ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত জনপদের নিথর কায়া যখন ধর্ষণের নাপাক রক্তে রঞ্জিত, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যখন ধর্ষণের ভয়াবহতা নিয়ে সরগরম, ঠিক সেই সময়ে মিডিয়া সেলিব্রেটিরা অভিশপ্ত ধর্ষণ নিয়েই হাসি তামাশায় লিপ্ত। সীমাহীন নির্লজ্জ আর মানসিক রোগাক্রান্ত হওয়া ছাড়া সুস্থ বিবেকসম্পন্ন মানুষের কাছ থেকে এরূপ আশা করা যায় না। তোপের মুখে পড়ে ভুল স্বীকারের নাটক রচে আবার ধর্ষণের হেতু ডাইভার্ট করা অপচেষ্টাও করে। ধিক!
আসি মূল কথায়,
আসলে ধর্ষণের জন্যে দায়ী কী? ধর্মীয় বিজ্ঞজনেরা যখন ধর্ষণের কারণ বলেন, ধর্মীয় অনুশাসন পালন না করা । যেমন, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, অশোভনীয় কুরুচিপূর্ণ পোশাক পরা ইত্যাদি, তখন মুক্তমনারা টেনে আনে হিজাব পরিহিতার উদাহরণ। তারা বলে পোশাক নাকি ধর্ষণের কোন কারণ নয়? মানসিক পরিবর্তনই মূল। যদি সবার মানসিক চেতনার পরিবর্তন ঘটে, নারী যে ভোগ বিলাসের বস্তু নয় তা বুঝতে পারে, তাহলেই ধর্ষণ বন্ধ হয়ে যাবে। পোশাক কোন বিষয় না। উদাহরণ হিসেবে অনেকে পশ্চিমের দেশগুলোর কালচার টেনে আনে।
তাহলে আসলে কি তাই? মানসিক ধারণার পরিবর্তন হলেই ধর্ষণ বন্ধ হয়ে যাবে? বাহ্যত নযরে তাদের এই যুক্তিটা বেশ লোভনীয়। কেমন যেন, বিড়ালের সামনে মাছ ঝুলিয়ে বলা হবে, মনকে পরিশুদ্ধ কর। চেতনা পরিবর্তন কর। এই মাছ তোমার জন্যে নয়।
এখানে একটা প্রশ্ন হয়, যদি মানসিক ধারণার পরিবর্তনই ধর্ষণ বন্ধের জন্যে যথেষ্ট হয়, তাহলে তো সকলেরই চিন্তা চেতনা পরিবর্তন করা দরকার। আর সে জন্যে ধর্ষকের হোতা পুরুষ জাতিকে বলা হবে, তুমি তোমার মনের মধ্যে নারী জাতির প্রতি সম্মান শ্রদ্ধা অর্জন করো। তোমার সামনে একজন নারী আসলে তাকে উত্যক্ত করবে না। বরং তার প্রতি তুমি দৃষ্টিপাতই করবে না। এই চেতনা যখন পুরুষের মাঝে আসবে তখন ধর্ষণ সংগঠিত হবে না। এখন মূল প্রশ্ন, পুরুষের মাঝে এই চেতনা কীভাবে আসবে? বা আসছে না কেন?
আসুন সেই কারণ অনুসন্ধান করি।
লক্ষ করলেই বুঝতে পারবো বর্তমানে আমরা একটা যৌন সমাদৃত পৃথিবীতে বাস করছি। ফেসবুকে ঢুকলেন, দেখবেন বিভিন্ন পেইজে কু-ইঙ্গিতপূর্ণ জোক্স ভাসছে। টিভি বিজ্ঞাপনগুলোতে নারীকে অশ্লীল আকর্ষিত আর মোহময়ী ভঙ্গিমায় উপস্থাপনা করা হচ্ছে। সিনেমাগুলোতে প্রতিটা হিরো কথিত হিরোইনকে উত্যক্ত করে যাচ্ছে যাকে প্রেম আর ভালোবাসার মোড়কে বৈধ করা হচ্ছে। টিভি নাটক আর সিরিয়ালগুলোতে পরকিয়া, অসমঞ্জস্য-অসম প্রেম, লিভ টুগেদার শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। এফএমে ভালবাসার অনুষ্ঠান নামে প্রেম বিদ্যা শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। পুরুষের চোখে নারীকে আকর্ষিত করার জন্যে নায়িকাদের উন্মুক্ত নাভী প্রদর্শিত হচ্ছে। আইটেম সংয়ের নাচ ও কথার মাধ্যমে নারী যে কেবল ভোগের বস্তু তাই সুরেলা কন্ঠে জানানো হচ্ছে। (না হলে আইটেম সং এর কথাগুলো শুনে দেখুন)
ভারতের সমাজবিজ্ঞানীরা তাদের দেশে ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার জন্যে আইটেম সং কে দায়ী করেছেন। এইসব গানে সংক্ষিপ্ত পোশাকে প্রবল শব্দে উচ্চ বাজনায় নাচানাচি হয়। লাইটিং হয় আলো-আঁধারিপূর্ণ। যখন এগুলো দর্শকরা দেখতে থাকে ধীরে ধীরে তার ভেতরের পশুবৃত্তি জেগে ওঠে। সে ভুলে যায় সে মানুষ। দীর্ঘসময় এই গানের রেশ তার মাথায় থেকে যায়। শেষে বিভিন্ন বিকৃত পন্থায় তার এই কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করে!
