সোমবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৮

সৌদির পরিবর্তনের নেপথ্যে : আমাদের করণীয়

মুহাম্মাদ বিন সালমান। বর্তমান সৌদির ক্রাউন প্রিন্স ও উপপ্রধানমন্ত্রী। আধুনিক সৌদির জনক আবদুল আজিজ ইবনে সৌদ এর সন্তান সংখ্যা ছিলো প্রায় একশত এবং তাদের মধ্যে ৪৫ জন ছেলে। ছেলেদের মধ্যে পঁচিশতম সন্তান বর্তমান সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজের বড় সন্তান হলেন এই ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মাদ বিন সালমান।

২০১৭ সালে তৎকালীন ক্রাউন প্রিন্স বর্তমান বাদশাহ সালমানের ভ্রাতুষ্পুত্র মুহাম্মাদ বিন নায়েফকে অপসারিত করে আপন ছেলে মুহাম্মাদকে সৌদির ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে ঘোষণা করেন, আর সেই থেকেই সৌদিতে পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করে। প্রথম প্রথম আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকগণ এটাকে বসন্তের পরিবর্তনের হাওয়া নামে অভিহিত করলেও ধীরে ধীরে তা বাংলার বৈশাখী ঝড়ো হাওয়ায় রূপান্তর হয়েছে তা স্পষ্ট। সে হাওয়া কেবল কিছু গতানুগতিক কথিত নারী পরাধীনতার দেয়াল ভেঙ্গেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ইসলামী সংস্কৃতির মহীরুহও জড়সহ উপড়ে ফেলার কাজে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। রক্ষণশীল একটা দেশ যা দীর্ঘদিন ধরে সারা পৃথিবীর সাংস্কৃতিক পরিবর্তন থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছে, দুই শতক ধরে যে দেশে ইসলামী সভ্যতা ও কালচার-ই প্রধান ও জাতীয় কালচার হিসেবে স্থান পেয়েছে, এখন হঠাৎ কোন কারণে সৌদিকে আমূল পরিবর্তন হতে হচ্ছে? এর উত্তর জানার আগে দুইটা বিষয় জানতে হবে। প্রথমতঃ সৌদিতে কোন ধরণের পরিবর্তনের ধারা চালু হয়েছে তা আর এটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারলেই দ্বিতীয় বিষয় 'কেন এই পরিবর্তন' তা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

সৌদিতে মুহাম্মাদ বিন সালমানকে ক্রাউন প্রিন্স ঘোষণার পর থেকে প্রধান প্রধান যে পরিবর্তন হয়েছে তার কিছু নিম্নরূপঃ-

১. নারী ক্ষমতায়ন হিসেবে নারীর ড্রাইভিং বৈধতা, গ্যালারীতে বসে খেলা দেখার স্বাধীনতা, রেড সি'তে পর্যটকদের জন্য বিলাসবহুল আবাসনের ব্যবস্থা, যার অর্থ হচ্ছে নারীরা সেখানে বিকিনি পরতে পারবেন।

২. রেড সিতে পর্যকটদের সুবিধার জন্যে আরেকটি উন্নয়ন হলো উন্মুক্ত বিয়ার বার। বাংলা ভাষায় মদের খোলা দোকানের ব্যবস্থা।

৩. ক্রাউনপ্রিন্স ও মসজিদুল হারামের সাবেক তারাবীহ ইমাম, সৌদি দায়ী শায়েখ আদিল আল-কালবানী কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে তাশ খেলার অনুমতি প্রদান এবং তাশ চ্যাম্পিয়ানশিপদের মাঝে তাশ কার্ড বিতরণ করা।

৪. ক্রাউন প্রিন্সের 'ভিশন ২০৩০' এর অনুযায়ী সৌদির বিনোদন খাতকে সমৃদ্ধ করতে রাজধানী রিয়াদের কিং আবদুল্লাহ ফিন্যান্সিয়াল জেলায় গানের কনর্সাটের জন্য বানানো একটি হলে প্রথমে "ব্লাক প্যানথার" নামক সিনেমা প্রদর্শন করা। সেই সাথে এবার গ্রীষ্মেই আরও তিনটি পর্দা যুক্ত করা এবং আগামী পাঁচ বছরে ১৫টি শহরে ৪০টি ও পরের সাত বছরে ২৫টি শহরে ৫০ থেকে একশটি সিনেমা হল নির্মাণ করা।

৫. আরব-ইসরাইল যুদ্ধে আরবদের শোচনীয় পরাজয়ের পর থেকে সৌদি ইসরাইলকে গাসেব বা অবৈধ রাষ্ট্র দখলকারী আখ্যা দিয়ে আসছিল৷ কিন্তু, এখন প্রকাশ্যভাবে ইসরাইলের নিজ ভূমির মালিকানার স্বীকৃতি দিচ্ছে। অতিসম্প্রতি ক্রাউন প্রিন্স বৃটেন সফর করেন৷ দ্যা আটলান্ট্রিক নামক এক ইন্টারভিউতে (সাক্ষাৎকার)তিনি ইসরাইলের স্ব-ভূমির মালিকানার কথা স্পষ্টভাবে স্বীকার করেন৷

৬. দূর্নীতির অভিযোগে আল-ওয়ালিদ বিন তালাল সহ বেশকিছু ধনকুবের রাজকুমারদের বন্দি করা। পরবর্তীতে তাদের উপর কিছু বিধি-নিষেধ জারি করে চড়া মূল্যের বিনিময়ে তাদেরকে মুক্তি দেয়া। ইত্যাদি।

উপরিউক্ত নাটকীয় পরিবর্তনগুলো লক্ষ করলে এবং ভাতিজাকে অপসারণ করে নিজ ছেলেকে ক্রাউন প্রিন্স ঘোষণার প্রতি খেয়াল করলে বুঝা যায়, ভিশন-২০৩০ এর দ্বারা সৌদি প্রিন্সের বুলি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সমৃদ্ধকরণ ও রক্ষণশীল ধর্মচর্চায় পরির্তন আনয়ন হলেও সমালোচকরা এটাকে নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করা ও একনায়কতন্ত্র স্থাপনের নেহাত প্রচেষ্টা ছাড়া ভিন্ন কিছুই দেখছেন না। ইসরাইলকে স্বভূমির মালিক ঘোষণা করে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স কেবল ইসরাইল, পশ্চিমা দেশসমূহ ও কিছু আরব দেশের খুব ঘনিষ্টতা অর্জন করার প্রচেষ্টাই করছেন। যা তার পরবর্তি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে প্লাস পয়েন্ট হিসেবে কাজ করবে। নারী ক্ষমতায়ন,  অর্থনৈতিক সংস্করণ ও বিনোদন শিল্প সমৃদ্ধির দ্বারা পরিবর্তন মননশীল সাধারণ সৌদি নাগরিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে রাখছেন। যা তার একনায়কতন্ত্র কায়েমে বিরাট ভূমিকা রাখতেই পারে।

সৌদি আরবে পরিবর্তনের কারণ আরো পরিষ্কার বুঝতে হলে সামান্য পেছনের কিছু ইতিহাসের দিকে ঘুরে তাকাতে হবে।
আজিজ আল সউদ ১৯০২ সাল থেকে প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেন তৃতীয় সৌদি রাজত্ব। ১৯৫৩ সালে তার মৃত্যুর আগে এই রাজত্ব তিনি সম্প্রসারিত করেন পারস্য উপসাগর থেকে লোহিত সাগর এবং ইরাক থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত। পূর্বেই উল্লেখ হয়েছে যে  এই বাদশাহর ছিলো ৪৫ জন পুত্রসন্তান। তিনি চাইছিলেন ক্ষমতা একজনের হাত থেকে আরেকজনের হাতে ঘুরতে থাকবে। তখন তারা একেকজন একেক গোষ্ঠীর নেতা হয়ে উঠলেন।

তাদের ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখারও ব্যবস্থা ছিলো তখন। একারণে বিভিন্ন বিষয়ে ক্ষমতা তাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিলো। এভাবেই চলে আসছিলো দশকের পর দশক। খুব ধীর গতিতে কিছু পরিবর্তনও ঘটছিলো। এসবের বেশিরভাগই ছিলো স্থিতিশীল।

সৌদি আরবের এখনকার বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ। তার ভাইদের বেশিরভাগই ইতোমধ্যে মারা গেছেন। ফলে বোঝাই যাচ্ছে যে রাজত্ব এখন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরের সময় চলে এসেছে। বাদশাহর ভাতিজা মোহাম্মদ বিন নায়েফ ২০১৫ সালে হলেন নতুন যুবরাজ। ফলে এটা নিশ্চিত হয়ে যায় যে সিংহাসন আল-সউদ রাজ পরিবারের ভিন্ন শাখার দিকে প্রবাহিত হতে চলেছে।

অসুস্থ ও বয়োবৃদ্ধ বাদশাহ সালমান তখন তার উচ্চাকাঙ্ক্ষী সন্তান মুহাম্মাদকে তড়িঘড়ি করে ডেপুটি যুবরাজ হিসেবে ঘোষণা করেন। এর দু'বছরের মধ্যেই মোহাম্মদ বিন নায়েফকে উৎখাত করেন বাদশাহ সালমান। এরপর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হয়ে উঠেন তারই ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমান। ফলে এই রাজ পরিবারে যেভাবে সিংহাসনের উত্তরাধিকারের পরিবর্তন হয়ে আসছিলো সেই প্রথা ভেঙে যায়।

এরপরই বদলে যেতে শুরু করে সবকিছু। নতুন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান রাতারাতি তার প্রতিদ্বন্ধীদের আটক করে জেলে ভরতে শুরু করেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন অত্যন্ত বিত্তশালী ব্যবসায়ীরা। এমনকি ন্যাশনাল গার্ডের প্রধানও। সব ক্ষমতা চলে আসলো এক ব্যক্তির হাতের মুঠোয় যা সৌদি রাজ-পরিবারে কখনো ছিলো না। (তথ্যসূত্র: বিবিসি)

সৌদির পরিবর্তনে আমাদের করনীয়ঃ

উপরিউক্ত আলোচনায় বুঝে আসে সৌদির এত ব্যাপক পরিবর্তন-পরিবর্ধন আট দশটা দেশের মতই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যে। এ হিসেবে আট দশটা দেশের রাজনৈতিক সমস্যার মতই আমাদের গ্রহণ করা দরকার ছিলো। কিন্তু সৌদির এসব পরিবর্তনকে নিছক রাজনৈতিক পরিবর্তন হিসেবে মানতে  প্রধান বাঁধার বিষয় হচ্ছে দেশটা সৌদি আরব। এটা এমন দেশ যেখানে সাইয়েদুল আম্বিয়া দোজাহানের মুক্তির দিশারী জন্মগ্রহণ করেছেন। যেদেশের মানুষগুলো বুকের তাজা রক্ত বিলিয়ে ইসলামের বাণী দিকে দিকে প্রচার করেছে। যাদের ত্যাগের বিনিময়ে সূর্যোদয়ের দেশসহ সুর্যাস্তের দেশে আল্লাহর কালাম গুঞ্জরিত হয়। ইসলামের দুই মহাপবিত্র মসজিদ যে দেশের ভূমিতে অবস্থিত। যে দেশের মাটিতে শুয়ে আছে উম্মতের কাণ্ডারি দয়ার নবী জ্বনাব মুহাম্মাদে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

এসকল কারণে স্বভাবতই আরবের সাথে বিশ্ব মুসলিমের মুহাব্বত ও ধর্মীয় বিশ্বাস ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এছাড়াও আরব জাতি হিসেবে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে বিশেষ মর্যাদাও দান করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
عن أبي هريرة قال قال رسول الله  صلى الله عليه وسلم: إن الله حين خلق الخلق بعث جبريل، فقسم الناس قسمين، فقسم العرب قسما، وقسم العجم قسما، وكانت خيرة الله في العرب، ثم قسم العرب قسمين، فقسم اليمن قسما، وقسم مضر قسما، وقسم قريشا قسما، وكانت خيرة الله في قريش، ثم أخرجني من خير ما أنا منه . قال الهيتمي في مبلغ الأرب : سنده حسن

অর্থঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ তায়াল যখন মাখলুকাত সৃষ্টি করলেন হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামকে প্রেরণ করলেন। তিনি সমস্ত মানুষকে আরব ও অনারব হিসেবে দুইভাগে বিভক্ত করলেন। আর আল্লাহর বাছাই উদ্দেশ্য ছিলো আরবের মাঝে। অতঃপর আরবকে বিভক্ত করলেন। য়ামানকে একভাগে পরিণত করলেন, মুযারকে এক ভাগে ও কুরাইশকে একভাগ বানালেন। অতঃপর আমাকে আমার স্বজাতির উত্তম ভাগ থেকে প্রেরণ করলেন। (তাবরানী, হাদীস নং- ৩৯২৮)

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
عن سلمان قال قال لي رسول الله صلى الله عليه وسلم:  يا سلمان؛ لا تبغضني فتفارق دينك. قلت: يا رسول الله كيف أبغضك وبك هدانا الله! قال: تبغض العرب فتبغضني قال: هذا حديث حسن غريب  وقال الحاكم: هذا حديث صحيح الإسناد ولم يخرجاه

অর্থঃ হযরত সালমান রাজিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, "হে সালমান! তুমি আমার সাথে বিদ্বেষ পোষণ করো না। নচেৎ তুমি তোমার দীনকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে।" আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কীভাবে আমি আপনার সাথে বিদ্বেষ পোষণ করবো? অথচ আপনার মাধ্যমেই আল্লাহ আমাদেরকে হেদায়েত দান করেছেন। তিনি বললেন, "আরবের সাথে বিদ্বেষ পোষণ করাই হলো আমার সাথে বিদ্বেষ পোষণ করা।" ( তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং ৩৮৯২, মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং ২৩০৯৯, আল মুস্তাদরাক, হাদীস নং ৭০৬৩, মুসনাদে বাযযার, হাদীদ নং ২২২৪)

আরবদের ফজলতের ব্যাপারে এরকম আরো কিছু রিওয়ায়েত বর্ণিত আছে যার ভিত্তিতে অন্যান্য জাতির উপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। তাই সেই আরবে গায়ে এমন দুঃখজনক পরিবর্তন অন্য সকল মুসলমানের অন্তরে কুঠারাঘাত একটু বেশিই করে। আল্লাহ তায়ালা আরবের অবস্থা খুব দ্রুত সংশোধন করে দিন। পরিবর্তনশীল আরবের ব্যাপারে আমাদের মনোভাব কী থাকবে এব্যাপারে আল্লামা ইবনে বাযের নিম্নোক্ত ফাতাওয়া থেকে ধারণা নিতে পারি। শায়খ বলেন,
ثم العرب لهم مزية من جهة أنهم رهط النبي ﷺ، وأن الله بعثه فيهم وبعثه بلسانهم، فلهم مزية من هذه الحيثية أنهم حملوا الإسلام وهم رهط النبي ﷺ، وهم أول من حمل الإسلام ونشره بين الناس فلهم مزية ولهم حق من هذه الحيثية............... أما العرب الكفار لا، لا حق لهم في هذا، وهكذا العجم الكفار لا حق لهم في هذا، إنما هذا في العرب الذين تحملوا الإسلام ونشروه بين الناس وعلموه الناس وجاهدوا في سبيل الله حتى دخل الناس في دين الله أفواجاً، فلهم مزية

অর্থঃ "আর আরবের ফজিলত হলো এই হিসেবে যে তারা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাই ওয়া সাল্লামে গোত্র। আল্লাহ পাক তাঁকে তাদের বংশে তাদের ভাষায় প্রেরণ করেছেন। আবার একারণেও তাদের ফজিলত রয়েছে যে, তারাই সর্বোপ্রথম দীনের সংরক্ষণ ও প্রচার প্রসার করেছেন।.....
আর আরব কাফেরদের বেলায়? না, এই ফজিলতের বেলায় তাদের কোন অধিকার নেই। যেমন অনারব কাফেরদের জন্যে এই ফজিলত নেই। এটা হলো ঐসকল আরবদের ব্যাপারে যারা ইসলামের সংরক্ষণ করেন। প্রচার প্রসার করেন। আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেন।" (ফাতাওয়ায়ে ইবন বায)

এই ফাতাওয়ার ভিত্তিতে আমরা বলবো, আরবদের মধ্যে যারা ইসলাম ও মুসলমানের জন্যে কল্যাণকর কাজ আঞ্জাম দিবেন তারা আমাদের মাথার মুকুট হয়ে রইবেন আর যারা ইসলাম বিদ্বেষী কাজ কর্ম চালিয়ে যাবেন, হোক না সে আরব; আমরা প্রথমে তার ব্যাপারে আল্লাহর কাছে হেদায়েতের দুয়া করবো। হেদায়েত নসীবে না থাকলে এমন সাইয়েদের কামনা করবো যার নেতৃত্বে আরব ও আজমে ইসলামের বাণী সুরক্ষিত ও সুউচ্চ থাকবে।

৩০০৪১৮, সিরাজগঞ্জ

শনিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৮

বিবাহকে ত্বরান্বিত করি।

আগে গ্রাম দেশে একটা কথা প্রচলিত ছিলো, এমনকি এর প্রয়োগও ছিলো অনেকাংশে।
“বাদাইম্মা পোলারে বিয়া দাও, দেখবে সব ঠিক হইয়া যাইবো”।
দেখা যেত, যারা সমাজ সংসারে বা কাম কাজে অমনোযোগী ছিলো, বিয়ের পর সংসার বাচ্চা নিয়ে বেশ দায়িত্বশীল হয়ে ওঠে। সে তুলনায় আজ বড় অসমতা বিরাজ করছে জগত সংসারে।

নিম্নবিত্তের কথা না হয় বাদই দিলাম। বর্তমানের উন্নয়নশীল বাংলাদেশের একজন মধ্যবিত্তের সন্তানকে বিবাহ মালা গলায় দিতে ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশটা বছর অপেক্ষা করতে হয়। পঁচিশ থেকে ত্রিশ বছর যায় লেখা পড়া আর চাকরীর খোঁজে। এরপর দু চার বছর যায় বিয়ের খরচ আর সংসার গোছাতে। উপরোন্তু যদি হয় সে বাপের বড় ছেলে তবে তো কথাই নেই। ছোটদের পড়ালেখার গুরুদায়িত্বও বর্তায় তার কাঁধে। এভাবেই বড় ছেলেটিকে বিয়ের পিঁড়িতে পঁয়ত্রিশের ঝুনা হাড় নিয়ে বসতে হয়।

অথচ একটা ছেলে সাবালক হয় পনের বছরেই। এরপর তাকে আরো পনের বিশ বছর শারীরিক চাহিদা হয় পুষে রাখতে হয়, না হয় অবৈধ পন্থায় মেটাতে বাধ্য। আজ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ছেলের প্রতি কেন এই অবিচার? তার অপরাধ কী এটাই যে সে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে চেয়েছে। অথচ তার সমবয়সী অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত সহপাঠিরা অনেক আগেই বিয়ে করে দুই সন্তানের জনক হয়ে গোঁফে তা দেয়।

এডুকেশন পদ্ধতির এই বলির শিকার বহু শিক্ষার্থী রয়েছে যারা না পারে কিছু করতে। না পারে কিছু বলতে, না পারে পিছু হটতে।। এডুকেশন সিস্টেমটা কি আরো শর্ট করে আনা যায় না? ১৮-২০ বছরে জরুরী পড়ালেখা শেষ, চাকুরী পাবে ২২ বছরে, সবগুছিয়ে বিয়ে করবে ২৫ বছরে, আর যার সামর্থ আছে, সে সুযোগ পেলেই বিয়ে করে ফেলবে।

এখানে বিয়ের ব্যাপারটা গুরুত্ব পাচ্ছে কয়েকটা কারণে।
১. ধর্মীয় কারণ। হ্যাঁ, একটা ছেলের যখন পঁচিশ বছর বয়স হয়ে যায় স্বভাবতই সে তার জৈবিক চাহিদা নিবারণে কার্যকরী হয়ে পড়ে। দীর্ঘ এক সময় তার শারীরিক চাহিদাকে দাবিয়ে রাখলেও নির্দিষ্ট সময়ের পর আর সম্ভব হয় না। তখন সে বৈধ পন্থার অবর্তমানে অবৈধ উপায়ে চাহিদা নিবারণ করে। এজন্যই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিবাহের প্রতি উৎসাহিত বলেন, হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মাঝে যারা বিয়ে করতে সক্ষম তারা যেন বিয়ে করে নেয়। কারণ বিয়ে দৃষ্টি অবনত রাখতে এবং গুপ্তাঙ্গের পবিত্রতা রক্ষায় অধিক সহায়ক আর যে বিয়ে করতে সক্ষম নয় সে যেন রোযা রাখে। কেননা রোযা তার যৌনক্ষুধাকে দমিত করবে। [বোখারি:২/৭৫৮,মুসলিম:১/৪৪৯, ইবনে মাজা:১৩২]
রাসূলুল্লাহ সা. আরও ইরশাদ  করেন- তিন শ্রেণীর লোককে আল্লাহ অবশ্যই সাহায্য করবেন-১. স্বাধীন হওয়ার চুক্তিতে আবদ্ধ গোলাম, যে নিজ মুক্তিপণ আদায়ের ইচ্ছা রাখে, ২. চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষার উদ্দেশ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ব্যক্তি, ৩. আল্লাহর পথে জিদাহকারী। [তিরমিযী:২/২৯৫;৪; নাসায়ী:২/৫৮;ইবনে মাজা;১৮১]
অন্য এক বর্ণনায় আনাস রা. বলেন, মহানবী সা. ইরশাদ করেছেন- কোন ব্যক্তি যখন বিয়ে করল তখন সে যেন দ্বীনের অর্ধেকটা পূর্ণ করে ফেলল। এখন সে যেন বাকী অর্ধাংশের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করে। [মিশকাত:২/২৬৮]
উপরোক্ত হাদীসগুলো দ্বারা বুঝা যায় একজন মুসলিম যুবকের ঈমান ও আমলের হেফাজতের জন্যে বিয়ে অত্যন্ত কার্যকরী একটি উপায়। অশ্লীলতায় ভরপুর সমাজের রন্ধ্র রন্ধ্র যখন কামনার অগ্নিবেড়ায় আবদ্ধ তখন তেজস্বান কোন্ নরের সাধ্য আছে তা এড়িয়ে চলার? অতএব এটাই কি ভাল নয় যে, সে আগুন নির্বাপিত হবে বিবাহ নামক শুদ্ধ জলে!

২, যৌক্তিক ও বাস্তব অভিজ্ঞতা দাবী। হ্যাঁ, বাস্তবতার দাবীও বিবাব বিধানকে ত্বরান্বিত করা। বহমান এ কুরুচিপূর্ণ সময়ে যৌন সামগ্রী সহজলভ্যতার সূত্রধরে আজ অনেক যুবকই সেক্সুয়াল ফ্রাস্টেটেড। প্রেম ভালোবাসাসহ  উল্টাপাল্টা কিছু করতে গিয়ে পড়ালেখায় মনযোগ হারাচ্ছে। মনযোগ আনতে এখন মোটিভেশনাল স্পিচ নিচ্ছে। আজকাল মোটিভেশনাল স্পিচ এত মার্কেট পাচ্ছে কাদের কারণে?
এখন যদি শিক্ষাব্যবস্থায় এমন পরিবর্তন আনা যায়, যা দ্বারা মূল শিক্ষাটা আরো সংক্ষিপ্ত সময় লাগবে, প্রফেশনাল ক্ষেত্রে আরো কম বয়সে ঢুকতে পারবে। একইসাথে বিয়ে সুবিধামত করতে পারবে, কোন ধরাবাধা থাকবে না, তবে পুরো সমাজ ব্যবস্থায় আরো অনেক গতিশীলতা আনা সম্ভব।

৩. কিছু দিন আগে তুলনামূলক অল্পবয়সে বিয়ে কিছু ফায়দা পড়েছিলাম। আমার কাছে বেশ ভালই লেগেছিল। আমি বলবো, যদি বিয়েকে ত্রিশের পরে না নেওয়া যায় তবে নিম্নবর্ণিত কিছু উপকারিতাও বোনাস হিসেবে পাওয়া যায়। যেমনঃ

০১. আপনি যদি ৩০ পার করে বিয়ে করেন, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আপনার বয়সের কারণে আপনার মধ্যে যে গাম্ভীর্য চলে আসবে তার জন্য সম্পর্ক খুব বেশি মধুর ও ঘনিষ্ঠ হবে না। ব্যাপারটি বরং এমন হবে যে, বিয়ে করা উচিত তাই বিয়ে করেছি। এ কারণে আগেই বিয়ে করা ভালো। যখন আবেগ কাজ করে অনেক।

০২. বেশি বয়সে বিয়ে করলে স্বামী-স্ত্রী নিজেদের জন্য কতটা সময় পান? বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সন্তানের দায়িত্ব এসে পড়ে। আর সন্তান হয়ে গেলে দু'জনের একান্ত সময় কাটানো খুব বেশি হয়ে ওঠে না। কিন্তু অল্প বয়সে বিয়ে করলে সঙ্গীর সাথে অনেকটা সময় পাওয়া যায়। এতে সম্পর্ক অনেক ভালো ও মধুর থাকে।

০৩. 'একজনের চেয়ে দু'জন ভালো' -বিষয়টি নিশ্চয়ই না বোঝার কথা নয়। একাই সুখ-দুঃখ ভোগ করার চেয়ে দু'জনে ভাগাভাগি করে নিলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। অল্প বয়সে বিয়ে করলে জীবনের সবকিছু ভাগ করে নেয়া যায়। ফলে মানসিক চাপটাও কম পড়ে।

০৪. সন্তানের জন্য খুব ভালো মাতা-পিতার উদাহরণ হতে পারবেন যদি বিয়ে আগে করে ফেলেন। আপনি দেরিতে বিয়ে করলে সন্তান মানুষ করার বিষয়টিও পিছিয়ে যাবে। আর আপনার মানিসকতাও কিন্তু দিনকে দিন নষ্ট হতে থাকবে।

০৫. দুর্ভাগ্যবশত অনেকেই বিয়ের ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তাই এখন ডিভোর্সের সংখ্যাও বাড়ছে। জলদি বিয়ে করার কিন্তু এই দিক থেকেও সুবিধা রয়েছে। যদি অল্প বয়সে বিয়ে করার পর, আল্লাহ না করুন কোনো কারণে যদি সম্পর্ক ভেঙেও যায়, তারপরও জীবনটাকে নতুন করে গুছিয়ে নেয়ার দ্বিতীয় সুযোগ পাওয়া যায়।

০৬. আগে বিয়ে করলে আপনার কাছে এসে কেউ ‘কেন বিয়ে করছ না’, ‘কবে বিয়ে করবে’, ‘বয়স বেড়ে যাচ্ছে।' ‘কাউকে পছন্দ কর কি’ ইত্যাদি বিরক্তিকর কথা শোনার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে যাবেন।

অতএব, আসুন শ্লোগান ধরি,
"পঁচিশের মধ্যেই বিয়ে করি, সমৃদ্ধশালী উম্মত গড়ি।"
😎😎😎😎😎😎😎😎

২৮০৪১৮, সিরাজগঞ্জ

মঙ্গলবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৮

প্রাসঙ্গিককে না বলুন, মৌলিককে নয়

ধর্মীয় পরিভাষার মধ্যে আরেকটি মাযলুম শব্দ হলো "শবে বরাত"। এটি এমন এক পরিভাষা যাতে উভয়পক্ষীয় বাড়াবাড়ি সমহারে বিদ্যমান। যারা "শবে বরাত"কে ছেড়ে দিতে চান, তারা এই রাতের উৎস ফজিলত ও সিদ্ধিতার জলাঞ্জলি দিয়ে বলেন, শবে বরাত বলতে শরীয়তে কিছুই নেই। এ সম্পর্কে সহীহ কোন রিওয়ায়েত বর্ণিত নেই। আবার যারা এই রাত আকড়ে ধরেছেন তারা তো ফিরনি পায়েস আর হালুয়ার মিষ্টতায় মোহিত করে রেখেছেন। তাদের কাছে শবে বরাত মানে তৃতীয় কোন উৎসব।

শবে বরাতের এই বাড়াবাড়ি আর ছাড়াছাড়িতে মুসলিম উম্মাহের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়, যা কেবল সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয় বরং আকাবীরে উম্মতের কাছে গুরুত্বের সাথে পালনীয়। শবে বরাত যে ফজিলতপূর্ণ একটি রাত এ ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। এ রাতকে ফজিলতের রাত হিসেবে অস্বীকার করা প্রকারান্তরে সহীহ হাদীসকেই অস্বীকার করা। একাধিক রিওয়ায়েতে শবে বরাতের ফজিলত উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন হযরত মুআয ইবনে জাবাল বলেন, নবী করীম স. ইরশাদ করেছেন, "আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।"

উপরোক্ত হাদীসটি অনেক নির্ভরযোগ্য হাদীসের কিতাবেই নির্ভরযোগ্য সনদের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। এ হাদীসটির মান সহীহ। এজন্যই ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে হিব্বান তার কিতাবুস সহীহে ১৩/৪৮১ তে এই হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। এটি এই কিতাবের ৫৬৬৫ নং হাদীস। এ ছাড়া ইমাম বাইহাকী (রহঃ) শুআবুল ঈমানে (৩/৩৮২, হাদীস ৩৮৩৩); ইমাম তাবরানী আল মুজামুল কাবীর ও আল মুজামুল আওসাতে বর্ণনা করেছেন। এ ছাড়াও আরো বহু হাদীসের ইমাম তাদের নিজ নিজ কিতাবে হাদীসটি উল্লেখ করেছেনইমাম মনযিরী, ইবনে রজব, নূরুদ্দীন হাইসামী, কাস্‌তাল্লানী, যুরকানী এবং অন্যান্য হাদীস বিশারদ এই হাদীসটিকে আমলযোগ্য বলেছেন। দেখুন আততারগীব ওয়াততারহীব ২/১৮৮; ৩/৪৫৯. লাতায়েফুল মাআরিফ ১৫১; মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৮/৬৫; শারহুল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যা ১০/৫৬১

বর্তমান সময়ের প্রসিদ্ধ শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী (রহঃ) সিলসিলাতুল আহাদসিস্‌ সাহীহা ৩/১৩৫-১৩৯ এ এই হাদীসের সমর্থনে আরো আটটি হাদীস উল্লেখ করার পর লেখেনঃ

وجملة القول أن الحديث بمجموع هذه الطرق صحيح بلاريب. والصحة تثبت بأقل منها عددا، مادامت سالمة من الضعف الشديد، كماهو الشأن فى هذاالحديث .
"এ সব রেওয়াতের মাধ্যমে সমষ্টিগত ভাবে এই হাদীসটি নিঃসন্দেহে সহীহ প্রমাণিত হয়।" তারপর আলবানী (রহঃ) ওই সব লোকের বক্তব্য খন্ডন করেন যারা কোন ধরণের খোঁজখবর ছাড়াই বলে দেন যে, শবে বরাতের ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীস নেই

শবে বরাত নিঃসন্দেহে অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ রাত। এ রাত্রে আল্লাহ পাক বান্দাদের ওপর বিশেষ অনুগ্রহ দান করে থাকেন। কিন্তু সে অনুগ্রহ পেতে হলে বান্দাদেরকে শরীয়তের গণ্ডির মধ্য থেকে ইবাদাত পালনে মনোযোগী হতে হবে। বড় আফসোস আর দুঃখের কথা হচ্ছে, এত মাহাত্ম্যপূর্ণ রাতকে আমাদের কিছু অবুঝ ভাই নষ্ট করে ফেলেন। তারা যে শরীয়ত বহির্ভূত বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে শবে বারাতের মর্যাদারই কেবল হানী করছেন তা নয়; অবান্তর সেসব কর্মকাণ্ড দেখে চতুর একদল মানুষ খোদ শবে বরাতকেই অস্বীকার করে বসছে। জানি না কী স্বার্থ লুকানো রয়েছে।

আজকাল শবে বরাত উপলক্ষে যেসব ভ্রান্ত বিশ্বাস ও আমল প্রচলিত রয়েছে যেমনঃ "এ রাতে গোসল করাকে সওয়াবের কাজ মনে করা, মৃত ব্যক্তিদের রূহ এ রাতে দুনিয়ায় তাদের আত্মীয়স্বজনের গৃহে আসা, এ রাতে হালুয়া রুটি তৈরী করে নিজেরা খাওয়া ও অন্যকে দেয়া। বাড়ীতে বাড়ীতে এমনকি মসজিদে মসজিদেও মীলাদ পড়া আতশবাযী করা ,সরকারী- বেসরকারী ভবনে আলোক সজ্জা করা । কবরস্থানগুলো আগরবাতি ও মোমবাতি দিয়ে সজ্জিত করা লোকজন দলে দলে কবরস্থানে যাওয়া। লোকজনকে ডেকে ডেকে মসজিদে নিয়ে আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে নামায যিকির-আযকারে লিপ্ত থাকা ইত্যাদি" এজাতীয় কাজ নিঃসন্দেহে পরিত্যাজ্য। কোরআন ও হাদীসের সাথে শবে বরাতের প্রচলিত এইসব আমলের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। (দেখুনঃ ইক‌তিযাউস সিরাতিল মুসতাকীম ২/৬৩১-৬৪১; মারাকিল ফালাহ ২১৯)

তবে 'নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম ও খেলাফতের যামানায় শবে বরাতকে এত আড়ম্বরের সাথে পালন করেননি' একথা যেমন সহীহ, তেমনি একথাও বিশুদ্ধ যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম শাবানের ১৫তম রাত অর্থাৎ শবে বরাতকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন। স্বয়ং নবী করীম সা. এ রাতকে নামায ও দুয়ার মাধ্যমে কাটিয়েছেন এবং উম্মতকে এ রাতের ফজিলত শুনিয়ে ইবাদাতে মশগুল হওয়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে। যেমনটি পূর্বে আমরা জেনেছি।

এছাড়াও উম্মুল মু'মিনীন আয়েশা রা. থেকে আরো একটি রিওয়ায়েত বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (স.) রাতে নামাযে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হল তিনি হয়ত মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, "হে আয়েশা! অথবা বলেছেন, ও হুমাইরা! তোমার কি এই আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন?" আমি উত্তরে বললাম, "না, ইয়া রাসূলাল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার এই আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা।" নবীজী জিজ্ঞেস করলেন, "তুমি কি জান এটা কোন রাত্র?" আমি বললাম, "আল্লাহ ও তার রাসূলই ভাল জানেন।" রাসূলুল্লাহ সা. তখন ইরশাদ করলেন,
‘এটা হল অর্ধ শাবানের রাত (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিবাগত রাত)। আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তার বান্দার প্রতি মনযোগ দেন এবং ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই।‘ [শুআবুল ঈমান, বাইহাকী ৩/৩৮২-৩৬৮]

এ হাদীস দ্বারা বুঝা যায় শাবানের পনেরতম এ রজনীকে রাসূল সা. অনেক গুরুত্বের সাথে দেখেছেন। তাই আমদেরও উচিত সহীহ তরীকায় ইবাদতের মাধ্যমে এ রাত অতিবাহিত করা। শবে বরাতের রাতে করণীয় সম্পর্কে  সহজে বুঝার  আমলগুলো সঠিক পদ্ধতিসহ তুলে ধরা হলো।
এক. এই রাতে কবর যিয়ারত করা যেতে পারে, তবে তা অবশ্যই দলবদ্ধ ও আড়ম্বরপূর্ণ না হয়ে একাকী হওয়া উচিত এবং এই কবর যিয়ারতকে জরুরি মনে না করা।
দুই. শবে বরাতের রাত্রিতে নামায-দুআ, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির-আযকার, দরূদ শরীফ ইত্যাদিতে লিপ্ত থাকা আর এই আমলগুলো নিজ নিজ বাড়িতে একাকীভাবেই করা বাঞ্চনীয়। সম্মিলিতভাবে মসজিদে এসব আমল করা থেকে বর্তমান সময়ে বিরত থাকা জরুরি। সবসময় মনে রাখা চাই, নফল নামায বাড়িতেই পড়া উত্তম আর এ রাতে মসজিদে সমাগম করে সম্মিলিতভাবে আমলের প্রথা যেহেতু ইসলামের প্রাকযুগে প্রচলিত ছিল না। তাই ডেকে ডেকে সকলকে মসজিদে নেওয়া বা মসজিদেই গিয়েই আমল করতে হবে, একে জরুরী মনে করা বিদয়াতের অন্তর্ভুক্ত হবে। হ্যাঁ, যদি এরকম হয় যে, কোথাও কোন মসজিদে ডাকা ছাড়াই দু চার জন লোক একত্রিত হয়ে প্রত্যকেই ভিন্ন ভিন্নভাবে আমলে লিপ্ত থাকে অথবা বাড়িতে উপযুক্ত পরিবেশ না থাকায় কেউ মসজিদে গিয়ে আমলে মাশগুল থাকে তাহলে এটা কোনভাবেই বিদয়াতের পর্যায়ে হবে না। (বিষয়টা সুস্থ মস্তিষ্কে বুঝার অনুরোধ রইল)

তিন. শবে বরাতের পরের দিন অর্থাৎ ১৫ই শাবান রোযা রাখা মুস্তাহাব সুনানে ইবনে মাজাহ এ পনেরো শা‘বান রাত সম্পর্কে উল্লেখিত হয়েছে : "এই রাত জেগে ইবাদত কর এবং দিনে (অর্থাৎ পনেরো শা’বান) রোযা রাখ"

শায়খ আলবানী ‘সিলসিলাতুয যয়ীফা’ (৫/১৫৪) তে এই বর্ণনাকে ‘মওজূউস সনদ’ লিখেছেন।  অনেক ভাই শায়খ আলবানীর এই তাখরিজের উপর ভিত্তি করে পনেরো শাবানের রোযাকে মুস্তাহাব বলতে অসম্মত। কিন্তু বাস্তব কথা হলো পনেরো শাবানের রোযা মুস্তাহাব আর ইবনে মাজাহর উপরোক্ত হাদীসটি ‘মওজু’ তো কখনোই নয়। তবে সনদের দিক থেকে ‘জয়ীফ’। যেহেতু ফাযাইলের ক্ষেত্রে ‘জয়ীফ’ গ্রহণযোগ্য তাই আলিমগণ শবে বরাতের ফযীলতের ব্যাপারে এ হাদীস বয়ান করে থাকেন

শায়খ আলবানী ‘সিলসিলাতুয যয়ীফা’ (৫/১৫৪) তে এই বর্ণনাকে ‘মওজূউস সনদ’ লিখেছেন। অর্থাৎ এর ‘সনদ’ মওজূ। যেহেতু অন্যান্য ‘সহীহ’ বর্ণনা উপরোক্ত বর্ণনার বক্তব্যকে সমর্থন করে সম্ভবত এজন্যই শায়খ আলবানী সরাসরি ‘মওজূ’ না বলে ‘মওজূউস সনদ’ বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। তথাপি শায়খ আলবানীর এই ধারণা ঠিক নয়। সঠিক কথা এই যে, এই বর্ণনা ‘মওজূ’ নয়, শুধু ‘জয়ীফ’। ইবনে রজব রাহ. প্রমুখ বিশেষজ্ঞদের এই মতই আলবানী সাহেব নিজেও বর্ণনা করেছেন
এ প্রসঙ্গে আলবানী সাহেব যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন তা এই যে, এ বর্ণনার সনদে ‘ইবনে আবী ছাবুরা’ নামক একজন রাবী রয়েছেন। তার সম্পর্কে হাদীস জাল করার অভিযোগ রয়েছে। অতএব এই বর্ণনা ‘মওজু’ হওয়া উচিত। তবে এই ধারণা এ জন্য সঠিক নয় যে, ইবনে আবী সাবুরাহ সম্পর্কে উপরোক্ত অভিযোগ ঠিক নয়। তার সম্পর্কে খুব বেশি হলে এটুকু বলা যায় যে, জয়ীফ রাবীদের মতো তার স্মৃতিশক্তিতে দুর্বলতা ছিল। রিজাল শাস্ত্রের ইমাম আল্লামা যাহাবী রাহ. পরিষ্কার লিখেছেন যে, ‘স্মৃতিশক্তির দুর্বলতার কারণেই তাকে জয়ীফ বলা হয়েছে।’ দেখুন সিয়ারু আলামিন নুবালা ৭/২৫০, ( এব্যাপারে আল কাউসারে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। পড়ে দেখার অনুরোধ থাকল)

আলোচনার শেষাংশে এইটুকু বলবো যে,  আল্লাহ যদি তাঁর বান্দাদেরকে ক্ষমা করেন, যদি অসংখ্য লোক আল্লাহর কৃপা লাভ করেন, তবে কোন যুক্তিতে বাধা আসবে? কোন ভাল জিনিসে জটিলতা সৃষ্টিতে কী লাভ? জট বাঁধাতে ইচ্ছে করলে অনেক বিষয়ে ‘সহীহ হাদিস’ টেনেও বাঁধানো যেতে পারে। ঝামেলা সৃষ্টি করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে কুতর্কে আল্লাহ নেই। তিনি সুতর্ক ও বিশ্বাসে ধরা দেন।

যেসব মানুষ এতকাল ধরে শবে বরাত পালন করে আসছে তাদের সামনে বিদ্যার প্যাঁচ মেরে শবে বরাতের গুরুত্ব ও মহিমা খাটো করে ব্যাখ্যা হাজির করা যাবে বটে কিন্তু এতে ধর্মের কোন উপকার হবে না। শুধু এই একটি রাতে কত শত সহস্র লোক আল্লাহর দিকে রুজু হয়ে ইবাদত বন্দেগী করে, আল্লাহর নাম নেয়, নামাজ পড়ে, জিকির আযকার করে। এই সুবাদে তাদের ছেলেমেয়েরাও ইবাদতের এহসাস লাভ করে –কান্নাকাটি করে। কিন্তু বিদ্যার ঠাকুর এসে যদি সে রাতের দুয়ারে তালা লাগিয়ে দেন তবে সর্বসাধারণ কী করবে?

মনে রাখা দরকার যে, যেখানে বিদআতের স্থান নেই সেখানে বিদআত আবিষ্কার করা ঠিক নয়। মধ্য শাবানের রাতে যারা  বিদআত করে, তাদের সেই বিদআতের বিপক্ষেই কথা বলা উচিৎ, সেই ভ্রান্তপন্থা কীভাবে দূর করা যায় তার উপায় অবলম্বন করা উচিৎ। মানুষকে শবে বরাতের বিদয়াত থেকে বাঁচিয়ে রাখা উচিৎ। খোদ শবে বরাত থেকে নয়। এই রাতে নামাজ পড়া, কোরাআন পড়া, মাসনূন দুয়া করা ও জিকির আযকার করা –এসব ঠিক আছে। কিন্তু যারা বর্ণিত তরিকার বাইরে গিয়ে নানান গদবাধা প্রথা তৈরি করে -তা থেকে মানুষকে সতর্ক করা দরকার। খোদ শবে বরাত থেকে নয়
আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন

২৪০৪১৮, সিরাজগঞ্জ

নাভীর নীচের অবাঞ্ছিত লোমের সীমানা

নাভীর নীচের অবাঞ্ছিত লোমের সীমানা হলো : পায়ের পাতার উপর ভর করে বসা অবস্থায় নাভী থেকে চার পাঁচ আঙ্গুল পরিমাণ নীচে যে ভাঁজ বা রেখা সৃষ্টি হয় ...