিয়ান বণিকরা একটি পদ্ধতি আবিষ্কার কররে সক্ষম হন। সেই পদ্ধতিটি ছিল এমন - যদি কোন ব্যক্তির পণ্যবাহী জাহাজ মালামালসহ সাগরে নিমজ্জিত হয় তখন অন্যান্য সকল বণিকরা তাকে সাহায্য করার জন্যে প্রতিমাসে নির্দিষ্ট হারে অর্থ সঞ্চয় করত। সে ফান্ড থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত বণিককে সহায়তা প্রদান করা হত।এতে করে কোন ব্যক্তির পণ্যবাহী জাহাজ সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হলেও সে একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ত না। এ উদ্যোগটিই পরবর্তীতে নৌবিমা হিসেবে পূর্ণতা লাভ করে।
অন্য এক বর্ণনা পাওয়া যায়, সর্বপ্রথম উন্দুলুসের এক মুসলিম শাসকের যুগে সমুদ্রপথে ক্ষতিগ্রস্ত বণিকদের সাহায্য করণার্থে ব্যবসায়িক বিমার (Commercial Insurance) পদ্ধতি সূচিত হয়। তখনকার সময়ে বিমার পদ্ধতি ও নিয়মকানুন ছিল একদম সাধারণ। পরবর্তিতে বিভিন্ন সময়ে ধাপে ধাপে বিমায় নতুন নতুন পদ্ধতি চালু হতে থাকে। নেদারল্যান্ডস এক্ষেত্রে সবার চেয়ে একধাপ এগিয়ে। বর্তমানে অনেক দেশে বিভিন্ন খাতে বিমা করা রাষ্ট্রীয় আইনে রূপান্তরিত করা হয়েছে। সে সকল দেশের জনগণকে বাধ্য হয়েই বিমা করতে হচ্ছে। আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে চিকিৎসা বিমা (Medical Insurance) এবং বিশ্বের প্রায় সব দেশেই দায়িত্ব বিমা (Third party Insurance) করাটা আবশ্যক।
উসমানী খেলাফতের সময়ে তুর্কি বণিকরা যখন ইউরোপিয়ান বণিকদের সাথে বাণিজ্যে জড়িত হয়ে পড়ে, সে সময় ইউরোপিয়ান ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ইসলামী রাষ্ট্রসমূহে বিমার ব্যাপক প্রচলন ঘটে। তৎকালীন আলেমদের নিকট এ ব্যাপারে বিভিন্ন প্রশ্ন আসতে থাকে। যেমন ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রশিদ্ধ ফকীহ আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ফাতাওয়ায়ে শামী-তে " নিরাপত্তা বিধান সংক্রান্ত আলোচনায় " سوكرة " নামে বিমার কথা উল্লেখ করে বলেন :-
وبما قررنا يظهر جواب ما كثر السوال عنه في زماننا وهو أنه جرت العادة أن التجار اذا استاجروا مركبا من حربي يدفعون له أجرته ويدفعون أيضا مالا معلوما لرجل حربي مقيم في بلاده يسمي ذالك المال "سوكرة" علي أنها مهما هلك من المال الذي في المركب بحرق أو غرق أو نهب أو غيره. فذالك الرجل ضامن له بمقابلة ما يأخذه منه وله وكيل عنه مستامن في دارنا يقيم في البلاد السواحل الاسلامية باذن السلطان يقبض من التجار مال السوكرة، وأذا هلك مالهم في البحر شيئ يودي ذالك المستامن من التجار بدله تماما. ( رد المحتار ٤/١٧٠)
অর্থঃ "আমাদের আলোচনার মাধ্যমে ঐ প্রশ্নের উত্তরও সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে প্রশ্নটি আজকাল অনেক বেশি উত্থাপিত হচ্ছে। তা হল - বর্তমান সময়ে একটা পদ্ধতির প্রচলন ঘটেছে যে, কোন হারবী ব্যক্তি যখন কোন সামুদ্রিক পণ্যবাহী জাহাজ ভাড়ায় নেয় সে ঐ ভাড়া পরিশোধ করার সাথে সাথে দারুল হারবের কোন বাসিন্দা যে দারুল হারবেই অবস্থান করে থাকে, তাকে কিছু অর্থ এই শর্তে দেয় যে, জাহাজের মালামাল জাহাজ ডুবিতে বা অগ্নিকাণ্ডে অথবা লুটতরাজের কারণে বিনষ্ট হলে সে ব্যক্তি উক্ত মালের আর্থিক ক্ষতিপূরণ বহন করবে। সে অর্থ কে "আরবী " বিমা অর্থ বলে অভিহিত করা হত। তার দায়িত্বশীল ব্যক্তি ইসলামী রাষ্ট্রের সমুদ্র বন্দরে সরকারী নির্দেশ মাফিক নিরাপত্তা লাভ করতঃ অবস্থান করত। সে বণিকদের থেকে বিমার অর্থ উসুল করত এবং মালামালের ক্ষয়ক্ষতি হলে ব্যবসায়ীকে ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থ প্রদান করত।" (ফাতাওয়ায়ে শামী ৩/৩৪৫)
উক্ত ইবারতের মাধ্যমে বুঝা যায় তৎকালীন সময়ে সামুদ্রিক বিমার প্রসার বেশ ভালভাবেই হয়েছিল। ইউরোপ থেকে যে সকল জাহাজ ভাড়ায় আনা হত সেগুলোকে আবশ্যকীয়ভাবে বিমা করাতে হত।
ভূমিকায় আরেকটি কথা না বললেই নয়; তাহল - বিমার সূচনা যে উদ্দেশ্য নিয়ে হয়েছিল তা ছিল সম্পূর্ণ সঠিক। বিমার মাধ্যমে শুধুমাত্র ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তা করাই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। যেন অন্যান্য বণিকদের মতই একজন বণিক নিয়তির পরিহাসে নিঃস্ব হয়ে মানবেতর জীবন যাপন না করে। আর একথা তো সুস্পষ্ট যে, পারস্পরিক সাহায্যের মাধ্যমে সহায়-সম্বলহীন ব্যক্তিকে সহায়তা করা নিঃসন্দেহে অতিপ্রশংসনীয় উদ্যোগ। ইসলাম ধর্ম বরাবরই এব্যাপারে গুরত্ব প্রদান করে আসছে। কিন্তু বড় পরিতাপের বিষয় হল এই যে, তৎকালীন যুগেই বিমার এ মহৎ উদ্দেশ্যটি আপন অবস্থায় বাকী থাকেনি। বিমা যখন ইহুদীদের হাতে যাওয়ার পর তারা এর মাঝে সুনিপুণভাবে সুদ ও জুয়ার সংমিশ্রণ ঘটিয়ে দিল। যেমন শায়েখ আবু যুহরা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেনঃ
اگرچہ اسکی اصلیت تو تعاون محض تھا لیکن اسکا انجام بھی ہر اس ادارہ کا سا ہوا جو یہودیوں کے ہاتھ میں پڑا کہ یہودیوں نے اس نظام کو جس کی بنیاد تعاون علی البر والتقوی پر تھی، اسے ایک ایسے یہودی نظام میں تبدیل کردیا جس میں قمار (جوا) اور ربوا (سود) دونوں پائے جاتے ہیں،
(لواء الاسلام)
অর্থঃ- বিমার মূলভিত্তি যদিও পারস্পরিক সহযোগিতার উপর ছিল কিন্তু তার শেষ ফল ঠিক ঐসকল সংস্থার ন্যায় হয়েছে যা ইহুদীদের অন্তর্গত ছিল। তারা যে ব্যবস্থার ভিত্তি ছিল ( تعاون علي البر والتقوي ) অর্থাৎ নেককাজ ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে একে অপরকে সাহায্য করা। এর উপর, সেই ব্যবস্থাকে এমন ইহুদি ব্যবস্থায় পরিবর্তন করে দিয়েছে যার মধ্যে জুয়া ও সুদ উভয়টির উপস্থিতি বিদ্যমান।
বিমার প্রকারভেদঃ- উপরিউক্ত আলোচনার পর বিমার সুরত বা পদ্ধতি আরো সুস্পষ্টভাবে জানার জন্যে বিমার প্রকারভেদ জেনে নেওয়াটা জরুরী। বর্তমান সময়ে বিমার অনেক প্রকার ও শাখা-প্রশাখা বিদ্যমান। প্রত্যেক কোম্পানি গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী বিমা প্যাকেজ তৈরি করে থাকে। তবে মৌলিকভাবে বিমাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। সেগুলো হলঃ-
১. সম্পত্তি বিমা (Good Insurance)
২. দায় বিমা বা তৃতীয় পক্ষ বিমা (Third Party Insurance)
৩. জীবন বিমা (Life Insurance)
উপরোক্ত বিষয়গুলোর প্রত্যেকটির সাথে যেহেতু ইসলামী বিধিবিধান জড়িত রয়েছে, তাই বিষয়গুলো খুলে খুলে আলোচনা করার দাবি রাখে। নিচে তার আলোচনা করা হলঃ-
১. সম্পত্তি বিমা (Good Insurance) আরবীতে বলা হয় تأمين الاشياء এর পক্রিয়া বা পদ্ধতি হলঃ- কোন ব্যক্তি কোন পণ্যের বিমা করাতে চাইলে সে নির্দিষ্ট হারে বিমা কোম্পানি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ফিস হিসেবে পরিশোধ করতে থাকে যা অফেরৎযোগ্য। এই নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ যা ফিস হিসেবে পরিশোধ করা হয় তাকে প্রিমিয়াম (Premium) বলা হয়। প্রিমিয়াম যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধাপে ধাপে পরিশোধ করা হয়ে থাকে, এজন্য আরবীতে তাকে (আরবী) কিস্তি বলে। এখন সেই পণ্যটি দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেলে বিমা কোম্পানি তার আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিবে। আর যদি সে পণ্যটি কখনোই কোনরূপ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তাহলে বিমা কোম্পানি তাকে কিছুই প্রদান করে না। বিমা গ্রহীতা যে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রিমিয়ামরূপে জমা পরিশোধ করেছিল তাও ফেরত পায় না। যেমন কেউ কোন বিল্ডিংয়ের উপর বিমা করল। এজন্য সে বিমা কোম্পানিকে এক বছরে প্রতিমাসে ৫ হাজার টাকা হারে ৬০,০০০ হাজার টাকা প্রিমিয়াম পরিশোধ করল। এখন উক্ত বিল্ডিংয়ে কোন ক্ষয়ক্ষতি হলে, যেমন আগুন লাগলে বা ভূমিকম্প দ্বারা ক্ষতি হলে বিমা কোম্পানি ক্ষতিপূরণ বহন করবে। আর যদি নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে বিল্ডিংয়ের কোন ক্ষতি না হয় তাহলে গ্রাহক যে প্রিমিয়াম জমা করেছে তা ফেরত পাবে না।
এমনিভাবে সামুদ্রিক জাহাজের বিমা করা হয়। তার প্রক্রিয়া এমনঃ- জাপান থেকে সমুদ্র পথে কোন পণ্য আমদানি হবে বাংলাদেশে। কিন্তু সমুদ্র পথে জাহাজ ডুবে গিয়ে আমাদানিকারীর সমূহ ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশংকা রয়েছে। এজন্য আমদানিকারী সেই জাহাজ ও তার মালামালের বিমা করে থাকে। এক্ষেত্রে বিমা প্রতিষ্ঠানকে সে নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রিমিয়াম আদায় করে আর বিমা কোম্পানি তাকে এই নিশ্চয়তা দিয়ে দেয় যে, তার পণ্যবাহী জাহাজ যদি ক্ষতিগ্রস্থ হয় তাহলে বিমা কোম্পানি সে ক্ষয়ক্ষতির দায়ভার গ্রহণ করবে।
তদ্রূপ গাড়ীর বিমাও করা হয়। তা এভাবে যে, গাড়ী চুরি হয়ে গেলে বা আগুনে বিনষ্ট হয়ে গেলে বিমা কোম্পানি তার দায়ভার গ্রহণ করবে। বদলে গাড়ির মালিক বিমা কোম্পানিকে নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রিমিয়াম পরিশোধ করবে। নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে গাড়ির কোন ক্ষতি হলে তো বিমা কোম্পানি তা বহন করবে, আর যদি কোন ক্ষয়ক্ষতি না হয় তাহলেও গাড়ির মালিক তার প্রিমিয়াম থেকে কোন অর্থ ফেরত পাবে না।
বর্তমানে প্রায় প্রত্যেকটি বস্তুর বিমা করার প্রচলন শুরু হয়েছে। এমনকি বিভিন্ন খেলোয়াড়, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের করিয়ে রেখেছেন। এর পদ্ধতি অনেকটা এমন যে, কোন অভিনেতা বিমা কোম্পানিকে তার শরীরের কোন অঙ্গের বিমাস্বরূপ নির্দিষ্ট অংকের টাকা প্রিমিয়াম পরিশোধ করবে। অতঃপর নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে যদি উক্ত অঙ্গের কোন ক্ষতি হয় তাহলে বিমা কোম্পানি সে অঙ্গের ক্ষতিপূরণ আদায়ে বাধ্য থাকবে। আর ক্ষতি না হলে গ্রাহক যে অর্থ প্রিমিয়াম হিসেবে জমা করেছে, বিমা কোম্পানি তার মালিক হয়ে যাবে গ্রাহক কোন টাকা ফেরৎ পাবে না। যেমন মার্কিন গায়িকা মারায়া ক্যারির তার দুই পা বিমা করেছেন দশ কোটি ডলারে। অন্য মার্কিন গায়িকা ও অভিনেত্রী জেনিফার লোপেজ তার নিতম্ব বিমা করিয়ে রেখেছেন ৩০ কোটি ডলারে। (বাংলা নিউজ২৪, ১৮ মার্চ ২০১৫ইং)
২. দায় বিমা বা তৃতীয় পক্ষ বিমা : আরবীতে এটাকে " تأمين المسئولية " এর পদ্ধতি হল কারো উপরে ভবিষ্যতে কোন দায়িত্ব আরোপিত হতে পারে, এ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্যে বিমা করা হয়। এটাকে তৃতীয় পক্ষ বিমা (Third Party Insurance) বলা হয়। যেমন কোন ব্যক্তি রোডে গাড়ী নামাবে। এই গাড়িতে এক্সিডেন্ট হয়ে অন্যকোন ব্যক্তি বা বস্তুর প্রাণহানি বা ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। এজন্য গাড়ীর ক্রেতা উক্ত ক্ষতিপূরণ থেকে দায়মুক্ত হওয়ার লক্ষে গাড়ীর বিমা রাখেন এবং নির্দিষ্ট হারে প্রিমিয়াম পরিশোধ করতে থাকেন। অতঃপর উক্ত গাড়ী যদি কখনো এক্সিডেন্ট করে আর তাতে কারো প্রাণহানি বা ক্ষয়ক্ষতি হয়, তখন গাড়ীর মালিকের পক্ষ থেকে বিমা কোম্পানি সে প্রাণহানি বা ক্ষয়ক্ষতির দায়ভার গ্রহণ করবে এবং গাড়ীর মালিকের উপর যে জরিমানা আরোপিত হবে বিমা কোম্পানি তা পরিশোধ করে দিবে। আর যদি সেরূপ কোন দুর্ঘটনা না ঘটে তাহলে গাড়ীর মালিককে বিমা কোম্পানি কোন অর্থই দিতে হবে না। এমনকি প্রিমিয়াম হিসেবে যা জমা দিয়েছে তাও গাড়ীর মালিক ফেরৎ পাবে না।
আমেরিকাসহ অন্যান্য অনেক দেশে রাতে প্রচুর পরিমাণে তুষারপাত (Snowfall) হয়। বরফে রাস্তাঘাট সবকিছুই ঢাকা পড়ে যায়। রাস্তা থেকে বরফ না সরালে চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়ে। অনেক সময় বরফে পা পিছলে অঙ্গহানি বা প্রাণহানি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এজন্য সরকারী উদ্যোগে রাস্তা থেকে বরফ সরানোর ব্যবস্থা করা হয়। তবে বাড়ির আঙ্গিনায় যে বরফ থাকে পতিত থাকে তা প্রত্যেক বাড়ির মালিককে ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিষ্কার করতে হয়। যদি কোন ব্যক্তি তার বাড়ির আঙ্গিনা বরফমুক্ত না করে আর তাতে পা পিছলে কারো ক্ষতি হলে বাড়ির মালিক সে ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ আদায় করতে বাধ্য। পশ্চিমা অনেক দেশে এ ব্যাপারে নীতিমালা প্রণয়ন করতঃ আইন পাশ করা হয়েছে। মসজিদ গীর্জাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে একই আইন। অর্থাৎ মসজিদের আঙ্গিনায় বরফ পড়ে থাকলে আর সে বরফে পা পিছলে কেউ ক্ষতিগ্রস্থ হলে মসজিদ তার ক্ষতিপূরণ আদায় করতে বাধ্য থাকবে। এজন্য বাড়ির মালিকেরা বিভিন্ন কোম্পানির সাথে এই শর্তে বিমা করে থাকেন যে, কখনো বরফের কারণে কোন ক্ষতিপূরণের দায় বর্তালে বিমা কোম্পানি সে দায়ভার নিবে। এজন্য প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রিমিয়াম আদায় করবে। আর যদি এরকম কোন দুর্ঘটনার সম্মুখীন না হয় তাহলে মেয়াদ শেষে বিমা কোম্পানি উক্ত অর্থের মালিক বনে যাবে। এটা হল তৃতীয় পক্ষ বিমা। আজকাল সবদেশেই গাড়ীর ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষ বিমা করাটা বাধ্যতামূলক। বিমা করা ছাড়া কোন গাড়ি রোডে নামানোর অনুমতি নেই।
৩. জীবন বীমা (Life Insurance) আরবীতে "تأمين الحياة " বলে অভিহিত করা হয়। এর নিয়ম এমন যে, বিমা কোম্পানি গ্রাহকদের নিকট এই আহবান করে যে, আপনারা আমাদের নিকট কিছু প্রিমিয়াম জমা করবেন। আমরা সে অর্থ আপনারা একাউন্টে সঞ্চয় করে রাখব। বীমা কোম্পানি এই কিস্তির মেয়াদ ধার্য করে গ্রাহকের বেঁচে থাকার বিবেচনায়। অর্থাৎ তারা বিমা গ্রহীতার সুস্থতা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করতঃ অনুমান করে থাকে যে, বিমা গ্রহীতা সাধারণভাবে আর কত বছর পর্যন্ত জীবিত থাকবে? ধরুন আব্দুল খালেক সাহেব জীবন বিমা করতে ইচ্ছুক। তখন বিমা কোম্পানি প্রথমে তার স্বাস্থ্য চেকআপ ইত্যাদি করার পর আন্দাজ করা গেল যে, আব্দুল খালেক সাহেব আর দশ বছর বেঁচে থাকতে পারেন। এখন বিমা কোম্পানি তার সাথে এভাবে চুক্তি করবে যে, আপনি দশ বছর পর্যন্ত প্রতিমাসে একশ টাকা হারে আমাদের কাছে প্রিমিয়াম জমা দিবেন। এভাবে বছরে বারশ আর দশ বছরে বার হাজার টাকা সঞ্চয় হবে। এখন যদি দশ বছর পূর্ণ হবার পূর্বেই আপনি মারা যান তবে বিমা কোম্পানি আপনার স্ত্রী সন্তান বা মনোনীত ব্যক্তিকে এককালীন দশ লাখ টাকা প্রদান করবে। আর মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে যদি গ্রাহক মারা না যান তবে মেয়াদ শেষে আপনার সঞ্চয়কৃত টাকা সুদসহ ফেরত পাবেন। এটাকেই জীবন বিমা বলা হয়। এর আরো অনেক পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে।
আজকাল জীবন বিমা ব্যাপকহারে করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে নাকি মানুষের এই প্রশান্তি অর্জন হয় যে, আমার মৃত্যুর পর সন্তান সন্ততি না খেয়ে মারা যাবে না। কিছুদিন হলেও আমার বিমাকৃত অর্থে তাদের দিনাতিপাত হয়ে যাবে ইত্যাদি। আর জীবন বিমার ক্ষেত্রে যেহেতু গ্রাহকের জমাকৃত অর্থ সংরক্ষিত থাকে এবং মেয়াদ শেষে যেহেতু গ্রাহক তার অর্থ অবশ্যই ফেরত পায় তাই এখানে অর্থ হারানো বা লসের কোন আশংকা নেই। এজন্য মানুষ এর প্রতি বেশী আগ্রহ দেখাচ্ছে।
বিমা কোম্পানির পরিচয়ঃ- উপরিউক্ত আলোচনার পর বিমা কোম্পানির পরিচয় বা ধরণ জেনে নেওয়াটাও জরুরী বলে মনে হয়। কেননা ইতিপূর্বে আমরা জেনেছি বিমার সূচনা হয়েছিল পারস্পরিক সহায়তার উপর। সে সূত্রে বুঝা যায় বিমা কোম্পানি উদ্দেশ্য কেবল মুনাফা অর্জনই ছিল না বা নয়। সকল বিমা কোম্পানির উদ্দেশ্য এক নয়। এজন্য বিমা কোম্পানির পরিচয় জানার পর তাদের প্রকারভেদ জানাও জরুরী। বিমা কোম্পানির পরিচয় তো অনেকটা জানা গেছে বিমার সংজ্ঞা আলোচনায়। এক কথায় এভাবেও বুঝানো যায় যে, বিমা সুবিধা যে কোম্পানি বা সংস্থা প্রদান করে থাকে তাকে বিমা কোম্পানি বলা হয়। বিমা কোম্পানি সাধারণত তিন প্রকারের হয়ে থাকে। ১. সংঘবদ্ধ বিমা (Group Insurance)
২. সহায়তামূলক বিমা (Mutual Insurance)
৩. ব্যবসায়িক বিমা (Commercial Insurance)
১. গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স অর্থাৎ সংঘবদ্ধ বিমা যাকে আরবীতে বলা হয় التأمين الاجتماعي এর পদ্ধতি হলঃ- কোন এক ধরণের পেশায় নিয়জিত বা কোন এক প্রতিষ্ঠানের কর্মরত লোকদের আয়ের একাংশ মাসিক প্রিমিয়াম হিসেবে জমা করা হয়। উদ্দেশ্য থাকে - এ প্রতিষ্ঠানের কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী ঘটনা-দুর্ঘটনার কবলে পড়লে এই ফাণ্ড থেকে তাকে সহায়তা প্রদান করা হবে। কোন কোন সরকারী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিদের জন্য সরকারী উদ্যোগে এরূপ গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স এর ব্যবস্থা রয়েছে। কোন কর্মচারীর আকস্মিক মৃত্যু হলে তার উত্তরাধিকারীদেরকে উক্ত ফাণ্ড থেকে মোটা অংকের অর্থ অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়। অথবা যদি কোন কর্মচারী দুর্ঘটনার শিকার হয় তাকেও গ্রুপ ইন্স্যুরেন্সের ফাণ্ড থেকে মোটা অংকের টাকা অনুদান দেওয়া হয়। তবে কাকে কী পরিমাণ টাকা পরিশোধ করবে তা উক্ত ব্যক্তির চাকরীর র্যাংক, মেয়াদকাল ইত্যাদির বিচারে ফাণ্ড পরিচালনা বোর্ড নির্ধারণ করে থাকে। যার পদবি মেয়াদকাল বেশি তাকে তুলনামূলক কম জনের চেয়ে বেশি অংকের টাকা পরিশোধ করা হয়। আজকাল সাধারণত এ ফাণ্ডের টাকা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদেরকে বিভিন্ন মেয়াদে সুদের উপর ঋণ প্রদান করা হয়ে থাকে।
২. মিউচুয়াল ইন্স্যুরেন্স (Mutual Insurance) অর্থাৎ পারস্পরিক সহযোগিতা বিমা। আরবীতে একে التأمين التعاوني বলা হয়। বিমার এই প্রকারের মধ্যে কোন ব্যবসা উদ্দেশ্য হয় না। বরং একে অপরের বিপদে এগিয়ে আসা ও দুর্ঘটনা কবলিত ব্যক্তিকে সহায়তা করাই মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে থাকে।
এর পদ্ধতি অনেকটা এরকম, কিছু লোক একত্রিত হয়ে একটা ফাণ্ড তৈরি করল। এই ফাণ্ডের উদ্দেশ্য হয় এমন যে, সদস্যদের কেউ কোন দুর্ঘটনায় পড়লে তাকে এ ফাণ্ড থেকে অনুদান প্রদান করা হবে। যেমন একশ জনে মিলে সহযোগিতা বিমা স্বরূপ সবাই ১ হাজার টাকা হারে এক লক্ষ টাকা সঞ্চয় জমা করল। অতঃপর তারা সকলেই মিলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে, আমাদের একশ সদস্যের কেউ কোন দুর্ঘটনার শিকার হলে এই ফাণ্ড থেকে তাকে অনুদান প্রদান করতঃ তার বিপদ দূর করতে সহযোগিতা করা হবে। কখনো এমন হয় যে বিপদের সংখ্যা বেশি হয় বা ধরণ অনেক বড় হয়। ফলে উক্ত ফাণ্ড দিয়ে যাবতীয় দুর্ঘটনায় অনুদান প্রদান করা সম্ভব হয় না। তখন ফান্ডের মেম্বার থেকে পূণরায় নির্দিষ্ট হারে চাঁদা উত্তোলন করা হয় এবং দুর্ঘটনার পূর্ণ সহায়তা প্রদান করতে চেষ্টা করা হয়। আবা কখনো এমন ঘটে যে, যাবতীয় দুর্ঘটনায় সহায়তা প্রদানের পরও ফাণ্ডের টাকা অবশিষ্ট থাকে। তখন বাকী টাকা সদস্যদের মাঝে বন্টন করা হয় বা পরবর্তি মেয়াদে বিমার জন্য চাঁদা স্বরূপ রেখে দেওয়া হয়। এখানে কোন ব্যবসা উদ্দেশ্য হয় না। একমাত্র উদ্দেশ্য হয় একে অপরকে সহায়তা প্রদান।
৩. কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স (Commercial Insurance) অর্থাৎ ব্যবসায়ী বিমা। আরবীতে যাকে التأمين التجاري বলা হয়। এখানে একটা কোম্পানি থাকে যা মূলত বিমার উদ্দেশ্যেই প্রতিষ্ঠিত করা হয়ে থাকে। এ কোম্পানির কর্মপদ্ধতি নিম্নরূপঃ-
বর্তমান বিশ্বে এক ধরণের বিশেষ পন্থার হিসেব পদ্ধতি রয়েছে। যাকে পরিভাষায় একচুয়ারী (Actuary) বলা হয়। এর মাধ্যমে এটা হিসেব করা হয় যে, একটা দেশে যে পরিমাণ প্রাকৃতিক অপ্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ঘটনার অবতারণা হয় মাধ্যমিকভাবে তার বাৎসরিক পরিমাণ কত হতে পারে? যেমন আমাদের বাংলাদেশে যে পরিমাণ প্রাকৃতিক অপ্রাকৃতিক দুর্ঘটনা ঘটে তার বাৎসরিক পরিমাণ কত? অর্থাৎ এক বছরে সাধারণত কত জায়গায় আগুন লাগতে পারে, এক বছরে কী পরিমাণে গাড়ী এক্সিডেন্ট হতে পারে, কত জায়গায় রেলগাড়ি লাইনচ্যুত হয়ে বা অন্যভাবে কী পরিমাণে ক্ষতি হতে পারে? কত জায়গায় জাহাজ ডুবি হতে পারে? কয়টি বিল্ডিংয়ে আগুন লাগতে পারে? কত জায়গায় ভূমিকম্প হয়ে কী পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে ইত্যাদি। এভাবে আগামী একবছরের যাবতীয় সম্ভাব্য দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতির হিসেব করার পর পূণরায় আরেকটি হিসেব কষা হয়। তা হল- আগামী এক বছরের যাবতীয় সম্ভাব্য দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে কী পরিমাণ অর্থ লাগবে? ধরা হোক যে, আগামী এক বছরের যাবতীয় সম্ভাব্য দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ আদায় প্রদান করতে প্রয়োজন ১০০ মিলিলিয়ন ডলার বা এক হাজার কোটি টাকা। এখন বিমা কোম্পানি এরূপ চিন্তা করবে যে, দশ হাজার কোটি টাকা খরচ করতঃ আগামী এক বছরের সম্ভাব্য দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হলে বিমা গ্রাহকদের থেকে কি পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করতে হবে, যার দ্বারা ক্ষতিপূরণ প্রদান করাও সম্ভব হবে এবং কোম্পানির নুন্যতম ৫০ কোটি টাকা লভ্যাংশ অবশিষ্ট থাকবে। এ হিসেব কষার পর বিমা কোম্পানি উক্ত দশ হাজার কোটি টাকা ও অতিরিক্ত ৫০ কোটি উসুলের জন্য মাসিক বা বাৎসরিক কিস্তি (Premium) নির্ধারণ করবে। যে ব্যক্তি উক্ত কোম্পানিতে বিমা করবে সে কোম্পানিকে নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ মাসিক বা বাৎসরিক প্রিমিয়াম পরিশোধ করবে। এভাবে সমস্ত টাকা উসুল হয়ে যাবে অর্থাৎ দশ হাজার কোটি টাকা ও অতিরিক্ত ৫০ কোটি টাকা একসময় কোম্পানির হাতে চলে আসবে। কোম্পানি সেই দশ হাজার কোটি টাকা দিয়ে এক বছরের সম্ভাব্য ক্ষতিপূরণ প্রদান করবে আর পঞ্চাশ কোটি তো লাভস্বরূপ কোম্পানির পকেটে আছেই। ব্যবসায়িক বিমা কোম্পানিগুলোর কর্মপদ্ধতির মোলিক অবকাঠামো এরূপই হয়ে থাকে। এসব বিমা কোম্পানি বিভিন্ন ধরণের স্কীম চালু করে থাকে। বিমার সাথে আরো ভালভাবে পরিচিত হওয়ার জন্যে বাংলাদেশের প্রশিদ্ধ এক বিমা কোম্পানির স্কীমগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলঃ-
০১. মেয়াদী বিমা : এটি জনসাধারণের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চয়তা বিধান করে। এই বিমার মেয়াদ দশ বছর থেকে ত্রিশ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে কোন ক্রমেই বিমা গ্রহীতার মেয়াদপূর্তি কালীন বয়স ৭০ বছরের বেশি হওয়া যাবে না। বিমার অংক সর্বনিম্ন ৩০ হাজার টাকা হতে হবে। ডাক্তারি পরিক্ষায় উন্নতমান শ্রেনীভুক্তদের বেলায় প্রবেশকালীন বয়স সর্বোচ্চ ৫৫ বছর পর্যন্ত শিথিলযোগ্য। অর্থাৎ ৫৫ বছরের ঊর্ধ্বে কোন ব্যক্তি এ বীমার গ্রাহক হতে পারবে না। মেয়াদ শেষে হ্রাসকৃত বীমা অংক বীমা গ্রহীতাকে লাভসহ প্রদান করা হবে। বিমা গ্রহীতার অকাল মৃত্যুতে হ্রাসকৃত বিমা অংক বিমা গ্রহীতার ওয়ারিস বা মনোনীত ব্যক্তি লাভসহ প্রদান করা হবে।
০২. হজ্ব বিমা এটি পবিত্র হজ্ব ও ওমরা পালন সুবিধার্থে করা হয়ে থাকে। এটি ১০, ১৫, ২০ বছর এর যেকোন এক মেয়াদে হতে পারে। এ প্রকল্পের অধীনে সর্বনিম্ন বীমা অংক এক লক্ষ টাকা মাত্র। মেয়াদ শেষে মুনাফাসহ বিরাট অংকের টাকা পাওয়া যায়।
০৩ পেনশন বিমা এটি জনসাধারণের অবসরকালীন জীবন স্বাচ্ছন্দ্য ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চয়তা বিধান করে। এই প্রকল্পে অবসরকালীন বয়স থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নির্দিষ্ট হারে পেনশন দেওয়া হয়। পেনশন শুরুর দশ বছরের মধ্যে যদি বিমা গ্রহীতা মৃত্যু বরণ করেন তবে তার ওয়ারিস বা মনোনীত ব্যক্তিকে দশ বছরের অবশিষ্ট সময়ের পেনশন প্রদান করা হয়।
০৪. দেনমোহর বিমাঃ- এটি সঞ্চয়ী বিমা প্রকল্প। এ প্রকল্পের গ্রাহক অবশ্যই পুরুষ হতে হবে এবং তার স্ত্রীই হবে একমাত্র নমিনী বা সুবিধাভোগী। দেনমোহরের টাকা ১০-২০ বছরের মেয়াদে নির্দিষ্ট হারে প্রিমিয়াম হিসেবে পরিশোধ করা হয়। বিমা অংকের পরিমাণ কমপক্ষে ত্রিশ হাজার টাকা। সম্পাদিত বিমা অংকের উপর প্রতি বছর আকর্ষণীয় হারে মুনাফা যোগ হয়। অন্যান্য সুবিধা তো রয়েছেই।
০৫. শিশু নিরাপত্তা বিমাঃ- এই বিমা পলিসি যৌথভাবে প্রিমিয়ামদাতা ও শিশুর জীবনের উপর গ্রহণ করা হয়। পিতা অথবা শিক্ষিত উপার্জনক্ষম মাতা শিশুর প্রিমিয়াম দাতা হবেন। পলিসি গ্রহণ করার সময় শিশুর বয়স সর্বোচ্চ ১৫ বছর এবং সর্বনিম্ন ৬ মাস হতে হবে। মেয়াদ শেষকালীন বয়স ১৮ বছর ও ২৫ বছরের বেশি হবে না। পলিসির মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর পূর্ব পর্যন্ত প্রতি বছর মূল বিমা অংকের শতকরা দশভাগ মেয়াদের শুরুতে সহায়ক বৃত্তি হিসেব অগ্রিম প্রদান করা হয়ে থাকে। আর মেয়াদ শেষে অর্জিত মুনাফাসহ বিমার পুরো টাকা প্রদান করা হয়ে থাকে। এ ছাড়াও রয়েছে এক কিস্তি বিমা, দুই কিস্তি বিমা, তিন কিস্তি বিমা, ইসলামী মানি ব্যাংক প্রকল্প, ইসলামী মেয়াদী প্রকল্প, শিশু শিক্ষা ও বিবাহ মেয়াদী বিমা, স্বামী স্ত্রী যুগল মেয়াদী বিমা ইত্যাদি।
বাংলাদেশে বিমাঃ- বিমা ক্রমবিকাশ লাভ করে ১৪০০ সাল থেকে। তবে উপমহাদেশে ১৯২৮ সালে (The Indian Insurance Company Act.) নামে সর্বপ্রথম বিমা আইন প্রণীত হয়। পরবর্তিতে ১৯৩৮ সালে তা সংশোধিত ও পরিমার্জিত হয়। এই আইন সর্বদা কার্যকর হত। এরপর ২০০৯ সালে বাংলাদেশে নতুনভাবে বিমা আইন প্রণয়ন করা হয় যা 'বিমা আইন - ২০০৯' নামে পরিচিত। দেশে বর্তমান ৬২ টির বেশি বিমা কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে দুটি সরকারী, বাকী অন্যান্যগুলি বেসরকারি। বাংলাদেশে জীবন বিমা কোম্পানি শুধু জীবন বিমার কাজ করে থাকে। বাকি অন্য সকল বিমা যেমন অগ্নি বিমা, নৌ বিমা ইত্যাদির জন্যে সাধারণ বিমা কোম্পানি কাজ করে থাকে। বেসরকারি খাতে বিমা কোম্পানি প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেওয়া হয় ১৯৮৪ সাল থেকে। বিমা কোম্পানিতে কাউকে মৃত বলে ঘোষণা দেওয়া হয় সাত বছর ধরে নিখোঁজ থাকলে।
বিমার উপকারিকা-অপকারিতাঃ- অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ দৃষ্টিতে বিমার অনেক সুফল পরিলক্ষিত হয়। আর এই দিকগুলোকেই বিমা কোম্পানি বা সাধারণত যারা বিমার পক্ষে কাজ করে তারা রংচং মাখিয়ে অত্যন্ত জোরেশোরে প্রচার করতে থাকে। বাহ্যত দৃষ্টিতে যদিও অর্থনীতিতে বিমার সুফল কিছুটা দেখা যায়, কিন্তু তা কেবল বিশেষ শ্রেণীর লোকদের জন্যে। অন্য দিকের বিরাট জনসাধারণ বিমার দ্বারা কেবলই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সামনে এর আলোচনা তুলে ধরা হবে ইনশাআল্লাহ! প্রথমে বিমার পক্ষে যারা সাফাই গায় তারা যেসব উপকারিতা বর্ণনা করে সেগুলো তুলে ধরা হলঃ-
১. নির্ভরতাঃ- বর্তমান বিশ্বের গরীব রাষ্ট্রসমূহে ১০ শতাংশেরও কম মানুষ স্বাবলম্বী জীবন যাপন করে। যাদেরকে উচ্চবিত্তের মানুষ বলা হয়। বাকী ৯০ শতাংশের বেশি মানুষই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিধির অন্তর্ভুক্ত। নিম্নবিত্তের কথা না হয় বাদই দিলাম দিলাম। যারা মধ্যবিত্তের আওতাভুক্ত রয়েছে তারাও বেশ ভালভাবেই জানে যে, মুদ্রাসংকটের এ সময়ে তাবৎ দুর্দিন আর দুর্যোগ মোকাবেলা করে ছয় সদস্যের একটি পরিবার কত ভাল করেই বা দিন গুজরান করে। এর মধ্য দিয়ে পুঁজি সঞ্চয় করে উন্নত জীবন অবলম্বনের পথে এগিয়ে যাওয়া কয়জনের ভাগ্যে জোটে। আবার পরিবারের উপার্জনক্ষম সদস্য যদি হয় একজন, ঘটনাক্রমে সেও যদি উপার্জন অক্ষম হয়ে পড়ে তাহলে কেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তা সহজেই অনুমেয়। এজন্যই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের কর্ণধারেরা খুঁজে ফেরেন নির্ভরতা। ছোট ছোট সন্তানের অভিভাবক চায় যে, আমার কোন অঘটন ঘটলে বা দুর্ঘটনা হলে আমার অনুপস্থিতিতে ছোট সন্তানেরা অন্যের সহায়তায় মানবেতর জীবন যাপন না করে। এজন্য সকলেই সকলেই তার ভবিষ্যত প্রজন্মের উন্নত জীবন কামনায় খুঁজে ফেরেন নির্ভরতা। বিমা মানুষকে সেই নির্ভরতাটাই প্রদান করে। বিমা পলিসিতে অংশ নেওয়ার পর মানুষ এতটুকু নির্ভরতা পায় যে, তার অবর্তমানে তার সন্তানগুলো একেবারে অন্ধকারে থাকবে না। বিমার টাকায় তাদের কোন না কোন ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বিমার কারণে মানুষ এই নির্ভরতা কেবল সন্তানের ভবিষ্যতের ক্ষেত্রেই পায় না। আরো অন্যান্য ক্ষেত্রেও মানুষ নির্ভরতা খুঁজে পায়। যেমন শিক্ষা বিমায় সন্তানদের লেখাপড়ার খরচের ব্যাপারে নিশ্চয়তা পাওয়া যায়। যার কিছুটা আলোচনা গত হয়েছে। শিশু নিরাপত্তা বিমায় শিশুর আর্থিক প্রয়োজন পূরণের নিশ্চয়তা ইত্যাদি।
২. পুঁজি গঠনে সহযোগিতাঃ- বিমার সুফলের মধ্যে এটাও বর্ণনা করা হয় যে, বিমার মাধ্যমে জনগণের নিকট বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পুঁজি একত্রিত হয়ে বৃহত্তর উৎপাদনী কাজে ব্যবহৃত হওয়ার জন্যে মূলধন হিসেবে মওজুদ হয়। আর এই মূলধন ব্যবহার করে বৃহতমানের উৎপাদনী উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব। যেমন একটা বিমা কোম্পানির নিকট থেকে উসূলকৃত প্রিমিয়ামের পরিমাণ ধরা হোক ১০ কোটি টাকা। এই দশ কোটি টাকা ক্ষুদ্রাকারে যখন হাজারো গ্রাহকের নিকট ছিল তখন সে বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র পুঁজির দ্বারা বৃহৎ আকারের কোন উৎপাদনী উদ্যোগ করা অসম্ভব ছিল। কিন্তু বিমা কোম্পানির মাধ্যমে হাজারো গ্রাহক থেকে সংগ্রহীত টাকার মাধ্যমে বড় কোন কিছু উৎপাদন করা সম্ভব। এতে দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধি লাভ করবে। মানুষ উপকৃত হবে। সামগ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধিত হবে।
৩. উৎপাদনী উপকরণসমূহ সচল থাকেঃ- অর্থাৎ কোন দেশের কারখানা অগ্নিদগ্ধ হয় বা অন্যকোন বিপর্যয়ের শিকার হয়, এমতাবস্থায় যদি কারখানার উদ্যোক্তার নিকট তা পূণঃপ্রতিষ্ঠার ও মেরামত করার পুঁজি না থাকে তখন কারখানাটি অচল হয়ে পড়ে এবং উৎপাদনী উপকরণ নিশ্চল ও স্থবির হয়ে যায়। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হয়। এর প্রভাব পড়ে জনসাধারণের মাঝে। কিন্তু উক্ত কোম্পানির বিমা করা থাকলে বিমা কোম্পানি কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষতিপূরণবাবদ অর্থ দ্বারা কারখানাটি পূণরায় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। তার উৎপাদনী কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। ফলে জনগণের মাঝে তেমন কোন বিরূপ প্রভাব পড়ে না।
৪. অধিক বিনিয়োগে আগ্রহী করা ও বিপদাপদে নির্ভরতা দেওয়াঃ- অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর মাঝে এই আশংকা আর উৎকণ্ঠা থাকে যে, কখনো তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন লেগে বা অন্যকোন কারণে তার বিনিয়োগ প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যার পরিণতিতে তাকে সর্বস্ব হারিয়ে অসহায়ের দিন কাটাতে হতে পারে। এজন্য বিনিয়োগকারীরা নিশ্চিন্ত মন নিয়ে সর্বাধিক পুঁজি দিয়ে বিনিয়োগ করতে তেমন আগ্রহী হয় না। এক্ষেত্রে বিনিয়োগ প্রকল্পের বিমা করা থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পথে বসার উৎকণ্ঠা থেকে বিনিয়োগকারী বেঁচে থাকতে পারে। ফলে সে নিশ্চিন্ত মনে যেকোন খাতে সর্বাধিক পুঁজি বিনিয়োগ করতে উৎসাহী হয়। কেননা ক্ষতিগ্রস্থ হলে বিমা কোম্পানি তো ক্ষতিপূরণ দিতে দায়বদ্ধ আছেই।
৫. মুদ্রামান নিয়ন্ত্রণঃ- কোন দেশে যখন মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় তখন মানুষের হাতে টাকা বেশি থাকে। এ সময় যদি তারা অতিরিক্ত টাকা বিমার উদ্দেশ্যে জমা করে তাহলে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পায়। আবার যখন মুদ্রাসংকট দেখা দেয় তখন মানুষের হাতে টাকা কম থাকে। এসময় বিমা কোম্পানি মানুষকে ঋণ সরবারহ করে। ফলে মুদ্রাসংকট হ্রাস পায়। এভাবে বিমার মাধ্যমে একটি দেশের মুদ্রামান নিয়ন্ত্রিত থাকে। অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা পায়।
৫. পূর্ণ নিশ্চয়তা ও গ্যারান্টিঃ- অনেক সময় এমন হয় যে, কোন প্রতিষ্ঠানকে কেউ ঋণ দিতে চায় না। এমনকি সুদের ভিত্তিতেও সে প্রতিষ্ঠানকে কেউ ঋণ দিতে ততক্ষণ পর্যন্ত রাজি হয় না যতক্ষণ না ঋণ ফিরে পাওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। এই নিশ্চয়তার জন্যে ঋণ গ্রহীতা থেকে অন্যকোন সম্পদ বন্ধক রাখা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটি সমস্যা দেখা দেয়। তা হল - ঋণগ্রহীতা থেকে গ্রহণকৃত বন্ধকী বস্তু ঋণদাতার নিকট রক্ষিত অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা ধ্বংস হলে ঋণদাতাকেই বহন করতে হবে। ফলে বন্ধকী রাখাও নিরাপদ মনে করা হয় না। কিন্তু যদি যে দ্রব্য বন্ধক রাখা হবে যদি তার বিমা করা থাকে তাহলে তা বন্ধক হিসেবে গ্রহণ করতে ঋণদাতার কোন দ্বিধান্বিত ভাব থাকে না। নিশ্চিন্ত মনে বন্ধকী রেখে ঋণ প্রদান করা যায়। এভাবে বিমার মাধ্যমে সকল ক্ষেত্রে অধিক নিশ্চয়তা লাভ করা যায়।
৭. সার্বজনীন নিরাপত্তাঃ- বিমা সব শ্রেণীর মানুষের জন্যেই নিরাপত্তার প্রতীক হয়ে থাকে। কেননা শিল্পপতি তার শিল্পের বিমা করে নিশ্চিন্ত মনে উৎপাদন করতে পারে। পুঁজি বিনিয়োগকারীও তার বিনিয়োগকৃত পুঁজি আকস্মিক ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ভাবনা থেকে নিরাপত্তা লাভ করে। পণ্যের বিমা করা থাকলে ক্রেতা-বিক্রেতারা নিরাপদে ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে। শ্রমিক ও কর্মচারীদের বিমা করা থাকলে ভাবনাহীন মনে শ্রম দিয়ে যেতে পারে। এভাবে বিমার মাধ্যমে সকল শ্রেণীর মানুষ ভাবনাহীন নিরাপত্তার জীবন লাভ করতে পারে।
বিমার অপকারীতাঃ- বিমার এমন উপকারিতা জানার পর মনে হয় যে বিমা শুধু কল্যাণ আর উপকারিতাই বয়ে আনে। বিমায় হয়তো কোন কুফল নেই। কিন্তু না! বিষয়টা মোটেও তেমন না। বাহ্যত নজরে বিমার অর্থনৈতিক কিছু সুফল আছে বলে মনে হলেও বিমার কুফল অনেক বেশি মারাত্মক। বিমার বাস্তবতা সম্পর্কে যারা জ্ঞান রাখে তারা ভালভাবেই জানেন এর কারণে কী পরিমাণে ক্ষতি হতে পারে বা হচ্ছে। অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদরা বিমার যেসব অপকারীতা বর্ণনা করেন তার কিছু নিম্নে বর্ণিত হলঃ-
১. দ্বীনি ক্ষতিঃ- সর্বপ্রথম আলোচনায় আসে ধর্মীয় বিষয়। যেমনঃ-
(ক) সুদী কারবারে লিপ্ত হওয়া। সাধারণত ব্যবসায়ী বিমাসমূহে সুদী প্রক্রিয়া অবলম্বন হতে থাকে। ব্যবসায়ী বিমাতে সঞ্চিত অর্থ থেকে গ্রাহককে ঋণ প্রদান করা হয় আর গ্রাহক সেই ঋণ পরিশোধ করে সুদসহ। তথ্যানুসন্ধান করে দেখা যায় বর্তমানে সব বিমা কোম্পানি যাদের উদ্দেশ্য থাকে মুনাফা অর্জন, তারা কোন না কোন ভাবে সুদী কারবারের সাথে সংযুক্ত। এভাবে সুদী লেনদেনের সাথে জড়িত থাকা বিমা কোম্পানির পলিসি গ্রহণ করা প্রকারান্তরে সুদী লেনদেনে জড়িয়ে পড়ার মতই। আর সুদী লেনদেনে জড়িত থাকা বাহ্যিকভাবে যত লাভজনকঈ হোক না কেন, এর অর্থ হল হারামে লিপ্ত হওয়া। আর আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হওয়ার ক্ষতি বহুমুখী। দুনিয়ার বরকত থেকে বঞ্চিত হওয়া, বিপদাপদে জড়িয়ে পড়া, লাঞ্ছনা ও বিড়ম্বনার শিকার হওয়া ও পরকালে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হওয়া। উপরোল্লিখিত নিশ্চিত ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে থেকে "ক্ষতি হতে পারে" এই আশংকা নিয়ে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে জীবন পথ পাড়ি দেওয়া একজন মুমিনের নিকট অধিক শ্রেয়।
(খ) জুয়ায় লিপ্ত হওয়া। জুয়া বলা হয় এমন লেনদেনেকে যাতে এক পক্ষের ক্ষতির উপর অপর পক্ষের লাভ বা লোকসান হওয়া নির্ভর করে। বিমা মূলত সে ধরণেরই একটি চুক্তি। কেননা এ দ্বারা কোন সময় বিমা গ্রহীতা জিতে যায় আবার কোন সময় বিমা কোম্পানি জিতে যায়। সুতরাং এটি নিষিদ্ধ জুয়ার অন্তর্ভুক্ত। আর জুয়ার দ্বারা অর্থনৈতিক ও সামাজিক কী কী ক্ষতি হয় তার সামান্য কিছু উল্লেখ করা হলঃ-
১. জুয়ার দ্বারা একদল সম্পদ খোয়াতে খোয়াতে পথের ফকির হয়ে যায় আর অন্যদল আঙ্গুল ফুলে কলা হয়ে যায়। এতে করে সম্পদ কিছু লোকের হাতে বাজেয়াপ্ত ও কুক্ষিগত হতে থাকে। যা অর্থনৈতিক ভারসাম্যকে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করে।
২. জুয়ারি সর্বস্ব হারানোর পর কুল কিনারা না পেয়ে চুরি ডাকাতির ন্যায় জঘন্য কাজ করে সামাজিক নিরাপত্তা ও শৃংখলাকে বিঘ্নিত করে। আর এ পথে না বাড়লেও একজন জুয়ারি পরনির্ভর হয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে।
৩. জুয়ার মাধ্যমে পরস্পরে ঝগড়া বিবাদ আত্মকলহ মারামারি ও হত্যাকাণ্ডের ন্যায় জঘন্য অপরাধ সংঘটিত হয়।
৪. জুয়ারির অন্তরে অন্যের ক্ষতি করে নিজে লাভবান হওয়ার লালসা সর্বদা জাগরূক থাকে। এই লালসা তাকে অন্যায় পন্থা অবলম্বন করতে উৎসাহিত করে।
৫. জুয়ার মাধ্যমে পারস্পরিক সংবেদনশীলতা, ভদ্রতা ও ন্যায় নিষ্ঠা ধ্বংস হয়ে যায়। অপরের কল্যাণকামিতার মনোবৃত্তি নিঃশেষ হয়ে যায়।
৬. জুয়ারি ভাগ্যক্রমে সম্পদ পেয়ে গেলে সে সম্পদ দ্বারা ভাল কোন কার্য সম্পাদনে সক্ষম হয় না। সৎ কাজে তার সম্পদ ব্যয়িত হয় না। জুয়া থেকে অর্জিত সম্পদ হয়ত আবার জুয়ায় লাগায় বা সে সম্পদ অপচয় করতঃ যাবতীয় গুনাহের কাজে ব্যয় করা হয়। এক্ষেত্রে সম্পদ অপচয়ের গুনাহের সাথে সাথে অন্যান্য গুনাহের কাজও সংঘটিত হয়।
(জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া ৩/২৭)
উপরোল্লিখিত ক্ষতি ছাড়াও আরো ক্ষতি রয়েছে যা সামাজিক ও অনৈতিকতার জন্য মারাত্মক ধ্বংসাত্মক পরিণাম বয়ে আনে। তাছাড়া জুয়া অবৈধ ও হারাম হওয়ার ব্যাপারে কুরআনুল কারীমে একাধিক আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে। মহান রাব্বুল আলামীন সূরায়ে বাক্বারাতে ইরশাদ করেনঃ-
يسئلونك عن الخمر والميسر قل فيهما اثم كبير و منافع للناس واثمهما اكبر من نفعهما
﴿ سورة البقرة - ٢١٨ ﴾
অর্থঃ- তারা আপনার কাছে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। আপনি বলে দিন যে এ দুটোর মাঝে বিরাট পাপ নিহিত আছে। আর যৎসামান্য উপকার রয়েছে। তবে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণই বেশি। (সূরায়ে বাক্বারাহ, আয়াত নং ২১৮)
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছেঃ-
انما يريد الشيطان أن يوقع بينكم العداوة والبغضاء في الخمر و الميسر و يصدكم عن ذكر الله وعن الصلاة فهل انتم منتهون ﴿ سورة المائدة - ٩٠ ﴾
অর্থঃ- নিশ্চয় শয়তান শরাব ও জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের মাঝে শত্রুতা ও ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়াতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ও নামায থেকে বিরত রাখতে চায়। সুতরাং তোমরা কি বিরত থাকবে? (সূরায়ে মায়েদা, আয়াত নং ৯০)
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে,
انما الخمر والميسر والانصاب والازلام رجس من عمل الشيطان فاجتنبوه
অর্থঃ নিশ্চয় শরাব, জুয়া, ভাগ্য নির্ধারক শর অপবিত্র এবং শয়তানের কাজ। অতএব তোমরা তা থেকে বিরত থাক।
(গ) প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া। বিমার প্রচারণা থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে অসংখ্য প্রতারণা বিদ্যমান। বিমার প্রচারকরা সকল ক্ষেত্রের সম্ভাব্য আশংকাগুলো এমনভাবে তুলে ধরে যে সে বিপদ আসবেই। আর তা থেকে আত্মরক্ষার জন্য এখনি প্রস্তুতি গ্রহণ করা অতিব প্রয়োজন। আগে থেকে আত্মরক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ না করা হলে বিপদে ধ্বংস হওয়া সুনিশ্চিত বা সহায় সম্বল হারিয়ে অবশ্যই অবশ্যই পথের ভিখারি হতে হবে। তাদের এই মিথ্যা প্রচারণার ফাঁদে পড়ে মানুষ বিমা কোম্পানিকে টাকা দেয়। অথচ বাস্তব জীবনে সেই আশংকা বা বিপদ কখনোই আসে না।
বিমা কোম্পানির প্রচারকরা এভাবে কথা বলে যেন বিমা গ্রহীতা ক্ষতিগ্রস্থ হলেই ঘরে বসে ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়ে যাবে। অথচ বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিমা কোম্পানি থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে গিয়ে দেখা যায় যে, সেখানে এমন শর্তের মারপ্যাঁচ রয়েছে যে, সেই মারপ্যাঁচ উৎরে খুব কম লোকই ক্ষতিপূরণ পেয়ে থাকে। আবার বর্তমান যুগ তো ঘুষের স্বর্ণালী কাল। বলা হয়ে থাকে ঘুষ বিনে এক টেবিলের ফাইল অন্য টেবিলে যাওয়া তো দূরের কথা, নড়ে না পর্যন্ত। সুতরাং দুর্ঘটনায় যে মারা গেল তার এতিম ছোট বাচ্চারা উৎকোচের বিশাল অংক কোত্থেকে সংগ্রহ করবে। অতঃপর বাবার বিমার টাকা হাতে পাবে। তেমনিভাবে আগুন লেগে যার জীবনের সমস্ত সঞ্চয় নষ্ট হয়ে তার জন্যে উৎকোচ সংগ্রহ করাটা 'মরার উপর খারার ঘা' প্রবাদের বাস্তব প্রতিফলন নয় কি? এতশত ঝামেলার দেওয়াল টপকে তারপর বিমা গ্রহীতার সফলতা হাতে পায়।
তাছাড়া ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণের টাকা যাতে না দিতে হয় সে জন্যে বিমা কোম্পানি বিভিন্ন প্রতারণা ও ছলচাতুরী ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে থাকে। অপরদিকে যারা বিমা করে, বিমা কোম্পানি থেকে টাকা আদায়ের জন্যে তারাও বিভিন্ন ধরণের ধোঁকা ও প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। এজন্য বিমার উভয় দিকের কোনটাই প্রতারণা থেকে মুক্ত নয়।
২. অর্থনৈতিক ক্ষতিঃ- বিমার দ্বীনি ক্ষতি যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে অর্থনৈতিক ক্ষতিও। নিম্নে তার কয়েকটা আলোচনা করা হলঃ-
(ক) সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে পড়াঃ- বিমার দ্বারা সম্পদ গুটিকতক ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। আর সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে পড়লে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে ব্যাপক বিপর্যয় দেখা দেয়। অন্য সকলকে এর জের বহন করতে হয়। একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টা আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। ধরা যাক একটি দেশের মোট জনসংখ্যা ১০০ জন। সে দেশের মোট সম্পদের পরিমাণ ১০০০০ (দশ হাজার) টাকা। অতএব সাধারণ অবস্থায় মাথাপিছু সম্পদের পরিমাণ দাঁড়াবে ১০০ টাকা। কিন্তু যদি সে দেশের দশ জন লোকের প্রত্যেকেই ৫০০ টাকা করে নিজ নিজ তহবিলে সঞ্চিত করে ফেলে তাহলে এই দশ জনের হাতে কুক্ষিগত সম্পদের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০০০ টাকা। ফলে তাদের মাথাপিছু সম্পদের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫০০ টাকা আর বাকী নব্বই জন লোকের হাতে থাকবে অবশিষ্ট ৫০০০ টাকা। ফলে এদের মাথাপিছু সম্পদের পরিমাণ হবে ৫৫.৫৫ টাকা। মাথাপিছু সম্পদের পরিমাণ নেমে আসবে অর্ধেকের কাছাকাছি। এখন উক্ত দশজন যদি সম্পদ কুক্ষিগত করেই রাখে তাহলে দেশের অন্যান্য জনগণ যথাপ্রাপ্যের অর্ধেক সম্পদ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে বাধ্য হবে। এতে করে একটি দেশের নব্বই শতাংশ লোক তাদের নূন্যতম চাহিদা পূরণ করতে হিমশিম খাবে। সুতরাং সম্পদ পুঞ্জিভূত হওয়ার দ্বারা বিমার কুফল একদম সুস্পষ্ট। এভাবে সম্পদ কুক্ষিগত করার দ্বারা মানুষ ধনী ও গরীব দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়বে আর ধনীদের যাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে অভাবীরা তাদের গোলামে পরিণত হতে বাধ্য হবে।
(খ) বিমা বিনিময়হীন শোষণঃ- যারা বিমা করে তারা অর্থনৈতিক দিক থেকে মারাত্মকভাবে শোষিত হয়। বিমা করে লাভবান হয়েছে এমন লোকের সংখ্যা খুবই নগণ্য। যে সম্ভাব্য ক্ষতির আশংকায় বিমা কোম্পানিতে মানুষ টাকা জমায় সে ক্ষতির দশ ভাগও সংঘটিত হয় না। আর যদিও মানা হয় যে দশভাগ ক্ষতি অবশ্যই হয় তাহলে বলা হবে যে, শুধু এই দশ ভাগ লোকই ক্ষতিপূরণ হিসেবে অর্থ পাচ্ছে। বাকি নব্বই শতাংশ লোকের টাকা বিমা কোম্পানি কোনরূপ বিনিময় ছাড়াই শুধু বিপদের আশংকা দেখিয়েই হাতিয়ে নিচ্ছে। এটাও এক এধরণের ডাকাতি। ডাকাতরা অস্ত্রের ভয় দেখি মানুষের পকেটের টাকা হাতিয়ে নেয় আর বিমা কোম্পানি বিপদের আশংকা আছে এই ভয় দেখিয়ে মানুষের পকেট খালি করে। যদি সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষার জন্যে কথাই চিন্তা হয় তাহলে টাকা বিমা কোম্পানিকে না দিয়ে নিজের কাছে রেখেও সম্ভাব্য ক্ষতির মোকাবেলা করতে পারে। উপরোন্তু এই টাকা ব্যবসায় লাগিয়ে নিজে অধিকহারে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
(গ) বিমা সর্বগ্রাসী শোষণঃ- বিমা কোম্পানিগুলো জমাকৃত টাকা উচ্চসূদে উদ্যোক্তাদেরকে ঋণ দেয়। সুদের ভিত্তিতে ঋণ নিয়ে ব্যবসায়ীরা পণ্য উৎপানের পর তারা উৎপাদন ব্যায়ের সাথে সুদ ও লাভ দুটোই যোগ করে পণ্য বাজারজাত করে আর এই পণ্য ক্রয় করে সুদের ভর্তুকি দেয় দেশের জনগণ। সহজে বুঝার জন্যে একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরা হোক একটি সাবান কারখানার প্রতি সাবানের উৎপানে খরচ হয় ১৫ টাকা। কোম্পানিটি ব্যাবসা করার জন্যে যে ঋণ গ্রহণ করেছিল তার সুদ পরিশোধ করার জন্যে ১ টাকা মূল্য বৃদ্ধি করা হল। এখন সাবান প্রতি উৎপাদনী খরচ দাঁড়াল ১৬ টাকা। এবার কোম্পানি সাবান প্রতি এক টাকা লাভে বাজারে সাবান সেল করলে। এই সাবান খুচরা বিক্রেতা হাতে যখন পৌঁছল তখন তার মূল্য দাঁড়াল ১৭ টাকা। এখন জনসাধারণ উক্ত সাবান ক্রয় করবে নূন্যতম ১৮ টাকা দিয়ে। এখানে লক্ষণীয় হল এই যে, ১৮ টাকার মধ্যে ১ টাকা হল সুদের মাসুল যা গ্রহণ করেছিল ব্যবসায়ী, কিন্তু তার ভর্তুকি দিচ্ছে দেশের জনসাধারণ। এভাবে বিমার মাধ্যমে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ শোষিত হচ্ছে।
(ঘ) বিমার দ্বারা সম্পদ ধ্বংসের প্রবণতা বাড়েঃ- যারা বিমা করে তাদের অনেকেই বিমা কোম্পানি থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করার উদ্দেশ্যে বিমাকৃত দ্রব্য ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করে থাকে। অর্থাৎ যখন বিমাকৃত দ্রব্যটি বাজারে অচল হয়ে যায়, কিংবা তার স্বাভাবিক মেয়াদ উত্তির্ণ হয়ে যায় অথবা তাতে কোন প্রকারের ত্রুটি দেখা দেয়, তখন অনেকেই সে দ্রব্যটি এই উদ্দেশ্যে ধ্বংস করে দেয় যে, বিমা কোম্পানি থেকে তার ক্ষতিপূরণ আদায় করে নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করা যাবে। এর জন্যে লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। আবার অনেক সময় গুদামে অল্প মালামাল রেখে নিজেই আগুন ধরিয়ে দিয়ে অধিক পরিমাণে পণ্য ছিল বলে দাবি করে। এভাবে বিমা কোম্পানি থেকে অধিক পরিমাণে ক্ষতিপূরণ আদায় করার চেষ্টা করে। এভাবে দেশের অনেক সম্পদ অকারণে ধ্বংস হয়। সম্পদ ধ্বংসের এই প্রবণতা দেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে।
(ঙ) বিমা বাধ্যবাধকতার কারণে উৎপাদনী উদ্যোগ ব্যাহত হয়। পৃথিবীর অনেক দেশেই আজকাল ব্যবসা বা কারিগরি প্রতিষ্ঠানে বিমা করা বাধ্যতামূলক। বিমা না করলে সরকারীভাবে অনুমোদন দেওয়া হয় না। আবার বিমার ঝামেলাও কম নয়। একদিকে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে বিপুল মূলধনের প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে বিমা করতেও প্রায় সমপরিমাণ অর্থ বিমা কোম্পানিকে জমা দিতে হয়। ফলে এটা উদ্যোক্তাদের উপর অনেক সময় বোঝা হয়ে যায়। বিশেষতঃ ক্ষুদ্র পুঁজির মালিকদের বেলায় এই সমস্যা বেশি হয়ে থাকে। ফলে ঐসব ব্যক্তিদের উৎপাদনী উদ্যোগের অর্থনৈতিক সুফল থেকে দেশ বঞ্চিত থাকে। এভাবে বিমার বাধ্যবাধকতার কারণে উৎপাদনী উদ্যোগ ব্যাহত হয়।
(চ) সম্পদ সংরক্ষন ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়। মানুষ স্বভাবজাত তাড়নায় নিজের সম্পদ সংরক্ষণের জন্য চুড়ান্ত ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। কিন্তু যখন দ্রব্যের বিপরীতে বিমা করা থাকে তখন মানুষ নিজের সম্পদ সংরক্ষণের তাগিদ নিজের মাঝে অনুভব করে না। কারণ ধ্বংস হয়ে গেলে তার পরিবর্তে ক্ষতিপূরণ তো পাবেই। এতে করে সম্পদ সংরক্ষণের ব্যবস্থা শিথিল হয়ে পড়ে।
(ছ) আন্তর্জাতিক ক্ষতিঃ- বিমার ফলে আন্তর্জাতিক শোষণ ব্যাপিত হয়। কারণ বিমা না হলে কোন দেশ রপ্তানি প্রক্রিয়া সম্পাদন করে না। ফলে আমদানিকারক দেশগুলো বাধ্য হয়েই বিমা করতঃ আমদানি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। এভাবে বিমার মাধ্যমে রপ্তানিকারক দেশসমূহ আমদানিকারক দেশগুলোকে শোষণ করতে থাকে। যেমনঃ- বাংলাদেশ জাপান থেকে সমুদ্রপথে মোটরসাইকেল আমদানি করতে ইচ্ছুক। কিন্তু জাপানি কোম্পানি বিমা করা ছাড়া বাংলাদেশে মোটরসাইকেল রপ্তানি করবে না। এখন বাধ্য হয়েই বাংলাদেশী কোম্পানিকে প্রথমে বিপুল অর্থ খরচ করে বিমা করতে হবে। তারপর আমদানি করতে হবে। এভাবেই আন্তর্জাতিকভাবে বিমার কারণে আমদানিকারক দেশগুলো ব্যাপক শোষিত হয়।
৩. বিমার নৈতিক ক্ষতিঃ- বিমার ক্ষতি কেবল দ্বীনি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। নৈতিক ক্ষেত্রেও বিমার ভয়াবহতা মারাত্মক। তার দু একটা দিক তুলে ধরা হলঃ-
(ক) খুনখারাবির প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। বিমা মানুষকে খুন ও হত্যার ন্যায় মারাত্মক অপরাধে উৎসাহিত করে। বিমাকারীর ওয়ারিস বা বিমাকারীর যাকে নমিনী নিযুক্ত করে, সে নমিনী বা ওয়ারিস ততক্ষণ বিমা টাকার মালিক হয় না যতক্ষণ খোদ বিমাকারী জীবিত থাকে। অনেক সময় টাকার লোভ ও সম্পদের নেশায় মানুষ এতটাই কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে যায় যে, সন্তান বাবাকে হত্যা করে বিমা থেকে বিপুল অর্থ পাওয়ার লোভে। স্বামী স্ত্রীকে হত্যা করে স্ত্রীর বিমাকৃত অর্থ পাওয়ার নেশায়। স্বামীর বিমার টাকা পাওয়ার লালসায় স্ত্রী স্বামীকে বিষ খাইয়ে হত্যা করে। এভাবে মানুষ একজন আরেকজনকে হত্যা করে বা একজন আরেকজনের মৃত্যু কামনায় প্রহর গুণতে থাকে। অনেকে বিমা কোম্পানিকে নিশ্চিত করার জন্যে লোকজন সহকারেই গুদামে আগুন ধরিয়ে দেয়। কাপ্তান ও মাঝিমাল্লাসহ মালবাহী জাহাজ সমুদ্রে ডুবিয়ে দেয়। এভাবে মানুষ হত্যার প্রবণতা বাড়ে। সম্পদের নেশা মানুষের মমত্ববোধকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। মানুষকে হিংস্র দানবে পরিণত করে। এগুলো কেবল এখন আশংকা নয়। উন্নত বিশ্বে যেখানে বিমার ব্যাপক প্রচলন রয়েছে সেখানে অহরহ ঘটছে এধরণের ঘটনা। বাংলাদেশেও সাম্প্রতিককালে সন্তানের হাতে পিতামাতা হত্যার ঘটনা এবং স্বামীর হাতে স্ত্রীর হত্যা, স্ত্রীর হাতে স্বামী হত্যা হওয়ার ঘটনা সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রকাশ পাচ্ছে।
(খ) অন্যের প্রাপ্য হক নষ্ট করার প্রবণতা বৃদ্ধি হওয়া। বিমা কোম্পানির নিকট যখন কেউ বিমাকৃত দ্রব্যের ক্ষতিপূরণ দাবি করে, তখন বিমা কোম্পানি সম্ভাব্য সকল পন্থায় চেষ্টা করে যেন ক্ষতিপূরণের টাকা না দিতে হয়। এজন্য যারা দুর্ঘটনা তদন্ত করে বা যে ডাক্তার পরিক্ষা নিরিক্ষা করে; কিংবা যে বিচারক এর ফয়সালা করেন, তাদেরকে ঘুষ দিয়ে হলেও ক্ষতিপূরণ চাওয়ার দাবি অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করা হয়। অনুরূপ প্রচেষ্টা বিমাকারীর পক্ষ থেকেও হয়ে থাকে। এভাবে একে অপরের হক বিনষ্ট করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
৪. বিমার সামাজিক ক্ষতিঃ- বিমার কারণে সামাজিক অনেক ক্ষতি সাধিত হয়। নিম্নে তার দুএকটি বর্ণনা করা হলঃ-
(ক) বিমা মানুষকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উৎকণ্ঠায় ফেলে দেয়। ভবিষ্যতের উৎকণ্ঠা মানুষের কর্মোদ্যোগে জটিলতা সৃষ্টি করে। অথচ ভবিষ্যতে কী ঘটবে মানুষ তা আদৌ জানে না। এজন্য আল্লাহর উপর পরম নির্ভরশীলতায় সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে মানুষকে কর্মোদ্যোগী হতে হবে। ইসলামের শিক্ষা এমনি। কখনো কোন দুর্ঘটনা ঘটে গেলে তা তাকদীরের উপর হাওয়ালা করে নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাবে এবং ভবিষ্যৎ গড়ার চেষ্টা করবে। এটাই তো স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু বিমা কোম্পানির প্রচারকরা তাদের প্রচারণার দ্বারা মানুষের খোদা নির্ভর তাওয়াক্কুল ও বিশ্বাসকে ভেঙ্গে দিয়ে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অহেতুক উৎকণ্ঠায় ফেলে দেয়। এই উৎকণ্ঠা সামগ্রিক জীবনে মারাত্মক অশুভ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। মানুষ জীবন যাপন করে সম্ভাব্য বিপদের শংকা নিয়ে। এভাবে মানুষ আর নির্ভরতা খুঁজে পায় না। সদা সর্বদা উদ্বেগ আর টেনশনের মাঝে সময় কাটাতে হয়। এতে জীবনের প্রশান্তি মারাত্মকভাবে বিপন্ন হয়।
(খ) জীবন সংগ্রামের মুখোমুখি হওয়ার শক্তি বিলুপ্ত হয়। জীবন সংগ্রামের মুখোমুখি হয়ে ঝুঁকি গ্রহণ করে অগ্রসর হওয়ার যে আত্মশক্তি মানুষকে সংকট কেটে অগ্রসর হতে সাহায্য করে বিমার কারণে সে শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। ফলে ঝুঁকি নিয়ে মানবতার কল্যাণে মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করার শক্তি ও সাহস মানুষের মন থেকে হারিয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে বিমাকারী পরনির্ভরশীল অলস জীবন যাপন করতে চায়। আত্মনির্ভরশীল হতে সাহস পায় না।
(গ) সামাজিক প্রীতি বন্ধন বিনষ্ট হয়। সমাজের মানুষ পরস্পরে সহযোগিতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়। জীবন চলার ক্ষেত্রে একজন অপরজনের উপর নির্ভর হয়ে থাকে। এভাবে পরস্পরের মাঝে গভীর প্রীতি বন্ধন গড়ে ওঠে। কিন্তু বিমাকারীরা চরম পরনির্ভরশীল হয়েও নিজেকে স্বাবলম্বী মনে করে। ফলে তারা অন্যের সহযোগিতার প্রয়োজন অনুভব করে না। আর অন্যকে সহযোগিতা করা আগ্রহও নিজেদের মাঝে খুঁজে পায় না। ফলে স্বাভাবিকভাবে সমাজের মানুষের মাঝে প্রীতি বন্ধনের সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়।
বিমার শরয়ী বিধান
ইসলাম মানুষের জন্যে পূর্ণাঙ্গ হেদায়াত এবং সার্বজনীন জীবন ব্যবস্থা। পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সর্বকালের মানুষই ইসলামের মাঝে খুঁজে পাবে তাদের জীবনের নানাবিধ সমস্যার উপযুক্ত সমাধান। মহান আল্লাহ তায়ালার বাণী পবিত্র কুরআন ও তার ব্যাখ্যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস গবেষণায় সর্বযুগের সমকালীন দ্বীনি সমস্যার সমাধান প্রদান করা সম্ভব। মহান আল্লাহ তায়ালা এভাবেই ইসলামের নীতিমালাকে প্রণীত করেছেন ও সাজিয়েছেন। ইসলামী শরীয়তের প্রত্যেক যুগে এমন কিছু আলেম এবং ইমাম মুজতাহিদকে আল্লাহ তায়ালা তৈরি করেছেন যারা কুরআন হাদীসের আলোকে তৎকালীন যুগের ধর্মীয় সমস্যার সমাধানে সচেষ্ট থাকেন। ইমামদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ যুগের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন। যুগের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন মাসয়ালার সমাধানের জন্যে তিনি একটি ফিকহী বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেখানে বিভিন্ন জ্ঞানে অভিজ্ঞ আলেমদেরকে সমন্বিত করা হয়েছিল। তাদের প্রত্যেকেই বিশেষ জ্ঞানের পণ্ডিত ছিলেন। যেমন ইলমে হাদীসে পণ্ডিত ছিলেন ইয়াহইয়া বিন আবু যায়েদা, হাফস বিন গিয়াস, কাজী আবু ইউসুফ, দাঊদ তায়ী ও প্রমুখরা। মাসয়ালা উদ্ভূত করার ইলমে পারদর্শী ছিলেন ইমাম যুফার রাহিমাহুমুল্লাহ। আরবী সাহিত্যে পাণ্ডিত্য অর্জিত ছিল কাসেম বিন মাআন ও মুহাম্মাদ রাহিমাহুমাল্লাহ এর। এভাবে ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ এর ফিকহী বোর্ডের চল্লিশ সদস্যের প্রত্যেকেই কোন না কোন জ্ঞানে সমৃদ্ধ ছিলেন। ইমাম আযম রাহিমাহুল্লাহ উক্ত ফিকহী বোর্ডের মাধ্যমে তৎকালীন যুগের নানা সমস্যার শরয়ী সমাধান পেশ করতেন। এভাবে প্রত্যেক যুগেই নব উদ্ভাবিত মাসয়ালার সমাধানে ইসলামী বিশেষজ্ঞরা এগিয়ে আসতেন। তবে যুগের আবর্তনে যেহেতু মাসয়ালাগুলো পদ্ধতিগতভাবে ভিন্ন ও নতুন হত। এজন্য উলামাদের মাঝে সমাধানের ক্ষেত্রে সামান্য মতবিরোধ প্রাথমিকভাবে দেখা দিত। কিন্তু পরবর্তি সময়ে উলামায়ে উম্মতের ঐক্যমতে তার স্থায়ী সমাধান বের হয়ে আসত।
সেই ধারাবাহিকতায় বিমার মাসয়ালাও একটি আধুনিক গুরুত্বপূর্ণ মাসয়ালা। উলামায়ে কেরাম উক্ত মাসয়ালার শরয়ী সমাধানের জন্য মাশাআল্লাহ! অনেক মেহনত করেছেন। এ ব্যাপারে আরবীয় শায়েখদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। মিসর, সিরিয়া ও সৌদী আরবসহ অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলোয় বিমার মাসয়ালা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা পর্যালোচনার সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। নানাভাবে গবেষণার পর বিমার মাসয়ালায় উলামায়ে কেরামের সর্বসম্মত ফয়সালা বের হয়ে আসে। উপমহাদেশে আধুনিক মাসয়ালার প্রধান গবেষক আল্লামা মুফতি তাকী উসমানী মুদ্দা জিল্লুহু এব্যাপারে যথেষ্ট সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের আলেম সম্প্রদায়ের উপর যারপরনাই অনুগ্রহ করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল ইযযাত সবাইকে উত্তম বিনিময় দান করুন।
বিমার মৌলিক হুকুম ও উলামাদের মতামতঃ- ইংরেজি ১৯৬০ সনের পূর্বে ফিলিস্তিনের প্রধান মুফতি সাইয়েদ আমীন আল হুসাইনী এর তত্ত্বাবধানে ফিলিস্তিনে বিমার মাসয়ালা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যালোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সিরিয়ার প্রসিদ্ধ শায়েখ মুস্ততা আয যারক্বা এবং অপর শায়েখ আবু যাহরা এর মাঝে পারস্পরিক দ্বিমুখী নানা পর্যালোচনা অনুষ্ঠান সংঘটিত হয়। উক্ত আলোচনা পর্যালোচনা পর মোটামুটিভাবে তিনটি প্রধান মত বের হয়ে আসে। নিম্নে তা বর্ণনা করা হলঃ-
১ম মতঃ- গুটিকয়েক আলেমের মতে বিমা সর্বসাকুল্যভাবে জায়েয। চাই তা যেকোন প্রকারের বিমা হোক না কেন। তাদের দলীল নিম্নরূপঃ-
(ক) বিমা হল পারস্পরিক সহযোগিতার একটি পদ্ধতি মাত্র আর ইসলাম পারস্পরিক সহযোগিতার জন্যে যথেষ্ট গুরত্বারোপ করেছে। যেমন কুরআন পাকে ইরশাদ হচ্ছেঃ-
تعاونوا علي البر والتقوي
অর্থ : তোমরা সৎকাজ ও তাকওয়া অর্জনে একে অপরকে সহযোগিতা কর।
(খ) بيع بالوفاء যেভাবে বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে অথচ তাতে ফাসেদ শর্ত বিদ্যমান। তেমনি বিমার মধ্যে কিছুটা ধোকা থাকা সত্ত্বেও তা বৈধ হওয়ার দাবী রাখে।
(গ) বিমা কোম্পানিকে ক্ষতিগ্রস্থ ঋণগ্রহীতারা মূল অংকের সাথে যে সুদ প্রদান করে তা শরয়ী সুদ নয়। অতএব বিমা নাজায়েয হওয়ার কোন কারণ নেই। সুতরাং বিমা জায়েয।
২য় মতঃ- এ মতটি শায়েখ মুস্ততা আয যারক্বা ও শায়েখ আলী আল হাফীফ এর। এদের মতটি পূর্বোক্ত মতের মতই। তবে এরা বলেন বিমার মধ্যে সুদ ও জুয়ার কোন স্থানই নেই। আর সুদবিহীন বিমা বৈধ। তাদের যুক্তিগুলো নিম্নরূপঃ-
(ক) বিমা হল নির্ধারিত লেনদেনের চুক্তি আর জুয়া হল খেলা। সুতরাং দুটোর মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। অতএব জুয়া বৈধ না হলেও বিমা বৈধ হতে পারে।
(খ) বিমায় ক্ষতিপূরণ হিসেবে যে টাকা দেওয়া হয় তা গ্রাহকের প্রিমিয়ামের টাকার বিনিময়ে নয়। বরং এখানে প্রিমিয়াম হিসেবে যে টাকা গ্রাহক জমা করে তা মূলত বিমা কোম্পানির নিরাপত্তা প্রদানের বিনিময়। আর কেউ নিরাপত্তা দান করলে তাকে বিনিময় দেওয়া জায়েয। যেমন পাহারাদার বাড়িওয়ালাকে নিরাপত্তা দেয়, বিনিময়ে সে মাসিক বেতন গ্রহণ করে। তার এই টাকা নেওয়াটা সম্পূর্ণ বৈধ। তদ্রূপ কোম্পানি গ্রাহকের মালের নিরাপত্তা দেয় বিনিময়ে গ্রাহক থেকে যে অর্থ গ্রহণ করে তা মজুরীস্বরূপ। তাই পরবর্তীতে গ্রাহককে যে ক্ষতিপূরণ প্রদান করে থাকে তা অনুদান বলে গণ্য হবে। এজন্য কমবেশি করা সুদ হিসেবে গণ্য হবে না। সুতরাং বিমায় কোন সুদ নেই বলে বিমা সম্পূর্ণ জায়েয।
(গ) বিমার মাসয়ালা 'আকদে মুওয়ালাত' এর সাথে সম্পৃক্ত করা যায়। আকদে মুওয়ালাতের মধ্যে একজন অপরজনের দিয়ত জরিমানা ইত্যাদির যামিন হয়। এর বিনিময়ে একজন অপরজনের মিরাসের সম্পত্তি ভোগ দখলের অধিকারী হয়। যেমন তুহফাতুল ফুক্বাহায়ে বলা হয়েছেঃ-
وتفسير عقد الموالاة أن من أسلم على يدي رجل وقال له أنت مولاي ترثني إذا مت وتعقل عني إذا جنيت وقال الآخر قبلت فينعقد بينهما عقد الموالاة وكذا إذا قال واليتك وقال الآخر قبلت وكذلك إذا عقد مع رجل غير الذي أسلم على يديه وكذلك اللقيط إذا عقد مع غيره عقد موالاة وشرط صحة عقد الموالاة أن لا يكون للعاقد وارث مسلم وإذا انعقد عقد الموالاة يصير مولى له حتى لو مات ولم يترك وارثا يكون ميراثه لمولاه ولو جنى يكون عقله عليه ويلي عليه في الجملة (تحفة الفقهاء ٢/٢٨٩)
অর্থঃ- আর আকদে মুয়ালাতের তাফসির হলঃ- কোন ব্যক্তি কারো হাতে ইসলাম গ্রহণ করবে এবং তাকে বলবে যে আপনি আমার মাওলা। যদি আমি মারা যাই তবে আপনি আমার উত্তরাধিকার হবেন আর আপনি আমার পক্ষ থেকে দিয়ত আদায় করবেন যদি আমি অপরাধ করি। এখন যদি অন্যজন গ্রহণ করে নেয় তাহলে তাদের মাঝে আকদে মুওয়ালাত সংঘটিত হয়।......................(আকদে মুওয়ালাতের হুকুম হচ্ছে) যখন আকদে মুওয়ালাত সম্পন্ন হয়ে যায় তাহলে সে তার মাওলা পরিণত হয়। এখন যদি উক্ত ব্যক্তি মারা যায় এবং তার কোন ওয়ারিস না থাকে তাহলে তার মিরাসের মালিক হয়ে যাবে সে। এমনিভাবে যদি কখনো অপরাধ করে তাহলে তার যিমানের দায়িত্বও তার।
(ঘ) তাদের চতুর্থ যুক্তি হলঃ- বিমার কার্যক্রম পরিচালনার জন্যে কোম্পানির কর্মকর্তা ও কর্মচারীর নিয়োগ করতে হয়। তাদের বেতন ভাতা দিতে হয়। বিমা কোম্পানি যা লাভ করে তা কর্মচারীদের শ্রমের পারিশ্রমিক হিসেবে নেওয়া হয়।
(ঙ) তাদের পঞ্চম যুক্তি হলঃ- বিমা একটি নতুন ধরণের চুক্তি আর শরীয়তের দৃষ্টিতে যেকোন চুক্তিই বৈধ যদি তাতে শরীয়ত পরিপন্থী কিছু না থাকে। আর আমরা বিমার যে বব্যাখ্যা দিয়েছি তাতে শরীয়ত পরিপন্থী কিছুই নেই। সুতরাং বিমা চুক্তি বৈধ হওয়ারই দাবি রাখে।
৩য় মতঃ- এমতটি জুমহুর উলামায়ে কেরাম ও শায়েখ আবু যাহরা এর। এদের মত হল বিমা সর্বসাকুল্যভাবে না জায়েয ও অবৈধ। তাদের যুক্তি নিচে বর্ণিত হলঃ-
(ক) বিমার মধ্যে দুইটি দিক রয়েছে। প্রথমতঃ বিমাকারী মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই মারা গেলে সাধারণত বিমাকারী পূর্ণ টাকা পায় ক্ষতিপূরণের সাথে সাথে। এ সুরত স্পষ্টত জুয়ার অন্তর্ভুক্ত। কেননা মেয়াদপূর্তির আগে মৃত্যু হওয়া বা না হওয়া উভয় সম্ভাবনা বিদ্যমান। মৃত্যু হলে বিমাকারীর নমিনীর বাম্পার ফলাফল। কিন্তু মেয়াদপূর্তির আগে মৃত্যু না হলে নয়। কিন্তু মৃত্যু হওয়াটা নিশ্চিত নয়। দেখা গেল জুয়া মূল চিত্র এখানে উপস্থিত। আর জুয়া হারাম হওয়াটা কুরআন এর একাধিক আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং বিমার এ দিকটা হারাম জুয়াকে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ায় নাজায়েয সাব্যস্ত হল।
বিমার দ্বিতীয় দিক হলঃ মেয়াদপূর্তির পূর্বে বিমাকারী মারা না গেলে মেয়াদ শেষে মূল টাকা অতিরিক্ত সুদসহ ফেরত ফেরত পায়। এক্ষেত্রে সুদের উপস্থিতি বিদ্যমান আর ষরয়ী পরিভাষায় সুদ হারাম লেনদেনের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং বিমার এদিকটাও নাজায়েয।
(খ) বিমার মধ্যে صفقتان في صفقة অর্থাৎ এক চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার আগেই অন্য চুক্তি সম্পাদন পাওয়া যায় আর লেনদেনের এ ধারাটি হাদীস দ্বারা নিষিদ্ধ। এর উপর চার ইমামের ঐক্যমত স্থাপিত হয়েছে। বর্ণিত হয়েছেঃ-
عن ابن مسعود عن ابيه قال: نهي رسول الله ﷺ عن صفقتين في صفقة واحدة. ﴿ مسند احمد ٤/٣٠﴾
অর্থঃ- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ আপন পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার আগেই তম্মধ্যে অন্য চুক্তি করতে নিষেধ করেছেন। (মুসনাদে আহমদ খণ্ড নং- ৪, পৃষ্ঠা নং- ৩০)
বিমার মধ্যে গ্রাহকের সাথে কোম্পানি প্রথমতঃ একটি চুক্তি করে থাকে। অতঃপর সেই চুক্তির মেয়াদেই উক্ত গ্রাহকের সাথে বিমা কোম্পানি অন্যান্য চুক্তিও করে থাকে। যেমনঃ- কোন গ্রাহক বিমা কোম্পানিকে প্রিমিয়াম পরিশোধ করবে, বদলে বিমা কোম্পানি তার পণ্যের যামিন হবে। এটি একটি চুক্তি। ধরা হোক এর মেয়াদ দুই বছর। এই দুই বছরের মধ্যে গ্রাহক উক্ত চুক্তির মধ্যে অন্য কোন চুক্তি করতে পারবে না। কিন্তু তা হয় না। এখানে আরো বিভিন্ন প্রকার চুক্তি হয়। যেমনঃ- গ্রাহক যে প্রিমিয়াম জমা দিচ্ছে তা থেকে ঋণ আবেদন করলে কোম্পানি দিতে বাধ্য থাকবে। তেমনিভাবে দুর্ঘটনা এই এই প্রকারের হতে হবে ইত্যাদি। এভাবে বিভিন্ন কায়দায় صفقتان في صفقة উপস্থিতি থাকে। সুতরাং এ কারণে বিমা ওবৈধ হওয়ার দাবী রাখে।
(গ) বিমা এমন এক চুক্তি যে চুক্তির কারণে কখনো কখনো একজনের সম্পদ বিনিময় ছাড়াই শুধুমাত্র শর্তের কারণে অন্যজন লাভ করে থাকে। কেননা নৌ বিমায় অধিকাংশ সময় এমন হয় যে, বিমাকৃত জাহাজের কোন ক্ষতিই হয় না। অথচ বিমা কোম্পানি উক্ত জাহাজের বিপরীতে বিপুল অর্থের মালিক হয়ে যায় শুধুমাত্র শর্তের কারণে। কিন্তু ব্যবসায়ী লেনদেনে বিনা বিনিময়ে অন্যের মাল গ্রহণ করা হারাম। কারণ ব্যবসার মূলই তো مبادلة المال بالمال بالتراضي অর্থাৎ সন্তুষ্টচিত্তে সম্পদের বিনিময়ে সম্পদ গ্রহণ করা।
অপরদিকে মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেনঃ-
يا ايها الذين آمنوا لا تأكلوا اموالكم بينكم بالباطل. ﴿ سورة البقرة - ١٨٨ ﴾
অর্থঃ- হে মুমিনগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।
সূরায়ে বাক্বারাহ, আয়াত নং- ১৮৮, সূরায়ে নিসা, আয়াত নং- ২৯
ইমাম আবূ জাফর মুহাম্মাদ বিন জারীর আত তাবারী রাহিমাহুল্লাহ উক্ত আয়াতের তাফসির করতে গিয়ে বলেনঃ-
واكله بالباطل اكله من غير الوجه الذي أباحه الله لأكليه
অর্থঃ- অন্যায়ভাবে গ্রাস করার দ্বারা উদ্দেশ্য হল- আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক অনুমোদিত পন্থা ও পদ্ধতি ব্যতিরেকে ভিন্ন পন্থায় সম্পদ ভক্ষণ করা।
সূত্রঃ জামিউল বয়ান ফী তাফসীরিল কুরআন, ১৪ নং খণ্ড, ৩৩১ নং পৃষ্ঠা
সুতরাং এ কারনেও বিমা অবৈধ হওয়ার দাবীদার।
(ঘ) বিমা চুক্তি মূলত সম্পদ বিনিময়ের এমন এক ধরণের চুক্তি যাতে মারাত্মক ধরণের প্রতারণা ও অজ্ঞতা جهل বিদ্যমান। কেননা যে সম্ভাব্য দুর্ঘটনার ভিত্তিতে এ চুক্তি সম্পাদিত হয় তা কখনো ঘটতেও পারে আবার নাও ঘটতে পারে। আবার কত টাকা ক্ষতির বিনিময় হিসেবে কতটাকা ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করা হবে তাও অজানা। সুতরাং এ চুক্তিতে লেনদেনের পরিমাণ সম্পর্কে যথেষ্ট অস্পষ্টতা جهل বিদ্যমান। আর যে লেনদেনে অস্পষ্টতা থাকে তা শরীয়তের দৃষ্টিতে অবৈধ। যেমনঃ- ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়াতে উল্লেখ করা হয়েছেঃ-
ومنها أن يكون المبيع معلوما والثمن معلوما علما يمنع المنازعة فبيع المجهول جهالة تفضي اليها غير صحيح. (الفتاوي الهندية - ٣/٢)
অর্থঃ- ক্রয় বিক্রয় চুক্তি শুদ্ধ হওয়ার জন্যে জরুরী হল মূল্য ও পণ্য এমনভাবে জানা থাকা, যাতে বিবাদের আশংকা না থাকে। অতএব অস্পষ্ট বস্তু যাতে বিতর্কের সম্ভাবনা রয়েছে, তার বিক্রিয় চুক্তি অবৈধ। (ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া, ৩ নং খণ্ড, ২ নং পৃষ্ঠা)
(ঙ) বিমা চুক্তি মূলত টাকার বিনিময়ে টাকা লেনদেনের চুক্তি। কেননা পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে যে, জীবন বিমায় গ্রাহক যে প্রিমিয়াম পরিশোধ করে, মেয়াদ শেষে বিমা কোম্পানি তা সুদসহ ফেরত দেয়। বুঝা গেল বিমা চুক্তিটি একটি কাঁচা টাকার বিনিময় চুক্তি। পরিভাষায় যাকে "بيع صرف" অর্থাৎ মুদ্রা লেনদেন চুক্তি বলে অভিহিত করা হয়। বাইয়ে সরফ বৈধ হওয়ার জন্যে প্রধান দুটি শর্ত রয়েছে।
(১) লেনদেনের মধ্যে কমবেশি করা যাবে না। কমবেশি হলে সেটা ربوالفضل অধিক প্রদানজনিত সুদ হয়ে যাবে।
(২) লেনদেন হাতে হাতে অর্থাৎ উপস্থিত বৈঠকেই সম্পন্ন হতে হবে। অন্যথা সেটা ربوالنسيئة অর্থাৎ সময়ের ব্যবধানজনিত সুদ সাব্যস্ত হবে। সুদের উভয় প্রকারই হারাম। যেমন ফিকহে হানাফীর প্রসিদ্ধ কিতাব হিদায়ায় উল্লেখ করা হয়েছেঃ-
فإن باع فضة بفضة او ذهبا بذهب لايجوز الا مثلا بمثل... ولابد من قبض العوضين قبل الافتراق. (الهداية - ٣/٨٨)
অর্থঃ- যদি স্বর্ণ বিক্রয় করা হয় (যেটাকে বাইয়ে সরফ বলে) তাহলে সমানে সমান বিক্রি করতে হবে এবং ক্রেতা- বিক্রেতা উভয়ে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পূর্বেই নিজ নিজ পণ্য আয়ত্ব করে নিতে হবে। (হিদায়া ৪খণ্ড ৮৮ পৃষ্ঠা)
সুতরাং বিমা কোম্পানি মেয়াদ শেষে যদি জমাকৃত প্রিমিয়ামের চেয়ে অতিরিক্ত টাকা প্রদান করে তবে সেটা সুদ বলে গণ্য হবে। আবার মেয়াদ শেষে যদি অতিরিক্ত টাকা না দিয়ে কেবল মূল টাকা পরিশোধ করে, তথাপি সেখানে (রিবান নাসিয়া) অর্থাৎ সময়ের ব্যবধানজনিত সুদ বিদ্যমান। অতএব বিমা নাজায়েয হওয়াটাই যুক্তিযত।
(চ) বিমার মধ্যে একজনের দায়ভার অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। কেননা বিমা কোম্পানি নিজে কোন দুর্ঘটনা ঘটায় না বা কোন দুর্ঘটনা হওয়ার কারণও হয় না। সুতরাং বিমা কোম্পানির উপর দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায়ভার চাপানো শরীয়তসম্মত নয়। এমতাবস্থায় তাকে ক্ষতিপূরণ প্রদানে বাধ্য করা জুলম এর অন্তর্ভুক্ত যা সম্পূর্ণ হারাম। হ্যাঁ, কাউকে স্বেচ্ছায় ক্ষতিপূরণ দেওয়া ভিন্ন কথা। সেটাকে অনুদান হিসেবে ধরা হয়। তবে এক্ষেত্রে দাতাকে অনুদান প্রদানে বাধ্য করা বা চুক্তি দ্বারা দাতাকে চাপের মুখে ফেলে অনুদানের নামে ক্ষতিপূরণ আদায় করার অনুমতি নেই। মামলা মোকদ্দমা তো রইল অনেক দূরের কথা।
(ছ) বিমা কোম্পানির ক্লাইন্ট সংগ্রহের পদ্ধতিতে মারাত্মক ধরণের আত্মসাৎ রয়েছে। তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে- যেসব প্রচারকারী ক্লাইন্ট সংগ্রহ করে তাদেরকে বিমাকারীদের জমাকৃত টাকার সর্বোচ্চ ৭৫% কমিশন হিসেবে দেওয়া হয়। অবশিষ্ট ২৫% টাকা মোটে ব্যবসায় খাটান হয়।
(জ) বিমা পলিসির কারণে মিরাস সম্পত্তিতে অনেকটা ধোঁকাবাজি ও প্রতারণা হয়ে থাকে। কেননা বিমা কোম্পানি বিমাকারীর মৃত্যুতে ঐ ব্যক্তির কাছে টাকা হস্তান্তর করে যাকে হিসেবে নিযুক্ত করে যায় বিমাকারী। মৃত্যুর পর সে নমিনীই বিমার টাকার মালিক হয়। এক্ষেত্রে কখনো কখনো নমিনী বিমাকারীর ওয়ারিস বাদ দিয়ে অন্য কাউকে বানানো হয়। সে সময় মৃত বিমাকারীর মিরাসের সম্পদ তার ওয়ারিসের মালিকানায় না গিয়ে চলে যায় সেই নমিনীর মালিকানায়। যা একধরণের মারাত্মক প্রতারণা এবং ওয়ারিসকে তার প্রাপ্য হক থেকে বঞ্চিত করার কৌশল বটে। অথচ কুরআন ও হাদীসের আলোকে অন্যের হক নষ্ট করা বা প্রাপ্য ব্যক্তিকে তার হক থেকে বঞ্চিত করা সম্পূর্ণ হারাম সাব্যস্ত হয়েছে।
(ঝ) ইসলামী আকিদা-বিশ্বাস অনুযায়ী তাকদীরের উপর পূর্ণ আস্থা স্থাপন করা প্রত্যেক মুসলমানের একান্ত কর্তব্য। ভবিষ্যতে যে ঘটনা-দুর্ঘটনার আভির্ভাব হবে তা সম্পূর্ণ আল্লাহর ইখতিয়ারে। বান্দার কী ক্ষতি হবে, আবার তার ক্ষতিপূরণ কোত্থেকে আসবে; এসব ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা উপর এমন বিশ্বাস রাখা কর্তব্য যে, বান্দাকে যে মহাপরাক্রমশালী খোদা বিপদে আপতিত করেছেন তিনি অবশ্যই অবশ্যই পূনরায় বিপদমুক্ত করবেন। প্রত্যেক মুমিনের অন্তরের অবস্থা এমনটা হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বিমাকারীরা আল্লাহর উপর এমন আস্থা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে। কেননা তারা তো বিপদে আস্থার সোপান বানিয়েছে বান্দার উপর। তাই বিমাকারীরা বিপদে সম্পূর্ণ বান্দা নির্ভর হয়ে পড়ে। একজন মুসলমান হিসেবে যা মোটেও কাম্য নয়।
(ঞ) এছাড়াও পূর্বে বিমার যেসব ক্ষতি উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোও বিমা অবৈধ হওয়ার দাবীদার। তাই ধর্মীয়, নৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতির দিক বিবেচনা করতঃ আধুনিককালের ফিকাহবিদগণ বিমাকে অবৈধ ও হারাম বলে ঘোষণা করেছেন।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, এতক্ষণ যাবত বিমা হারাম হওয়ার ব্যাপারে যে আলোচনা করা হল তা শুধু কমার্শিয়াল বিমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অর্থাৎ কমার্শিয়াল বিমা যা মূলত ব্যবসায়ী বিমা বলে অভিহিত ; যার শাখাপ্রশাখা আর প্রকারভেদ হল - লাইফ ইন্স্যুরেন্স বা জীবন বিমা, থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্স, পণ্যের বিমা ইত্যাদি। ফুকাহায়ে কেরাম বিমার এজাতীয় প্রকারের সবগুলোকেই হারাম সাব্যস্ত করেছেন। এই কমার্শিয়াল বিমা হারাম হওয়ার উপর বিগত ৪/৪/১৩৯৮ হিজরীতে সৌদির রিয়াদে অনুষ্ঠিত বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরামের এক অধিবেশনে এবং ১৩৯৮ হিজরীর শাবান মাসে অনুষ্ঠিত 'মাজমাউল ফিকহ আল ইসলামি' এর প্রথম অধিবেশনে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বর্তমানে আরব জাহানের আলেমগণসহ পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের প্রাজ্ঞ উলামায়ে কেরাম কমার্শিয়াল বিমা হারাম হওয়ার ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন। আর বিমার অবশিষ্ট দুই প্রকারঃ- (১) গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স বা দলগত বিমা (২) পারস্পরিক সহযোগিতা বিমাকে মূলগতভাবে বৈধ বলেছেন। তবে এখানেও এই শর্তারোপ করা হয়েছে যে, আনুষঙ্গিক ক্ষেত্রে সুদের কোন প্রক্রিয়ার সাথে সেগুলোকে জড়িয়ে ফেলা যাবে না। কেননা সুদ যে ক্ষেত্রেই যুক্ত হবে তা অবৈধ হয়ে যাবে। আবার গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স ও সহযোগিতা বিমা মূলত দুর্ঘটনা কবলিত ব্যক্তির কল্যাণে স্বতঃস্ফূর্ত অনুদান। এ লক্ষ্যে গ্রুপ ইন্স্যুরেন্সের মাধ্যমে টাকা সঞ্চয় এবং পারস্পরিক সহযোগিতার জন্যে ফাণ্ডে টাকা ওয়াকফ করা, উভয়টিই শরীয়তের দৃষ্টিতে নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আর যেহেতু এখানে কোন ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য থাকে না, কেবল শহযোগিতাই উদ্দেশ্য হয় বিধায় এটি অবৈধ হওয়ার কোন মৌলিক কারণ উপস্থিত নেই। অতএব তা জায়েয। কিন্তু এ ফাণ্ডের টাকাও যদি ওবৈধ খাতে বিনিময় করে মুনাফা অর্জন বা সুদের ভিত্তিতে ঋণ-লোন প্রদান করা হয় তাহলে তা হারাম সাব্যস্ত হবে।
ইসলাম আওর জাদীদ মাআশী মাসায়েল - ৩/৩১২
ইসলামী অর্থনীতির আধুনিক রূপায়ন - ৪২৩
আধুনিক লেনদেনের ইসলামী বিধান - ১/১৭৪
কমার্শিয়াল বিমা জায়েয প্রবক্তাদের দলীল খণ্ডনঃ- বিমার মৌলিক শরয়ী বিধান ও তার দলীলাদি জানার পর এবার বিপক্ষদলের দলীলের উত্তরের প্রতি অগ্রসর হওয়া যাক।
প্রথমতঃ তারা দাবী করেছিল বিমা পারস্পরিক সহযোগিতা। কুরআন শরীফে একে অপরকে সাহায্যের কথা আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং বিমা অবৈধ হওয়ার কোন বিষয় নয়। এর উত্তর কিছুক্ষণ পূর্বেই হয়ে গেছে। বিমা যদি কেবলই সহযোগিতার জন্যে হয় যেমন মিউচুয়াল ইন্স্যুরেন্স (Mutual Insurance) তাহলে তা ওবৈধ হবে না। কিন্তু কমার্শিয়াল বিমায় সহযোগিতা নাম মাত্র। মূল উদ্দেশ্য হয়ে থাকে ব্যবসা আর ব্যবসা তখনি হালাল হবে যখন তা শরীয়তসম্মত কোন মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক না হবে। অন্যথা তা অবৈধ ও হারাম বলে বিবেচিত হবে। হাদীস শরীফে এসেছেঃ-
ثم قام رسول الله ﷺ في الناس فحمد الله وأثني عليه ثم قال أما بعد! مابال رجال يشترطون شروطا ليست في كتاب الله. ماكان من شروط ليس في كتاب الله فهو باطل وان كان مأة شرط. قضاء الله أحق و شرط الله أوفق. ( صحيح البخاري - ٢/٩٨١)
অর্থঃ- ... এর পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জনসম্মুখে দাঁড়িয়ে আল্লাহর হামদ ও ছানা বর্ণনা করলেন। অতঃপর বললেন - লোকদের কী হল যে, তারা এমন শর্তারোপ করে যা আল্লাহর কালামে নেই। আল্লাহর কালামে যে শর্তের উল্লেখ নেই তা বাতিল বলে গণ্য হবে, শত শর্ত হলেও। আল্লাহর ফয়সালাই সঠিক। আল্লাহর শর্তই সুদৃঢ়।
বুখারী শরীফ- ২/৯৮১, মুসলিম শরীফ- ১/৪৯৪, ফাতহুল বারী - ৯/৪১২
আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রাহিমাহুল্লাহ উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেনঃ-
وفيه بطلان الشروط الفاسده في المعاملات (فتح الباري - ٩/٤١٢)
আরবী অর্থঃ- উল্লেখিত হাদীসে লেনদেনের মধ্যে ফাসেদ শর্তের অবৈধতা বর্ণিত হয়েছে।
ফাতহুল বারী - ৯/৪১২
অতএব উপরিউক্ত হাদীস ও তার ব্যাখ্যার দ্বারা একথা সুস্পষ্ট যে ব্যবসা বৈধ হওয়ার জন্যে নাজায়েয কোন কিছু ব্যবসায় থাকা যাবে না।
তারা আরেকটি যুক্তি দিয়েছিল যে, বিমা কোম্পানি বিমা গ্রহীতাকে যে অতিরিক্ত টাকা দেয় তা শরয়ী সুদ নয়। বরং সেটা মুনাফা। আমাদের কথা হল শুধুমাত্র নাম পরিবর্তন করা দ্বারা বস্তুর মূল ও বিধান কোনটাতেই পরিবর্তন আসে না। কোন এলাকায় মদকে যদি ফলের জুস বলে অভিহিত করে তবে সে মদ ফলের জুস হয়ে হালাল হয় না। তদ্রূপ স্পষ্ট সুদকে মুনাফা নামে অভিহিত করলে সুদ বৈধ হয় না। বিমা কোম্পানির দেয়া অতিরিক্ত অর্থ যে সুদ তা আমরা ইতিপূর্বেই আলোচনা করেছি। এ ব্যাপারে মুফতিয়ে আযম পাকিস্তান আল্লামা শফী রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ-
ظاہر ہے کہ محض نام بدل دینے سے کسی معاملہ کی حقیقت نہیں بدلتی. بیمہ کمپنی کے منافع بلاشبہ سود و ربا کی تعریف میں داخل ہیں. )جواہر الفقہ - ۲/۱۸۱ (
অর্থঃ- একথা তো সুস্পষ্ট যে, শুধুমাত্র নাম পরিবর্তন করার দ্বারা কোন লেনদেনের বাস্তবতা পরিবর্তন হয় না। বিমা কোম্পানি থেকে যে লাভ প্রদান করা হয় তা নিঃসন্দেহে সুদের অন্তর্ভুক্ত।
জাওয়াহিরুল ফিকহ - ২/১৮১
তাদের আরেকটি দলীল ছিল - بیع بالوفاء যেমন ফাসেদ শর্ত থাকা সত্ত্বেও বৈধ তেমনি বিমায় কিছুটা ধোঁকা থাকলেও প্রয়োজনবোধে বিমা বৈধ। আমরা বলব, এটি একটি অযৌক্তিক ও অমূলক কিয়াস মাত্র। যার কোন গুরুত্ববহতা নেই। কেননা বিমার মধ্যে কেবল সামান্য ধোঁকা নিহিত আছে বলাটা মোটেও ঠিক না। বিমার অপকারিতা আলোচনার দিকে দৃষ্টিপাত করলে বুঝে আসে। এত বিশাল অপকারিতা সম্বলিত বিমাকে بیع بالوفاء এর সাথে তুলনা করে জায়েয বলা যায় না। আবার بیع بالوفاء এর বিধানে যথেষ্ট মতানৈক্য রয়েছে। যেমন হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ-
رہن قصدا اور بیع ظاہرا کو بیع بالوفاء کہتے ہیں، سو اصل قواعد مذہب کی رو سے یہ بھی رہن ہے اور انتفاع اس سے حرام ہے، اور اگر وہ بیع ہے تو بھی بوجہ مشروط ہونے کے بیع فاسد ہے، تب بھی حرام لیکن بعض متأخرین نے اجازت دی ہے، بس بلا اضطرار شدید تو اسکا ارتکاب نہ کرے اور اضطراب شدید میں بائع کو اختیار ہے کہ فتوی متأخرین پر عمل کرے، اگرچہ مشتری کو اضطرار نہیں ہے،
অর্থঃ- বাইয়ে ওফা হল, যা প্রকাশ্যভাবে ক্রয় বিক্রয় আর উদ্দেশ্যগত হিসেবে বন্ধকী চুক্তি। অতএব শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে মৌলিকভাবে এটা রাহন অর্থাৎ বন্ধকী চুক্তি। আর বন্ধকী চুক্তিতে উপকৃত হওয়া হারাম। আবার যদি তাকে বিক্রয় চুক্তি ধরা হয় তখনো তাতে ফাসেদ শর্ত যুক্ত হওয়ার কারণে তা হারাম। কিন্তু কিছু পরবর্তী আলেমগণ বাইয়ে ওফার অনুমতি প্রদান করেছেন। এজন্য গুরুতর অনোন্যপায় অবস্থা ছাড়া বিক্রেতার জন্যে বাইয়ে ওয়াফা এর অনুমতি নেই। তবে ক্রেতার জন্যে সেরূপ জরুরত প্রমানীত নেই।
ইমদাদুল ফাতাওয়া - ৩/১০৮
এই হল বাইয়ে ওয়াফার অবস্থা। আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রাহিমাহুল্লাহ তার প্রসিদ্ধ কিতাব 'রাদ্দুল মুহতারে' বলেনঃ-
و بيع الوفاء ذكرته هنا تبعا للرد و صورته أن يبيعه العين بألف علي أنه اذا رد عليه العين... قيل هو رهن قدمنا آنفا عن جواهر الفتوي أنه الصحيح و قيل بيع يفيد الانتفاع به، هذا محتمل لأحد القولين الاول أنه بيع صحيح مفيد لبعض احكامه من حل الانتفاع به الا أنه لايملك بيعه وقال الزيلعي في الاكراه وعليه الفتوي، الثاني القول الجامع لبعض المحققين أنه فاسد في حق بعض الاحكام كحل الانزال و منافع المبيع و رهن في حق البعض حتي لم يملك المشتري بيعه من أخر ولا رهنه الخ ﴿رد المحتار ٥/٢٧٧﴾
অর্থঃ- আর বাইয়ে ওয়াফা এখানে উল্লেখ করলাম প্রতিহত করার জন্যে। তার পদ্ধতি হল, কোন বস্তুকে এক হাজার টাকার বিনিময়ে এই শর্তে বিক্রয় করা যে, যখন এর মূল্য ফেরত দেওয়া হবে তখন ক্রেতা সে বস্তুটি বিক্রেতাকে ফেরত দিবে। কেউ বলেন এটি বন্ধকী চুক্তি। এটি জায়েয আছে। যেমন জাওয়াহিরুল ফাতাওয়া গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার কেউ বলেন, এটি বিক্রয় চুক্তি যা লাভ অর্জনের ফায়দা দেয়।
আল্লামা শামী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এটি দুই সম্ভাবনার যেকোন একটি হতে পারে। অর্থাৎ হয়তো এটি একটা শুদ্ধ ক্রয় বিক্রয় চুক্তি। সুতরাং তা লাভ অর্জনের ফায়দা দেয়। তবে সে তা বিক্রয়ের অধিকার রাখে না। যাইলাঈ রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ- এ মতটির উপরেই ফাতাওয়া। দ্বিতীয়ত মুহাক্কাকদের মত অনুযায়ী এটি কিছু বিধানের বেলায় বাইয়ে ফাসেদ আর কিছু বিধানের ক্ষেত্রে বন্ধকীর হুকুমে। কেননা ক্রেতা এটা অন্যত্র বিক্রয় বা বন্ধক কোনটাই করতে পারে না।
রাদ্দুল মুহতার - ৫/২৭৭
উপরিউক্ত আলোচনায় বুঝা গেল, বাইয়ে ওয়াফা মূলত বৈধ নয়। প্রয়োজনের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র বিক্রেতার জন্যে অনুমতি রয়েছে। অতএব এটি জরুরতের মাসয়ালার অন্তর্ভুক্ত একটি মাসয়ালা। এর উপর বিমার মাসয়ালাকে কিয়াস করা মোটেই উচিৎ নয়। বিমার মধ্যে জরুরত তো দূরের কথা হাজতের অস্তিত্বও নেই। সুতরাং বিমা বৈধ হওয়ার এ যুক্তি ভ্রান্ত।
বিমা বৈধ ঘোষণাকারীদের মূল দলীল ছিল - জুয়া হল খেলা আর বিমা হল লেনদেন। সুতরাং বিমা জুয়া নয়। আমাদের কথা হল জুয়া হওয়ার জন্যে খেলা হতে হবে এ কথার কোন ভিত্তি নেই। জুয়ার হাকিকত যার মধ্যে পাওয়া যাবে তাই জুয়ার অন্তর্ভুক্ত। এ ব্যাপারে শায়খুল মুফতি আল্লামা তাকী উসমানী সাহেব দামাত বারাকাতুহু বলেনঃ-
والذي يتبين من النظر في احكام القران و السنة والفقه الاسلام بشأن القمار، أن القمار يتركب من أربعة عناصر:
الاول: أنه عقد معاوضة بين جهتين أو فردين
الثاني: أن كل فريق في هذا العقد يعلق ملكه علي الخطر
الثالث: أن حصول المال الزائد في هذا العقد موقوف علي واقع يحتمل الوقوع وعدمه
الرابع: أن المال المعلق علي الخطر في القمار يضع من صاحبه بدون عوض أو يجلب مالا كثيرا . فيث وجدت هذه العناصر الاربعة تحقق القمار .
(بحوث في قضاي فقهية معاصرة، ٢/٢٣٠)
অর্থঃ- ক্বিমার (জুয়া) নিয়ে কুরআন ও সুন্নাহের বিধিবিধান ও ফিকহে ইসলামী গবেষণা করলে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ক্বিমার চারটি উপাদান দ্বারা গঠিত হয়। যথাঃ-
(১) এটা একাধিক পক্ষ বা ব্যক্তির মাঝে সংগঠিত বিনিময় চুক্তি عقد معاوضه (Commutative Contract)
(২) এ চুক্তিতে প্রত্যেক পক্ষ তার মালিকানাকে ঝুঁকির সাথে ঝুলিয়ে রাখে। (অর্থাৎ এর মধ্যে একটি বিনিময় দেওয়া নিশ্চিত থাকে কিন্তু অপর বিনিময়টা নিশ্চিত থাকে না।
(৩) এ চুক্তিতে অতিরিক্ত অর্থ লাভের বিষয়টা এমন এক অনিশ্চিত বাস্তবতার উপর নির্ভরশীল যা ঘটার সম্ভাব্যতা ও অসম্ভাব্যতা উভয় দিকই রয়েছে। হতেও পারে আবার নাও হতে পারে।
(৪) জুয়ার মধ্যে ঝুঁকির ভিত্তিতে প্রদানকৃত মালটা তার মালিকানা থেকে হয়তো কোন বিনিময় ছাড়াই নষ্ট হয়ে যায় অর্থাৎ অন্যের মালিকানায় চলে যায় বিনিময় ছাড়া অথবা অতিরিক্ত মাল অন্যের মালিকানা থেকে কোন বিনিময় ছাড়াই নিজের মালিকানায় চলে আসে। অতএব চারটি উপাদান যে চুক্তিতে সে চুক্তিই জুয়ার অন্তর্ভুক্ত।
বুহুস ফি কাযায়া ফিকহিয়্যাহ মুয়াসারাহ ২/২৩০-৩১
প্রতিপক্ষরা আরো একটি যুক্তি উত্থাপন করেছিল যে বিমায় ক্ষতিপূরণ হিসেবে যে টাকা প্রদান করা হয় তা গ্রাহকের জমাকৃত টাকার বিনিময় নয়। বরং নিরাপত্তা দানের বিনিময় স্বরূপ প্রিমিয়াম পরিশোধ করে থাকে। সুতরাং তা বৈধ। যেমন চৌকিদারের নিরাপত্তা দানের বিনিময়ে তাকে বেতন দেওয়া বৈধ।
এর জবাবে আমরা বলবঃ- নিরাপত্তা দানের বিনিময়েও কোন অর্থনৈতিক সুবিধা ভোগ করা জায়েয নেই। কেননা নিরাপত্তা অর্থের বিনিময় হওয়ার যোগ্য কোন বস্তু নয়। বিমা কোম্পানির নিরাপত্তার দেওয়াটা প্রিমিয়ামের বিনিময় নয়; যেকথা তারা বলেছে। বরং সে প্রিমিয়ামের বিনিময় হল ক্ষতিপূরণের টাকা আর এই ক্ষতিপূরণের টাকার ফলাফল হল গ্রাহকের নিরাপত্তা পাওয়া। উদাহরণে চৌকিদারের মজুরী হল তার টহলদান ও শ্রমের বিনিময়ে। নিরাপত্তা দানের বিনিময়ে নয়। নিরাপত্তা হল তা সুফল। আর শ্রম যেহেতু বিনিময়যোগ্যতা রাখে সুতরাং সে চুক্তি বৈধ হবে। পক্ষান্তরে বিমায় ক্ষতিপূরণের টাকা মূলতঃ প্রিমিয়ামের বিনিময়ে হয়ে থাকে। এজন্য এটি টাকার বিনিময়ে টাকা এর অন্তর্ভুক্ত, যা বাইয়ে সারফ বলে অভিহিত। আর বাইয়ে সারফে কমবেশী করে বিনিময় করা এবং বাকীতে বিনিময় করা উভয়টি সুদের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এ যুক্তিটিও অমূলক।
তাদের আরেকটি যুক্তি ছিল বিমা আকদে মুওয়ালাতের মতই একটি আকদ। সুতরাং এটিও জায়েয হওয়ার দাবীদার।
আমাদের কথা এ ব্যাপারে এই যে, বিমাকে আকদে মুওয়ালাতের সাথে তুলনা করা ঠিক হবে না। কেননা একটি পূর্বেই আমরা জানতে পারলাম যে, নিরাপত্তা প্রদানের বিনিময় হয় না। বিনিময় হয় শ্রমের। আর বিমায় কোম্পানি যে প্রিমিয়াম গ্রহণ করে থাকে মূলতঃ তার বিনিময়েই ক্ষতিপূরণ দেয়। আবার এটাও হয় যে, বিমা কোম্পানি অনেক সময় কোন বিনিময় ছাড়াই প্রিমিয়ামের মালিক বনে যায় যেমনটি আমরা ইতিপূর্বে জেনেছি। অথচ আকদে মুওয়ালাতের মধ্যে উভয় পক্ষ উভয়ের যামিন হয়। কিন্তু বিমায় তেমনটা হয় না। আর আকদে মুওয়ালাতের মাঝে যে মিরাসের মালিক হওয়ার বিষয়টা রয়েছে সেটা কোন বিনিময় নয়, বরং ফলাফল স্বরূপ। অনেক ক্ষেত্রে সম্পদ সম্পত্তি কিছুই থাকে ফলে সেখানে সম্পত্তির মালিকানার বিষয়টি থাকে না। সুতরাং আকদে মুওয়ালাতের সাথে কিয়াস সহীহ নয়।
তাছাড়া ফুকাহায়ে কেরাম আকদে মুওয়ালাত বৈধ করেছেন অনেকগুলো শর্ত সাপেক্ষে। যেমন আল্লামা কাসানী রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ-
واما شرائط العقد فمنها عقل العاقد ومنها أن لايكون للعاقد وارث ومنها ان لايكون من العرب ومنها ان لايكون من موالي العرب ومنها ان لايكون معتق أحد ومنها ان لايكون قد عقل عنه بيت المال الخ ﴿بدائع الصنائع ٤/١٧٠﴾
অর্থঃ- আকদে মুওয়ালাতের শর্ত সমূহ হলঃ- (ক) জ্ঞানী হওয়া (খ) চুক্তিকারীর কোন সন্তান না থাকা। (গ) আরব না হওয়া বা আরবদের আযাদকৃত গোলাম না হওয়া ইত্যাদি....
বাদায়েউস সানায়ে, ৪/১৭০
উপরিউক্ত ইবারতের মধ্যে একাধিক বিভিন্ন প্রকারের শর্তের উল্লেখ দ্বারা এ কথা বুঝা যায় যে, আকদে মুওয়ালাত বৈধ করা হয়েছে জরুরতের কারণে। কেননা যদি কারো অবস্থা এমন হয় যে, তার পক্ষে দাঁড়ানোর কেউ নেই। সে মারা যাওয়ার পর তার ওয়ারিস হওয়ার জন্যেও কেউ নেই। বিপদে সাহায্য কারীও কেউ নেই, তাহলে এমন একক ব্যক্তির কেউ ব্যবসা ইত্যাদি করতে চাইবে না। ফলে তার জীবন যাপন করা দুষ্কর হয়ে উঠবে। এজন্য আকদে মুওয়ালাতের মাধ্যমে একজন যিম্মাদার নির্ধারণ করা হত। যাতে তার আগে পিছে কেউ একজন থাকে। মদীনায় হিজরতের পর মুহাজির সাহাবাদের অনেকের কোন নিকট আত্মীয় ছিল না। তাদের স্বাভাবিক জীবন-যাপন যেন বিপর্যস্ত না হয়, এজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুহাজির ও আনসারদের মাঝে "مواخاة " ভাতৃত্ব বন্ধন স্থাপন করে দিয়েছিলেন। এমন একটা ফরমান লিপিবদ্ধ করেছিলেন। যেখানে এই বিধান ছিল যে - মুহাজির ও আনসারদের কেউ ক্ষতিগ্রস্থ তার ক্ষতিপূরণ সবাই বহন করবে। যেমনঃ- বর্ণিত হয়েছেঃ-
عن ابن عباس رضي الله عنه قال: كتب رسول الله ﷺ كتابا بين المهاجرين والانصار أن يعقلوا معاقلهم وأن يفيدوا عاينهم بالمعروف والاصلاح ، ﴿ نصب الراية- ٤/٦١٢﴾
অর্থঃ- জনাব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসার ও মুহাজিরদের জন্যে একটি ফরমান জারী করেছিলেন। যার মধ্যে এ কথা উল্লেখ ছিল, মুহাজির ও আনসাররা একদল অপর দলের দিয়ত আদায় করবে। কেউ বন্দি হলে তার ফিদিয়া প্রদান করবে। এ ফরমানটি পারস্পরিক সংশোধনের ভিত্তিতে ছিল। নাসবুর রায়াহ - ৪/৬১২
সুতরাং আলোচনার দ্বারা প্রতীয়মান হল যে, আকদে মুওয়ালাত জরুরতের ভিত্তিতে জায়েয ও প্রচলিত হয়েছে। তাই এর উপর কিয়াস করে এমন চুক্তির ব্যাপারে দলীল উত্থাপন করা যাবে না যার মধ্যে কেবল ধোঁকা নিহিত রয়েছে।
তাদের আরেকটি যুক্তি ছিল যে, গ্রাহক থেকে যে লাভ নেওয়া হয় তা বিমা কোম্পানির কর্মচারীদের বেতন ভাতা স্বরূপ গ্রহণ করা হয়। এ যুক্তিটিও একদম অকাজের। যেহেতু সুদি কারবারে জড়িত কোম্পানির মুনাফাও সুদ মিশ্রিত মুনাফা। আর পারিশ্রমিক দিয়ে সুদের কার্যক্রম সম্পাদন করা জায়েয নেই।
তাদের অন্যতম দলীলটি ছিলঃ- বিমা একটি নতুন চুক্তি আর শরীয়তের দৃষ্টিতে নতুন চুক্তির মৌলিকতা হল জায়েয হওয়া, যদি তাতে শরীয়ত পরিপন্থী কিছু না থাকে।
আমরা বলব, বিমার যে স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে তাতে শরীয়ত পরিপন্থী একাধিক কারণ এ শর্তের উপস্থিতি বিদ্যমান। সুতরাং তা নাজায়েয ও অবৈধ। ইতিপূর্বে এ ব্যাপারর হাদীস বর্ণীত হয়েছে।
উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, কমার্শিয়াল বিমা যেখানে বিভিন্ন ফাসিদ শর্তের উপস্থিতি রয়েছে, তা কোনভাবেই জায়েয হতে পারে না। অতএব কমার্শিয়াল বিমার ব্যাপারে এক কথায় হুকুম দেওয়া যায় যে, তা নাজায়েয ও হারাম। এ ব্যাপারে বর্তমান যুগের ফকীহ আলেমগণ একমত পোষণ করেছেন। এখন আমরা বিমার ব্যাপারে বিভিন্ন ফাতাওয়ার কিতাবে উল্লেখিত কিছু ফাতাওয়া উল্লেখ করব ইনশাআল্লাহুল আযীয।
বিমার ব্যাপারে আল্লামা শামীর ফাতাওয়া
والذي يظهر لي: أنه لا يحل للتاجر أخذ بدل الهالك من ماله لأن هذا التزام ما لا يلزم. فإن قلت: إن المودع إذا أخذ أجرة على الوديعة يضمنها إذا هلكت قلت ليست مسألتنا من هذا القبيل لأن المال ليس في يد صاحب السوكرة بل في يد صاحب المركب، وإن كان صاحب السوكرة هو صاحب المركب يكون أجيرا مشتركا قد أخذ أجرة على الحفظ، وعلى الحمل، وكل من المودع والأجير المشترك لا يضمن ما لا يمكن الاحتراز عنه كالموت والغرق ونحو ذلك. فإن قلت: سيأتي قبيل باب كفالة الرجلين قال لآخر اسلك هذا الطريق، فإنه آمن فسلك، وأخذ ماله لم يضمن ولو قال: إن كان مخوفا وأخذ مالك فأنا ضامن ضمن وعلله الشارح هنالك بأنه ضمن الغار صفة السلامة للمغرور نصا اهـ أي بخلاف الأولى، فإنه لم ينص على الضمان بقوله فأنا ضامن، وفي جامع الفصولين الأصل أن المغرور إنما يرجع على الغار لو حصل الغرور في ضمن المعاوضة أو ضمن الغار صفة السلامة للمغرور فيصار كقول الطحان لرب البر: اجعله في الدلو فجعله فيه، فذهب من النقب إلى الماء، وكان الطحان عالما به يضمن؛ إذ غره في ضمن العقد وهو يقتضي السلامة. اهـ. قلت: لا بد في مسألة التغرير من أن يكون الغار عالما بالخطر كما يدل عليه مسألة الطحان المذكورة، وأن يكون المغرور غير عالم إذ لا شك أن رب البر لو كان عالما بنقب الدلو يكون هو المضيع لماله باختياره، ولفظ المغرور ينبئ عن ذلك لغة لما في القاموس غره غرا وغرورا فهو مغرور وغرير خدعه وأطمعه بالباطل فاغتر هو. اهـ. ولا يخفى أن صاحب السوكرة لا يقصد تغرير التجار، ولا يعلم بحصول الغرق هل يكون أم لا، وأما الخطر من اللصوص، والقطاع فهو معلوم له، وللتجار لأنهم لا يعطون مال السوكرة إلا عند شدة الخوف طمعا في أخذ بدل الهالك، فلم تكن مسألتنا من هذا القبيل أيضا،
অর্থঃ- (বিমার ব্যাপারে উত্তর হল) সমুদ্রপথে মাল ধ্বংস হলে ক্ষতিপূরণ নেওয়াটা ব্যবসায়ীদের জন্যে জায়েয হবে না। কেননা এটি 'এমন বস্তুকে আবশ্যক করে নেওয়া যা মূলতঃ আবশ্যক নয়' সেই মাসয়ালার অন্তর্ভুক্ত।..................
বুহুস ফি ক্বাযায়া ফিকহিয়্যাহ মুআছারা
اما بعد! فقد اتفق معظم العلماء المعاصرين والمجامع والندوات الفقهية علي حرمة التأمين التجاري التقليدي لما يشمل عليه من الغرر والقمار والربا
﴿بحوث في قضايا فقهية معاصرة - ٢/١٨٧﴾
অর্থঃ- বর্তমান যুগের আলেমদের বড় অংশ ফিকহী বোর্ড ও সেমিনারে কমার্শিয়াল বিমা হারাম হওয়ার উপর একমত পোষণ করেছেন। যেহেতু এ জাতীয় বিমার মধ্যে ধোঁকাবাজি, জুয়া ও সুদের উপস্থিতি বিদ্যমান থাকে।
(বুহুস ফি ক্বাযায়া ফিকহিয়্যাহ মুআছার, ২/১৮৭)
ফাতাওয়ায়ে ইসলামিয়ার ইবারত
يجوز للانسان أن يساهم في هذه الشركات اذا كانت لا تتعامل بالربا فان كان تعاملها بالربا فلايجوز وذاك لثبوت تحريم التعامل بالربا في الكتاب و السنة و الاجماع وكذالك لايجوز للانسان أن يساهم في شركات التأمين التجاري لأن عقود التأمين مشتملة علي الغرر والجهالة والربا والعقود المشتملة علي الغرر والجهالة والربا محرمة في الشريعة الاسلامية، ﴿الفتاوي الاسلامية - ٢/٣٩٢ ﴾
অর্থঃ- কোন ব্যক্তির জন্যে ব্যাংক ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করা তখনি জায়েয হবে যখন তা সুদ মুক্ত হবে। এটা এজন্যই যেহেতু সুদের হারাম হওয়া কুরআন সুন্নাহ ও ইজমায়ে উম্মত দ্বারা সাব্যস্ত। এমনিভাবে মানুষের জন্যে কমার্শিয়াল বিমায় অংশগ্রহণ করা জায়েয নেই। যেহেতু কমার্শিয়াল বিমার চুক্তি ধোঁকা অস্পষ্টতা ও সুদের অন্তর্ভুক্ত, বিধায় তা হারাম।
(ফাতাওয়া ইসলামিয়া, ২/৩৯২)
ইমদাদুল ফাতাওয়া এর ইবারত
ان اشتہاری و تجارتی بیموں میں کمپنیا جو خاص مالک کو خاص صورتوں میں معاوضہ دیتی ہے صورةً تو وہ عوض ہے ان مال تلف شدہ کا مگر وہ واقع میں عوض ہے اس رقم کا جو ماہانہ یا سالانہ داخل کی جاتی ہے کیونکہ ان کو مقصود وہی ہے ورنہ مال ضائع سے ان کو کیا نفع ہو سکتاہے، پس باعتبار صورت کے تو یہ قمار ہے لأنه تعليق الملك علي الخطر والمال في الجانبن اور باعتبار حقیقت کے سود ہے لعدم اشتراط المساواة في الجانبين فيما يجب فيه المساواة. پس یہ معاملہ قطعاً حرام ہے، اسی طرح جان کا بیمہ وہ صورة رشوت ہے لأن المال فيه عوض من غير متقوم و هو النفس اور حقیقۃً سود ہے
অর্থঃ- এ সকল ব্যবসায়ী বিমা কোম্পানি গ্রাহককে যে বিশেষ সুরতে বিনিময় প্রদান করে থাকে, বাহ্যিকভাবে যদিও সেড়া ধ্বংসপ্রাপ্ত মালের ক্ষতিপূরণ কিন্তু বাস্তবে সেটা ঐ টাকার বিনিময় যা গ্রাহক মাসিক বা বাৎসরিক প্রিমিয়াম আকারে পরিশোধ করে ছিল।.... অতএব বাহ্যিকভাবে এটা জুয়া.... আর বাস্তবে সেটা সুদ.....। অতএব বিমা চুক্তিটি নিঃসন্দেহে হারাম। এমনিভাবে জীবন বিমা (হারাম) কেননা তা বাহ্যিকভাবে ঘুষ....আর বাস্তবে সুদ।
(ইমদাদুল ফাতাওয়া, ৩/১৬১)
কিফায়াতুল মুফতি এর ইবারত
سوال: زندگی کا بیمہ کرانا کیسا ہے؟
جواب: زندگی کا بیمہ کرانا جائز نہیں ہے؟
سوال: جان و مال کا بیمہ کرانا کیسا ہے؟
جواب: بیمہ ایک قسم کا قمار ہے اسلئے ناجائز ہے؟ ﴿کفایۃ المفتی-۸/۸۲.۸۳ ﴾
অর্থঃ- প্রশ্ন, জীবন বিমা করার বিধান কী
উত্তর, জীবন বিমা করানো জায়েয নেই
প্রশ্ন, জান ও অর্থ সম্পদের বিমা করা জায়েয আছে কি?
উত্তর, বিমা এক ধরণের জুয়া। এজন্য জান ও অর্থ সম্পদের বিমা করা জায়েয নেই।
(কিফায়াতুল মুফতি, ৮ / ৮২, ৮৩)
ফাতাওয়ায়ে উসমানী এর ইবারত
انشورنش کے جو طریقے اس وقت تک مروج ہیں وہ سب سود اور قمار پر مشتمل ہیں اور حرام ہیں، مختلف انشورنس کمپنیا جن علماء کے بیانات شائع کرتی رہتی ہے ان میں دو قسم کے بیانات ہوتے ہیں، بعض مرتبہ ان کمپانیوں نے بعض علماء کی طرف سے غلط بیانات منسوب کئے ہیں اور بعض مرتبہ علماء کی طرف بیانات کی نسبت غلط نہیں ہوتی لیکن جن علماء نے موجودہ انشورنس کو جائز کہا ہے ان کی بات بحیثیت مجموعی عالم اسلامی کے علماء نے قبول نہیں کی، لہذا وہ شاذ اقوال کی حیثیت رکھتے ہیں اور ان کے دلائل بھی نہایت کمزور ہیں، مجمع الفقہ الاسلامی جدہ میں ساری دنیا کے علماء نے جمع ہوکر اس مسئلے پر مفصل بحث کی اور بالاخر انشورنس کی مروجہ طریقوں کی حرمت کا فتوی دیا اور بعض علماء کے شاذ اقوال کو باطل قرار دیا، اس اجتماع میں ۱۴۵ اسلامی ملکوں کے تقریبا ۱۵۰ علماء شریک تھے، ﴿ فتاوی عثماني - ۳/۳۲۸ ﴾
অর্থঃ- ইন্স্যুরেন্স (বিমার) বর্তমান প্রচলিত যত প্রকার রয়েছে সবগুলো সুদ ও জুয়ার অন্তর্ভুক্ত, বিধায় তা হারাম। ... কিছু আলেমের বৈধ হওয়ার মত থাকলেও সে মতটি খুবই দুর্বল ও ক্ষীণ। তাদের দলীলাদিও অনেক দুর্বল ও কমজোর। 'মাজমাউল ফিকহ ইসলামি' জেদ্দাতে পুরো দুনিয়ার ইসলামি রাষ্ট্রের আলেমগণ একত্রিত হয়ে এ ব্যাপারে সুদীর্ঘ আলোচনা পর্যালোচনা করেছেন। অবশেষে বর্তমান প্রচলিত ইন্স্যুরেন্স হারাম হওয়ার উপর ফাতাওয়া দেওয়া হয় এবং কতক আলেমের বৈধ হওয়ার মতকে বাতিল সাব্যস্ত করা হয়। সেই সেমিনারে ১৪৫ টি ইসলামি রাষ্ট্র থেকে প্রায় ১৫০ জন আলেম অংশগ্রহণ করেন।
ফাতাওয়ায়ে উসমানী, ৩/৩২৮
আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল এর ইবারত
بیمہ کی جو موجودہ صورتیں رائج ہیں وہ شرعی نقطۂ نظر سے صحیح نہیں، بلکہ قمار اور جوا کی ترقی یافتہ شکلیں ہیں اسلئے اپنے اختیار سے بیمہ کرانا تو جائز نہیں، اور اگر قانونی مجبوری کی وجہ سے بیمہ کرانا پڑے تو اپنی ادا کردہ رقم سے زیادہ سے وصول کرنا درست نہیں، چونکہ بیمہ کا کاروبار درست نہیں، اسلئے بیمہ کمپنی میں ملازمت بھی صحیح نہیں،
﴿آپ کے مسائل اور انکا حل ۶/۱۹۶ ﴾
অর্থঃ- বিমার বর্তমান প্রচলিত সকল সুরতই শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে বৈধ নয়। বরং বিমা হল জুয়ার উন্নত একটি পদ্ধতি মাত্র। এজন্য নিজ ইচ্ছায় বিমা করা বৈধ নয়। যদি আইনগত বাধ্য হয়ে বিমা করতেই হয় তবে নিজের জমাকৃত টাকার অতিরিক্ত টাকা গ্রহণ করা জায়েয হবে না। যেহেতু বিমার কার্যক্রম বৈধ নয় এজন্য বিমা কোম্পানিতে চাকরি করাও বৈধ নয়।
(আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল, ৬/১৬৯)
কিতাবুল ফাতাওয়া এর ইবারত
جان و مال کا انشورنس أصل میں جائز نہیں کیونکہ اگر پالسی مکمل کی تو وہ پالسی لینے والا جتنی رقم ادا کرتا ہے کمپنی اس سے زیادہ رقم واپس کرتی ہیں اور یہ سود ہے اور اگر پالسی مکمل ہونے سے پہلے حادثہ حادثہ پیش آگیا تو رقم پوری مل جاتی ہے حالانکہ اس نے چاند قسطیں ہی جمع کی ہیں گویا پالسی لینےوالے کو اپنی پالسی کا انجام معلوم نہیں، کسی کو دو تین قسطیں کی آدائیگی پر پوری رقم مل جائگی اور کسی کو تمام قسطیں ادا کرنی ہوگی، ظاہر ہے کہ یہ صورت قمار میں داخل ہے، پس انشورنس سود اور قمار سے مرکب صورت ہے اور شریعت ان دونوں کی ممانعت ہے، اسلئے اصلا یہ صورت جائز نہیں ﴿ کتاب الفتاوی - ۵/۳۵۶﴾
অর্থঃ- জান ও সম্পদের ইন্স্যুরেন্স মৌলিকভাবেই জায়েয নেই। কেননা যদি বিমাকারী পলিসি পূর্ণ করে তবে যত টাকার পলিসি করেছিল বিমা কোম্পানি তাকে তার বেশী টাকা প্রদান করে। এটা সুস্পষ্টভাবে সুদ। আর যদি বিমাকারী মেয়াদপূর্তির আগেই মারা যায় তাহলে তার নমিনী পূর্ণ টাকা পেয়ে যায়। অথচ বিমাকারী মাত্র কয়েকটা কিস্তি পরিশোধ করেছিল। তাহলে বুঝা গেল, বিমাকারী নিজেও জানে না যে বিমার কী ফলাফল হবে। কাউকে পূর্ণ কিস্তি পরিশোধ করতে হয় আবার কেউ দুই তিনটি কিস্তি দিয়েই পূর্ণ টাকা পেয়ে যায়। আর স্পষ্টত এটা জুয়ার অন্তর্ভুক্ত। বুঝা গেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি সুদ ও জুয়ার দ্বারা গঠিত একটি পদ্ধতি মাত্র আর শরীয়তে সুদ ও জুয়া উভয়টি নিষিদ্ধ। তাই বিমা মূলগতভাবেই জায়েয নয়।
(কিতাবুল ফাতাওয়া, ৫/৩৫৬)
ফাতাওয়ায়ে হাক্কানিয়ার ইবারত
اگر در حقیقت بیمۂ زندگی کی حقیقت یہی ہو جیساکہ ہمارا خیال ہے تو اسکو ہم درج ذیل وجوہ کی بنا پر ناجائز اور حرام سمجھتے ہیں:
(ا) پہلی وجہ یہ ہے کہ اس عقد میں ایک طرف سود پایا جاتاہے ...
(ب) وجہ دوم: دوسری طرف یہ عقد میسر اور قمار پر مشتمل ہے...
(ج) اس بیمہ دار شخص کی موت کی صورت میں کمپنی کو اسکی ادا کردہ رقم کا مالک صرف وہ شخص ہوتا ہے جو اس نے نامزاد کیا ہے اور باقی تمام ورثاء اس رقم سے یکسر محروم ہوجاتا ہیں، حالانکہ اسلامی قانون وراثت کی رو سے اس رقم میں وہ تمام ورثاء بھی حقدار ہیں...
(د) بیمہ کمپنی کے ساتھ تعاون علی الاثم والعدوان بھی پایا جاتا ہے جو قرآن کریم کی رو سے یہ عمل ناجائز ہے... الخ ﴿فتاوي حقانيۃ ۶/۲۲۰— ﴾
অর্থঃ- (পূর্বে পদ্ধতি আলোচনার পর) যদি জীবন বিমার পদ্ধতি এমন হয়ে থাকে যেমন আমাদের ধারণা, তাহলে বিমা নিম্নলিখিত কারণে অবৈধ ও হারাম।
১. বিমা চুক্তিতে সুদের অস্তিত্ব রয়েছে।
২. বিমার চুক্তি জুয়ার অন্তর্ভুক্ত।
৩. বিমাকারীর মৃত্যুর পর জমাকৃত টাকার মালিক হয় নমিনী হিসেবে যার নাম উল্লেখিত রয়েছে সে। অথচ ইসলামি ফারায়েয অনুযায়ী উক্ত টাকায় সমস্ত ওয়ারিসের নির্দিষ্ট অংশ রয়েছে।
৪. বিমা কোম্পানিতে যুক্ত হওয়ার দ্বারা تعاون علی الاثم والعدوان অর্থাৎ গুনাহের কাজে সহায়তা করা হয়। অথচ কুরআন মাজীদে تعاون علی الاثم والعدوان গুনাহের কাজে সহায়তা করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
(ফাতাওয়ায়ে হাক্কানিয়া, ৬/২২০)
বিমার ব্যাপারে কিছু ফাতাওয়ার কিতাবের ইবারত উল্লেখ করা হল। উক্ত ইবারতগুলোর বক্তব্য অতি সুস্পষ্ট। তা হল, বিমার প্রচলিত রূপ যেটাকে কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স বলে অভিহিত করা হয়, তা জায়েয নেই। এখন আমরা বিমা সংক্রান্ত কিছু বিচ্ছিন্ন জরুরী মাসয়ালা উল্লেখ করে বিমার বিকল্প ইসলামি ব্যবস্থার স্বরূপ সংক্ষেপে আলোচনা করে প্রবন্ধের ইতি টানবো ইনশাআল্লাহ!
প্রশ্ন নং - ০১। বিমা যদি সুদমুক্ত হয় তবে তার বিধান কী?
উত্তরঃ- বিমা সুদমুক্ত হলেও জুয়া অন্তর্ভুক্ত থাকেই। এজন্য বৈধ নয়।
(ফাতাওয়া উসমানী, ৩/৩২৮)
প্রশ্ন নং - ০২। কোথাও যদি বিমা আইনগতভাবে জরুরী হয় তাহলে কী করণীয়?
উত্তরঃ- যেখানে বিমা করা আবশ্যক, বিমা করা ছাড়া মানুষ তার প্রয়োজন সারতে সক্ষম নয় সেখানে বিমা করার অবকাশ আছে বটে। যেমন থার্ড পার্টি ইন্স্যুরেন্স যা প্রায় সকল দেশেই আবশ্যকীয়। যা না করলে রাস্তায় গাড়ী নামানো অসম্ভব। এ ক্ষেত্রে যদি গাড়ী দুর্ঘটনার পর বিমা কোম্পানি গ্রাহককে ক্ষতিপূরণ দেয় তাহলে গ্রাহকের জন্যে ততটুক নেওয়া জায়েয হবে যে পরিমাণ অর্থ প্রিমিয়াম হিসেবে কোম্পানিতে পরিশোধ করেছে। তার বেশী গ্রহণ করা জায়েয হবে না।
(ইসলাম আওর জাদীদ মাআশী মাসায়েল, ৩/৩১৭)
প্রশ্ন নং - ০৩। বিমা কোম্পানিতে এজেন্ট হয়ে কাজ করে কমিশন গ্রহণ করা জায়েয হবে কি?
উত্তরঃ- বিমা কোম্পানির বর্তমান কার্যক্রম যেহেতু সুদি লেনদেনের সাথে জড়িত তাই এতে এজেন্ট হয়ে কমিশন গ্রহণ করা সুদী কাজে সহযোগিতা করে বিনিময় গ্রহণ করা। সুতরাং তা না জায়েয।
(আপকে মাসায়েল আওর উনকা হল, ৩/১৯৮)
প্রশ্ন নং - ০৪। সরকারের পক্ষ থেকে চাকুরীজীবীদের মাঝে যে গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স হয়ে থাকে, তার বিধান কী?
উত্তরঃ- গ্রুপ ইন্স্যুরেন্সের নিয়মকানুন জনার পর বুঝা গেল যে, এই ইন্স্যুরেন্সে প্রত্যেক চাকুরিজীবীর মাসিক বেতনের কিছু অংশ সরকার স্বেচ্ছায় অনিচ্ছায় কেটে রাখে। এটা সরকারের জন্যে যদিও ঠিক নয় তথাপি যে কর্মচারীদের বেতনের কিছু অংশ সরকার কেটে রাখে তাতে দুই সুরতঃ- ১. যদি এই টাকা উক্ত কর্মচারীকে সরকার ফেরত না দেয় তবে এটা (গসব) ছিনতাই বলে সাব্যস্ত হবে।
২. যদি দুর্ঘটনাবশত বা অন্য কারণে সরকারের পক্ষ থেকে উক্ত কর্মচারীকে তার বেতন থেকে জমা টাকার চেয়ে বেশি টাকা প্রদান করে তাহলে এটা প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের অতিরিক্ত টাকার মতই সুদবিহীন বলে গণ্য হবে। কেননা কর্মচারী থেকে তার অনিচ্ছায় জবরদস্তিমূলক বেতনের কর্তিত অংশ دین ضعیف হওয়ার কারণে কর্মচারীর পরিপূর্ণ মালিকানা তাতে থাকে না। এজন্য সরকার উক্ত টাকায় হস্তক্ষেপ করে যে প্রবৃত্তি ঘটায় তা কর্মচারীর মালিকানাভুক্ত গণ্য হয় না। এখন সরকারী হস্তক্ষেপে অর্জিত লভ্যাংশ থেকে যদি সরকার কোন কর্মচারীকে কিছু দেয় তবে সেটা অনুদান বলে গণ্য হবে। সুদের অন্তর্ভুক্ত হবে না। সুতরাং কর্মচারীর পক্ষে তা গ্রহণ করা জায়েয আছে। কিন্তু সরকার উক্ত টাকা দ্বারা অবৈধ পন্থায় মুনাফা অর্জন করার সম্ভাবনার রয়ে যায় বিধায় কর্মচারী কেবল মূল টাকা গ্রহণ করবে। অতিরিক্ত টাকা গরীবদের মাঝে সাদকাহ করে দিবে। এটাই অধিক সতর্কতা। (ফাতাওয়ায়ে উসমানী, ৩/৩৩৬)
প্রশ্ন নং - ০৫। বিদেশ সফরে কখনো কখনো জীবন বিমা আবশ্যক হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে
করণীয় কী?
উত্তরঃ- বিমা যদিও বৈধ নয় কিন্তু যদি বিমা ছাড়া বিদেশ সফর অসম্ভব হয়ে পড়ে তাহলে অপারগ হয়ে বিমা করার অবকাশ আছে বটে। কিন্তু ক্ষতিপূরণ ততটুকু গ্রহণ করবে যে পরিমাণ অর্থ প্রিমিয়াম হিসেবে জমা করেছে। (ফাতাওয়ায়ে উসমানী, ৩/৩৩৫)
প্রশ্ন নং - ০৬ যদি কেউ লাভের টাকা নিয়ত ছাড়া দানের উদ্দেশ্যে খরচ করার মানসে বিমা করে তাহলে জায়েয হবে কী?
উত্তরঃ- এ সুরতেও বিমা করা জায়েয হবে না। (জাওয়াহিরুল ফিকহ, ২/২৩৭)
প্রশ্ন নং - ০৬। কোন মুসলমান দারুল হারবে অবস্থান করে। তার জন্যে কি দারুল হারব অর্থাৎ অমুসলিম রাষ্ট্রের বিমা কোম্পানিতে শরীক হওয়া ও মুনাফা গ্রহণ করা জায়েয হবে?
উত্তরঃ- দারুল হারবে কাফেরদের সাথে عقود فاسدہ এর অনুমতি অন্যান্য ইমামগণ দিলেও ইমামে আযম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি নাজায়েয বলেছেন। ইমা
আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি জায়েয হওয়ার জন্যে একটি শর্ত উল্লেখ করেছেন। তাহল কোন মুসলমান তাতে শরীক থাকতে পারবে না। উপরোন্তু সুদ ও জুয়ার হুরমত কুরআনের নসের মাধ্যমে সাব্যস্ত। সুতরাং দারুল হারবেও এ সকল।চুক্তি থেকে বিরত থাকা কর্তব্য। হ্যাঁ, অনোন্যপায় হলে ভিন্ন কথা।
(জাওয়াহিরুল ফিকহ, ৩/১৮৬, ২৩২
প্রশ্ন নং - ০৮। Mutual Insurance তথা পারস্পরিক সহযোগিতা বিমার বিধান কী?
উত্তরঃ- মিউচুয়াল ইন্স্যুরেন্সে যেহেতু ব্যবসার উদ্দেশ্য থাকে না। বরং পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহায়তা করা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে আর এ ক্ষেত্রে জমাকৃত টাকার মালিক হয় ফাণ্ড। সুতরাং এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। ইসলাম একে অপরকে সহায়তা করতে উৎসাহ প্রদান করেছে। সুতরাং বিমার এ সুরতটি সর্বসম্মতভাবে জায়েয। তবে প্রত্যেক জায়েয বস্তু ততক্ষণ জায়েয হিসেবে বাকী থাকে যতক্ষণ তাতে শরীয়ত পরিপন্থী কোন শর্তের অনুপ্রবেশ না ঘটে। এজন্য দিকটা খেয়াল রাখা বেশ জরুরী।
(ইসলাম আওর জাদীদ মাআশী মাসায়েল, ৩/৩১৩)
কমার্শিয়াল বিমার বিকল্প শরয়ী রূপরেখা
এ যাবত আলোচনায় বিমা শরীয়তসম্মত না হওয়ার বিষয়টা যেমন সুস্পষ্ট হয়েছে তেমনি মানুষের প্রয়োজনীয়তাও ফুটে উঠেছে। এ জন্যে মানুষের প্রয়োজন পূরণের স্বার্থে বিমার বিকল্প ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত অপরিহার্য ও জরুরী বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। উলামায়ে কেরাম পারস্পরিক সহযোগিতা বিমাকে কমার্শিয়াল বিমার বিকল্প হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। এই মিউচুয়াল ইন্স্যুরেন্স বা পারস্পরিক বিমার পরিশোধিত ও উন্নত রূপায়নই হল "শিরকাতে তাকাফুল" যা বিভিন্ন ইসলামী রাষ্ট্রে আত্মপ্রকাশ করেছে। যা তাকাফুলে ইসলামী "شركاة التكافل الاسلامي" নামে প্রসিদ্ধ।
তাকাফুলে ইসলামীঃ- আল্লামা তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহু শিরকাতে তাকাফুলে ইসলামীর গঠনপ্রণালী ও কার্যক্রম যেভাবে উল্লেখ করেছেন তার সারমর্ম নিম্নরূপঃ- শিরকাতে তাকাফুলে ইসলামির মূল ভিত্তি হবে অনুদান ও সহায়তা প্রদান। বিনিময় চুক্তি কোন উদ্দেশ্য হতে পারবে না। কিছু লোক মিলে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে যে মূলপুঁজি হবে তা হালাল ব্যবসায় লাগাবে। তারা গ্রাহকদের থেকে যে প্রিমিয়াম সংগ্রহ করবে তাও হালাল ব্যবসায় লাগাবে। অতপর সেই ব্যবসার লাভ থেকে একটি ভিন্ন ফাণ্ড তৈরি করবে এই উদ্দেশ্যে যে, কেউ ক্ষতিগ্রস্থ হলে তাকে এই ফাণ্ড থেকে সাহায্য-সহায়তা করা হবে। যাকে তাকাফুল ফাণ্ড বলে অভিহিত করা হবে। এই ফাণ্ড থেকে শেষ সময় পর্যন্ত সহায়তা করার পর কিছু অবশিষ্ট থাকলে সেটা চাইলে শরীকদের মাঝে বণ্টন করে দিতে, আবার চাইলে তা দান করতে পারে। তবে বিশুদ্ধ পন্থা হল 'তাকাফুল ফাণ্ড' দানের জন্যে ওয়াকফ করে দিবে। এ পদ্ধতিতে দুবাই, বাহরাইন ও তিউনিসিয়ার কিছু ইসলামী বিমা কোম্পানি প্রচলিত আছে।
বিমার বিকল্প হিসেবে মাওলানা আবুল ফাতাহ মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া দামাত বারাকাতুহু সুন্দর একটি রূপরেখা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, "পারস্পরিক সহযোগিতা বিমাই হচ্ছে প্রচলিত বিমার বলিষ্ঠ বিকল্প। পারস্পরিক সহযোগিতা বিমাকে ব্যাপক ভিত্তিতে সবক্ষেত্রে চালু করা গেলে এবং বৃহৎশিল্প, ক্ষুদ্রশিল্প, কৃষিকর্ম, চাকুরিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষ পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা গেলে; কমার্শিয়াল বিমা দ্বারা জনগণের ও অর্থনীতিতে যে কল্যাণ হয় বলে মনে করা হয় তা সহজে অর্জন করা সম্ভব হবে। অবশ্য এর জন্যে সরকারী আইন, তত্ত্বাবধান ও আর্থিক সহযোগিতার প্রয়োজন হবে।
বৃহৎশিল্প, ক্ষুদ্রশিল্প ও কৃষিকর্মের ময়দান পর্যন্ত পারস্পরিক সহযোগিতা বিমার যে রূপরেখা দাঁড়াবে, তা নিম্নরূপঃ-
একটি সুষ্ঠু ও ব্যাপক পরিকল্পনার আওতায় সরকারী তত্ত্বাবধানে সরকারী প্রতিনিধি, অর্থনীতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি, শিল্প মালিক প্রতিনিধি এবং কৃষি ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কেন্দ্রীয় পারস্পরিক সহযোগিতা সংস্থা গঠন করা হবে। সংস্থার লক্ষ্য হবে নিম্নরূপঃ-
১. সারাদেশে গ্রামীণ অবকাঠামো পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মাঝে বিভিন্ন পর্যায়ে সহযোগিতা সংস্থা গড়ে তোলার জন্যে একটি করে সুষ্ঠু সুচিন্তিত রূপরেখা প্রণয়ন করত তার ব্যাপক প্রচার করা এবং ক্ষুদ্র ইউনিট পর্যায়ে পারস্পরিক সাহায্য সংস্থা গড়ে তুলে সেগুলোকে শ্রেণীভিত্তিক নেটওয়ার্কের আওতায় এনে কেন্দ্রীয় সংস্থার সংশ্লিষ্ট করা।
২. দুর্ঘটনা কবলিত ব্যক্তিদের পুঁজি যোগদানের ব্যবস্থা করা। এজন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা।
৩. মজুর শ্রেণীর মানুষের অভাব-অনটনে সুদমুক্ত সাময়িক ঋণদানের ব্যবস্থা করা।
৪. দেশে বেকার সমস্যা নিরসনের পন্থা উদ্ভাবন করা।
৫. ব্যবসায়িক বিপর্যয় রোধে জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ।
৬. আর্থিক সংকটকালে সরকারকে সুদবিহীন সহযোগিতা করা।
৭. প্রাকৃতিক বিপদে ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তা প্রদান ইত্যাদি।
উপরিউক্ত মূলনীতির আলোকে পেশাভিত্তিক লোকদের সমন্বয়ে আলাদা সহযোগিতা সংস্থা গড়ে তোলা।
উপসংহার
মোদ্দাকথা হল ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী এ ধরণের সহযোগিতা সংস্থা গড়ে তুললে এর দ্বারা মানুষ জুলুমাত্মক শোষণ থেকে মুক্তি পাবে। আবার ক্ষতিপূরণ পাওয়া ও দুর্যোগ মোকাবেলা করার ব্যাপারে নিশ্চয়তা লাভ করবে। তদুপরি ভবিষ্যতের জন্যে তাদের সঞ্চয়ও জমা হবে। কিছু কিছু দেশে ইসলামী বিমা বা ইসলামী তাকাফুল ইত্যাদির নামে এ ধরণের সহযোগিতা সংস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা হচ্ছে। এ চেষ্টা সফল হলে মানুষ হারাম বিমা থেকে মুক্ত থাকার বিকল্প পথ সহজে পেয়ে যাবে। তাদের সে প্রচেষ্টা সফল হোক এবং মানুষ তার মাধ্যমে হারাম বিমা থেকে বেঁচে থাকুক। মহান আল্লাহ তৌফিক দান করুন।
প্রত্যায়নঃ-
মুফতি মুহাম্মাদ জাহাঙ্গীর হুসাইন সাহেব
সিনিয়র মুফতি, জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া টঙ্গী, পূর্ব আরিচপুর, গাজিপুর
অত্যন্ত তথ্যবহুল একটি প্রবন্ধ। ধন্যবাদ..
উত্তরমুছুনখুব ভাল লেখা
উত্তরমুছুনচমৎকার লিখেছেন শায়েখ!
উত্তরমুছুনমাশাআল্লাহ
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনবিভিন্ন অংশে ভাগ করে পোষ্ট করার পর সবগুলোর লিংক দিয়ে একটি সূচিপত্র তৈরি করে দেওয়া উচিত।
উত্তরমুছুনعفوا
মাশাল্লাহ
উত্তরমুছুন