তাহলে যারা বললেন, পুরুষের চেতনাকে পরিবর্তন করতে হবে। আমার প্রশ্ন, এতকিছুর পর পুরুষ তার চেতনা আর দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে পাল্টাবে?
বিশেষ সময়ে ভার্সিটির রিকশাওয়ালাদের কাউকে ১৫ টাকার জায়গায় ৩০ টাকা দিতে চাইলেও তবু তারা যায় না। কারণ টাইট গেঞ্জি পরা মেয়েদের ভলিবল খেলা তো আর সবসময় দেখতে পাওয়া যাবে না। "মামা, রিকশা তো সারাজীবনই চালাইতে পারবো, কিন্তু এই খেলা প্রতিদিন পাবো না!"
এইসব পুরুষেরা ভলিবল খেলোয়ারদের তো আর কিছু করতে পারে না, তখন সুযোগ বুঝে অন্য মেয়েকে জাপটিয়ে ধরবে।
অফিসের কলিগ যখন জর্জটের ফিনফিনে কাপড়ে ব্যাকলেস সৌন্দর্যে স্নাত হয়ে অনুষ্ঠান এটেন করে তখন রিং পড়া উন্মুক্ত নাভি দেখে এক্সাইটেড হলেও আপনার কলিগকে তো কিছু করতে পারেন না, কিন্ত আপনার সেই পশুবৃত্তি চরিতার্থ করেন অন্যেকে ধর্ষণের মাধ্যমে।
হ্যাঁ, পোষাকের ফ্যাক্ট এটাই। একজনের জন্যে আরেকজন ভিকটিম হয়। পোশাক একমাত্র দায়ী না, তবে পোশাক অবশ্যই একটা কারণ।
হ্যাঁ, পোষাকের ফ্যাক্ট এটাই। একজনের জন্যে আরেকজন ভিকটিম হয়। পোশাক একমাত্র দায়ী না, তবে পোশাক অবশ্যই একটা কারণ।
একটা মেয়ে উলঙ্গ থাকলেও তাকে ধর্ষণের অধিকার কারও নাই। কিন্তু আপনি কে? কাকে অধিকার শিখাতে আসছেন? একটা মেয়ে তার চাহিদামত পোশাক পরতে পারবে। এ অধিকার তার আছে। পুরুষের মানসিকতা পাল্টাতে হবে। মানলাম ঠিক।
কিন্তু কীভাবে এই নীতি বাক্য বলতে আসেন? একটা পুরুষকে ভালো মানসিকতা পোষার পরিবেশ তৈরী করে দিয়েছেন কখনো? নাচ গানে নারীকে ভোগবস্তু বানানো বাদ দিয়েছেন কখনো? পর্নোগ্রাফির অবাধ ব্যবসা করা, দেখা, বা পর্ণ সাইট বন্ধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছেন কখনো? ধর্ষণের শাস্তিতে কঠোর ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করেছেন কখনো? সিনেমাতে অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ বা ধর্ষণ দৃশ্য বাদ দিয়েছেন কখনো?
পুরুষের চারপাশকে যৌনতা আর অশ্লীলতায় ভরপুর করে তাকে আত্মশুদ্ধির ওয়াজ করতে আসেন কোন লজ্জায়?
পুরুষের চারপাশকে যৌনতা আর অশ্লীলতায় ভরপুর করে তাকে আত্মশুদ্ধির ওয়াজ করতে আসেন কোন লজ্জায়?
আমি বলবো, ধর্ষণের জন্যে মূলত তিনটা জিনিস দায়ী। ১. যৌনোত্তেজক পরিবেশ ও অশ্লীল পোশাক পরিচ্ছেদ ২. ধর্মীয় অনুশাসন মেনে না চলা ৩. আইনের যথাযথ প্রয়োগ না করা বা বিচারহীনতা।
পরিশেষে নারীকে লক্ষ করে বলবো, হে নারী! নিজেদের অঙ্গ প্রদর্শন করে পুরুষকে মানসিক রোগীতে পরিণত করো না। তাহলে সে তোমার উপর হামলে পড়বে না। কিছু ভ্রান্ত লোকের বড় বড় থিওরেটিকাল ডায়লগে মুগ্ধ না হই। যুক্তি সবাই দিতে পারে। কিন্তু যার হারায়, যে ভিকটিম হয়, সে বুঝে কত যন্ত্রণা! মুক্তমনা সোসাইটির কেউ যুক্তি দিল, আমি সারারাত বাইরে থাকলেও কেউ ধর্ষণ করার অধিকার নাই, সে কথা শুনে মনের হরষে নৃত্য প্রদর্শন করতে থাকলে। কিন্তু ঘটনা একটা ঘটলে এর দায় এরা কেউ নিবে না। তোমাকে, তোমার ফ্যামিলিকেই ভোগ করতে হবে! যুক্তিতে নয় বুদ্ধি দিয়ে বুঝ আর বেঁচে থাকো।
যুক্তি আর বাস্তবতা এক নয়।
০৩/০৪/২০১৮, রাত ১১:১৮ সিরাজগঞ্জ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন