বিদায়ী ছাত্রদের প্রতি যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা হাফেজ জুনাইদ বাবুনগরী দা.বা. এর খুব জরুরী ৭টি নসীহত...!!
উম্মুল মাদারিস আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারির দাওরায়ে হাদিস সমাপনী ছাত্রদের উদ্দেশ্যে অদ্য ১৪-০৭-১৪৩৯হিজরীরোজ সোমবার দিবাগত রাত ৯.৩০ মিনিট হতে ১২.১০ মিনিট পর্যন্ত দীর্ঘ ৩ঘণ্টা ব্যাপী সময়ে জামিয়ার শায়খে ছানি, যুগশ্রেষ্ঠ হাদিস বিশারদ, হেফাজত মহাসচিব, আল্লামা হাফেজ জুনাইদ বাবুনগরী দা.বা. বুখারী শরীফ ২য় খণ্ডের উনার নিজের আখেরি সবক দান করেন। এবং ইলমে হাদিসের ইযাযত প্রদান করত উদীয়মান তরুণ আলেমসমাজ তথা বিদায়ী কাফেলার উদ্দেশ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ নসীহত পেশ করেন।
.
বিশ্বের সর্ববৃহৎ দারুল হাদিস মিলনায়তনে উপস্থিত ২৫শতাধিক বিদায়ী ছাত্রদের উদ্দেশ্যে আল্লামা জুনাইদ দা.বা. বলেন, আপনাদের খোশনসীব যে, আপনারা উম্মুল মাদারিসের ফারিগ হতে যাচ্ছেন। পূর্ণ একবছর ইলমে হাদিসের দরস লাভ করেছেন আপনারা। আপনাদের খানাপিনা, লেবাস-পোষাক যদিওবা খুবই সাধারণ, কিন্তু আপনাদের বুকে আছে উলুমে নুবাওয়াত। ইলমে নুবাওয়াত যেখানে নেই, সেখানে শুধুই হাহাকার। আল্লাহ পাক আপনাদেরকে উলুমে নুবুওয়াত অর্জন করার সৌভাগ্য দিয়েছেন।
.
আপনারা কারা? আপনাদের কর্তব্য আর যিম্মাদারি কী? এটা আপনাদেরকে বুঝতে হবে।
আঁপ কওন হ্যায়, আঁপ কি যিম্মাদারি কিয়া হ্যায়?
আপনাদের পরিচয় কী? আপনাদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য কী? এটা সর্বপ্রথম আপনাদেরকে উপলব্ধি করতে হবে।
আপনাদের সম্পর্ক অনেক উপরে।
দারুল উলুম হাটহাজারি, দারুল উলুম দেওবন্দের সম্পর্ক মিশে আছে মসজিদে নববীর দারুসসুফফার সাথে। সুতরাং আপনার মূল শিকড় গেঁথে আছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে।
আপনাদের সিলসিলায় সাহাবায়ে কেরামদের পবিত্র জামাত পাওয়া যায়। তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন, আইয়েম্মায়ে মুজতাহেদীন, ছলফে সালেহীন, মুহাদ্দিসীন এবং আকাবিরে দেওবন্দ ও আকাবিরে হাটহাজারির মকবুল জামাত পাওয়া যায়। এসব সম্পর্ক আপনাদের সাথে থাকায় আপনাদের উপর এক মহান যিম্মাদারি এসে পড়েছে। আপনারা এখন কাজের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। জাতি চাতক পাখির ন্যায় আপনাদের অপেক্ষমাণ। পিপাসিত ও তৃষ্ণার্ত এজাতির নেতৃত্ব আপনাদেরকেই দিতে হবে। দিশেহারা এজাতির দুনিয়া ও আখেরাত আপনাদেরকেই সুনিপুণ গড়তে হবে।
এক্ষেত্রে আমি আপনাদেরকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিচ্ছি; যেগুলো আপনাদের জীবনের পাথেয় এবং মাইলফলক হবে। এগুলো মানতে পারলে আপনাদের কামিয়াবি সুনিশ্চিত হবে ইনশাআল্লাহ!
১, জীবনের সর্বক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসরণ করতে হবে। আক্বীদা এবং আমল উভয় ক্ষেত্রে। এই দলই হচ্ছে একমাত্র নাজাতপ্রাপ্ত দল। বাকি অন্যান্য দল হচ্ছে জাহান্নামি। কোনোরকম লোভ-লালসা এবং ভয়ভীতি যেন এই পথ থেকে ফেরাতে না পারে। এই জামাতে থাকলে দারুল উলুম হাটহাজারির সনদ আপনাদের জন্য হবে, এই জামাত থেকে বের হয়ে গেলে আমার বা আমাদের পক্ষ থেকে ইলমে হাদিস প্রচার করতে আপনাদের জন্য কোনো ইযাযত নেই। সম্পূর্ণ সনদ এবং ইযাযত বাতিল হয়ে যাবে।
এজন্য জীবনের সর্বক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ এবং সাহাবায়ে কেরামদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হবে। তবেই আপনারা কামিয়াব হবেন দুনিয়া এবং আখেরাতে।
.
২, এহসান ও তাযকিয়া তথা আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে হবে। এর অপরনাম হচ্ছে তরীকত। বাহ্যিক ইলমের সাথে আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করতে হবে। উলামায়ে দেওবন্দ এবং উলামায়ে হাটহাজারির একহাতে আছে শরীয়তের পাত্র অপর হাতে আছে তরীকতের ঝাণ্ডা। তারা উভয় হাতে এসবের ব্যবহার করতে পারে। একহাতে শরীয়তের পাত্র আঁকড়ে ধরে আছে, অপর হাতে তরীকতের ঝাণ্ডা উড়াচ্ছে। অন্য যারা আছে, দেওয়ানবাগী-কুতুববাগী, আটরশী-ভাণ্ডারী এবং ফুলতলী, তারা তরীকতের পিছনে পড়ে শরীয়তের পাত্র ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। শরীয়ত ছাড়া যেহেতু তরীকত হয় না,তাই তাদের কাছে শরীয়ত তো নেই-ই, তরীকতও নেই। ওরা গোমরাহ!!
আল্লামা বাবুনগরী বিদায়ী ছাত্রদের তরীকতের লাইনে মেহনত করার জোর আহবান জানান। কোনো একজন খাঁটি সুন্নাতি পীরে কামেলের হাতে বায়'আত হয়ে অন্তরের শুদ্ধতা অর্জনের প্রতি গুরত্ব আরোপ করেন।
.
৩, জীবনের প্রতিটি কাজ একমাত্র আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে করতে হবে। দুনিয়াবি যশ-খ্যাতি পায়ের নিচে রাখতে হবে। পদ এবং অর্থের লোভ হৃদয় থেকে বের করতে হবে।
শায়খে ছানি বলেন, যেকোনো সংগঠন দুটো কারণে ধ্বংস হয়, এক হচ্ছে পদের লোভ, আরেকটা হচ্ছে অর্থের লোভ। এজন্য এই দুইপ্রকার লোভ নিজেদের দিল থেকে পরিত্যাগ করতে হবে।
ইস্তেকামত ফিদ্দীন, ইনাবত ইলাল্লাহ, এবং তাকওয়ার মজবুত প্রাচীর গড়ে তুলতে হবে। এজন্য তাযকিয়ায়ে নফস তথা আত্মশুদ্ধির বিকল্প নেই।
.
৪, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরতে হবে। নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন এবং আন্তর্জাতিক জীবনে নবীজির সুন্নাতকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিদ'আত থেকে দূরে থাকতে হবে। আক্বিদাগত বিদ'আত এবং আমলগত বিদ'আত, সর্বপ্রকার বিদ'আত বর্জন করতে হবে।
৫, ফিরাকে বাতিলা তথা ভ্রান্ত জনগোষ্ঠীর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। বক্তৃতা, লিখনি সহ সমুহ পদ্ধতিতে তাদের মোকাবেলা করতে হবে।
কিছু বাতিল আছে ইসলামের নামে, কিছু আছে ইসলামের নামও সহ্য করতে পারে না। বর্তমানে সবচে নিকৃষ্ট এবং ঘৃণিত ভ্রান্তদল হচ্ছে নাস্তিক্যবাদী সম্প্রদায়। তাদের প্রতিরোধে দুর্বার সংগ্রাম করতে হবে। তাদের প্রতিরোধ করার জন্য তাদের কিতাবও মুতালা'আ করতে হবে। কাদিয়ানী, শীয়া, মওদুদিবাদী, কবরপূজারী, দরগা ব্যবসায়ী, তাদের কিতাব পড়ে তাদের বিরুদ্ধে অজেয় দুর্গ গড়তে হবে। এজন্য যুগের চাহিদা বুঝতে হবে। মানুষের মন বুঝতে হবে, সমাজকে নিজেদের গুণ দিয়ে জয় করতে হবে। তাহলে কাজটা মজবুত এবং প্রভাবশালী হবে। তবে একটা বিষয় খেয়াল রাখবেন, ইসলামকে যুগের সাথে মেলানো যাবে না। অনেকেই বলে ইসলামকে যুগোপযোগী করতে হবে। না না না, ইসলামকে যুগোপযোগী করা যাবে না। বরং যুগকেই ইসলাম উপযোগী করতে হবে।
কারণ, ইসলাম হচ্ছে সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম, মহান আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীত জীবনবিধান। সুতরাং কোনোক্রমেই ইসলামে পরিবর্তন আনা যাবে না। ইসলাম হচ্ছে মুকাম্মাল ধর্ম। ইসলামকে যুগের সাথে মেলানো মানে ইসলাম অসম্পূর্ণ ধর্ম, সুতরাং এটা করা যাবে না। বরং যুগকেই ইসলামের সাথে মেলাতে হবে। এজন্য আপনাদেরকে যুগের চাহিদা বুঝতে হবে।
তবুও কোনোভাবে বাতিলের সাথে আপোষ করা যাবে না।
.
৬, মাদারিসের সাথে খেদমতে নিয়োজিত থাকবেন। কারণ, বর্তমানে দরস ও তাদরীসের লাইনে আজ যোগ্য আলেমের অভাব। আপনাদেরকে এবিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ছোট্ট একটা নূরানি মক্তব অথবা হেফযখানায় হলেও দ্বীনি খেদমতে লেগে থাকবেন।
কোনো মাদ্রাসায় খেদমতে গেলে নিজ থেকে কোনো কিতাব চেয়ে নিবেন না, কারণ এতে বরকত থাকে না। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ যে কিতাব আপনাদের ভাগে দিবে, সেগুলোই সবক দিবেন, এতে বরকত পাবেন, ছাত্ররা আপনাদের সবকও বুঝতে পারবে। খবরদার, কোনো কিতাব সরাসরিভাবে অথবা ইশারা ইঙ্গিতে চেয়ে নিবেন না। এবং প্রতিটি সবক মুতালা'আ করে পড়াবেন। মুতালা'আ ছাড়া পড়াবেন না। অনেক শরাহ শরুহাত আছে, ওগুলো মুতালা'আ করবেন, তারপর সংক্ষিপ্ত এবং সারাংশ নোট করবেন, তারপর সেগুলো তারতিবের সাথে সবকে বলবেন। তারতিবের খেয়াল অবশ্যই রাখবেন। সাজিয়ে-গুছিয়ে সবক দিবেন।
.
* দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতে লেগে থাকবেন। এই কাজে আপনাদেরকে নেতৃত্ব দিতে হবে। বর্তমানে এই মেহনতে উলামায়ে কেরাম না থাকায় সাধারণ মানুষ সহীহ দ্বীন থেকে মাহরুম হচ্ছে।
* বক্তৃতা এবং বয়ানের লাইনেও খেদমত করবেন, তবে সহীহ বয়ান করবেন। বর্তমানে অশুদ্ধ বয়ানের সয়লাব। আপনারা সহীহ বয়ান করবেন, এবং বয়ানের আগে মুতালা'আও করবেন, তারপর বয়ান করবেন।
* ইমামত এবং খেতাবতের লাইনেও খেদমত করবেন। যেকোনো একটা মসজিদের মুখলেস ইমাম হবেন, প্রয়োজনে যেকোনো মসজিদের মুয়াজ্জিন হবেন। কারণ, ইমাম মুয়াজ্জিনের কথা সাধারণ মানুষ বেশি শুনে, এক্ষেত্রে আপনারা সহজে একটা সমাজকে আলোকিত করতে পারবেন।
আমার প্রাণপ্রিয় উস্তাদ, বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইউসুফ বান্নুরি রাহ. বলতেন, আমার মন চায় অমুক গ্রামে গিয়ে একনিষ্ঠভাবে মুয়াজ্জিন হয়ে থাকি।
আল্লাহু আকবার! এতবড় মুহাদ্দিস, মাদ্রাসার পরিচালক, খতমে নুবাওয়াতের আন্দোলন, তিরমিযী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ লেখা, এত কাজের ঝামেলা থাকা সত্ত্বেও তিনি এমন আকাঙ্ক্ষা করতেন!
আপনারা কেন পারবেন না?
.
* সঠিক ইসলামি রাজনীতি করবেন। এটাও ইসলামের একটি শাখা। বর্তমানে নোংরা রাজনীতির চর্চা হচ্ছে। বর্তমানে রাজনীতি ইসলাম থেকে অনেক দূরে, তাই এগুলো রাজনীতি নয়, সন্ত্রাসবাদী হয়ে গেছে। আপনারা সঠিক ইসলামী রাজনীতিও করবেন। যেন সমাজ থেকে সন্ত্রাসবাদ দূরীভূত হয়ে যায়।
তবে খবরদার, ছাত্রজীবনে রাজনীতি হারাম হারাম হারাম। আপনারা আলেম হয়ে গেছেন, তাই আপনাদেরকে বললাম।
* যদি উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তাহলে আল্লাহর যমীনে আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠা করার জন্য জিহাদ করবেন। আহ হা, আজ জিহাদ নেই বলেই বিশ্ব অশান্ত হয়ে আছে। চারিদিকে যুলুম আর অবিচারের সয়লাব। সন্ত্রাসবাদ এবং ফ্যাসিবাদের রাজত্ব চলছে।
জিহাদ রহিত হয়ে যায় নি। কিয়ামত পর্যন্ত জিহাদের হুকুম বাকি আছে। সুতরাং উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হলে জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহয় অংশ নিবেন।
.
৬, সর্বশেষ নসীহত আমার, মহান আল্লাহ এবং রাসুলে কারীম সা., আকাবির ও আসলাফের প্রতি মুহাব্বাত রাখবেন।
কারণ, হাদিসে আছে, যে ব্যক্তি যার সাথে মুহাব্বাত রাখবে, তার সাথে তার হাশর হবে।
এজন্য আপনারা আল্লাহ পাক, রাসুলে কারীম, সাহাবায়ে কেরাম, সালফে সালেহীন, আকাবিরে দেওবন্দ এবং আকাবিরে হাটহাজারির প্রতি গভীর মুহাব্বাত রাখবেন। উনাদের জন্য ইসালে সওয়াব করবেন, উনাদের জন্য দোয়া করবেন। ইনশাল্লাহ কামিয়াব হবেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যখন আমরা সফরে যাবো, তখন পারলে এসে দেখা করবেন, পরিচয় দিবেন যে হুযুর আমি আপনার ছাত্র, তাহলে দিল অনেক খোশ হবে। আমার জন্য দোয়া করবেন, কখনো যদি মওতের খবর পান, কয়েকটা আয়াত পড়ে ইসালে সওয়াব করবেন। আপনাদের সবার জন্য আমি দোয়া করছি, আল্লাহ পাক আপনাদেরকে দীনের জন্য কবুল করুন, দুনিয়া এবং আখেরাতে আপনাদেরকে কামিয়াব করুন। আমীন!!
উম্মুল মাদারিস আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারির দাওরায়ে হাদিস সমাপনী ছাত্রদের উদ্দেশ্যে অদ্য ১৪-০৭-১৪৩৯হিজরী
.
বিশ্বের সর্ববৃহৎ দারুল হাদিস মিলনায়তনে উপস্থিত ২৫শতাধিক বিদায়ী ছাত্রদের উদ্দেশ্যে আল্লামা জুনাইদ দা.বা. বলেন, আপনাদের খোশনসীব যে, আপনারা উম্মুল মাদারিসের ফারিগ হতে যাচ্ছেন। পূর্ণ একবছর ইলমে হাদিসের দরস লাভ করেছেন আপনারা। আপনাদের খানাপিনা, লেবাস-পোষাক যদিওবা খুবই সাধারণ, কিন্তু আপনাদের বুকে আছে উলুমে নুবাওয়াত। ইলমে নুবাওয়াত যেখানে নেই, সেখানে শুধুই হাহাকার। আল্লাহ পাক আপনাদেরকে উলুমে নুবুওয়াত অর্জন করার সৌভাগ্য দিয়েছেন।
.
আপনারা কারা? আপনাদের কর্তব্য আর যিম্মাদারি কী? এটা আপনাদেরকে বুঝতে হবে।
আঁপ কওন হ্যায়, আঁপ কি যিম্মাদারি কিয়া হ্যায়?
আপনাদের পরিচয় কী? আপনাদের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য কী? এটা সর্বপ্রথম আপনাদেরকে উপলব্ধি করতে হবে।
আপনাদের সম্পর্ক অনেক উপরে।
দারুল উলুম হাটহাজারি, দারুল উলুম দেওবন্দের সম্পর্ক মিশে আছে মসজিদে নববীর দারুসসুফফার সাথে। সুতরাং আপনার মূল শিকড় গেঁথে আছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে।
আপনাদের সিলসিলায় সাহাবায়ে কেরামদের পবিত্র জামাত পাওয়া যায়। তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন, আইয়েম্মায়ে মুজতাহেদীন, ছলফে সালেহীন, মুহাদ্দিসীন এবং আকাবিরে দেওবন্দ ও আকাবিরে হাটহাজারির মকবুল জামাত পাওয়া যায়। এসব সম্পর্ক আপনাদের সাথে থাকায় আপনাদের উপর এক মহান যিম্মাদারি এসে পড়েছে। আপনারা এখন কাজের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। জাতি চাতক পাখির ন্যায় আপনাদের অপেক্ষমাণ। পিপাসিত ও তৃষ্ণার্ত এজাতির নেতৃত্ব আপনাদেরকেই দিতে হবে। দিশেহারা এজাতির দুনিয়া ও আখেরাত আপনাদেরকেই সুনিপুণ গড়তে হবে।
এক্ষেত্রে আমি আপনাদেরকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিচ্ছি; যেগুলো আপনাদের জীবনের পাথেয় এবং মাইলফলক হবে। এগুলো মানতে পারলে আপনাদের কামিয়াবি সুনিশ্চিত হবে ইনশাআল্লাহ!
১, জীবনের সর্বক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসরণ করতে হবে। আক্বীদা এবং আমল উভয় ক্ষেত্রে। এই দলই হচ্ছে একমাত্র নাজাতপ্রাপ্ত দল। বাকি অন্যান্য দল হচ্ছে জাহান্নামি। কোনোরকম লোভ-লালসা এবং ভয়ভীতি যেন এই পথ থেকে ফেরাতে না পারে। এই জামাতে থাকলে দারুল উলুম হাটহাজারির সনদ আপনাদের জন্য হবে, এই জামাত থেকে বের হয়ে গেলে আমার বা আমাদের পক্ষ থেকে ইলমে হাদিস প্রচার করতে আপনাদের জন্য কোনো ইযাযত নেই। সম্পূর্ণ সনদ এবং ইযাযত বাতিল হয়ে যাবে।
এজন্য জীবনের সর্বক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ এবং সাহাবায়ে কেরামদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হবে। তবেই আপনারা কামিয়াব হবেন দুনিয়া এবং আখেরাতে।
.
২, এহসান ও তাযকিয়া তথা আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে হবে। এর অপরনাম হচ্ছে তরীকত। বাহ্যিক ইলমের সাথে আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করতে হবে। উলামায়ে দেওবন্দ এবং উলামায়ে হাটহাজারির একহাতে আছে শরীয়তের পাত্র অপর হাতে আছে তরীকতের ঝাণ্ডা। তারা উভয় হাতে এসবের ব্যবহার করতে পারে। একহাতে শরীয়তের পাত্র আঁকড়ে ধরে আছে, অপর হাতে তরীকতের ঝাণ্ডা উড়াচ্ছে। অন্য যারা আছে, দেওয়ানবাগী-কুতু
আল্লামা বাবুনগরী বিদায়ী ছাত্রদের তরীকতের লাইনে মেহনত করার জোর আহবান জানান। কোনো একজন খাঁটি সুন্নাতি পীরে কামেলের হাতে বায়'আত হয়ে অন্তরের শুদ্ধতা অর্জনের প্রতি গুরত্ব আরোপ করেন।
.
৩, জীবনের প্রতিটি কাজ একমাত্র আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে করতে হবে। দুনিয়াবি যশ-খ্যাতি পায়ের নিচে রাখতে হবে। পদ এবং অর্থের লোভ হৃদয় থেকে বের করতে হবে।
শায়খে ছানি বলেন, যেকোনো সংগঠন দুটো কারণে ধ্বংস হয়, এক হচ্ছে পদের লোভ, আরেকটা হচ্ছে অর্থের লোভ। এজন্য এই দুইপ্রকার লোভ নিজেদের দিল থেকে পরিত্যাগ করতে হবে।
ইস্তেকামত ফিদ্দীন, ইনাবত ইলাল্লাহ, এবং তাকওয়ার মজবুত প্রাচীর গড়ে তুলতে হবে। এজন্য তাযকিয়ায়ে নফস তথা আত্মশুদ্ধির বিকল্প নেই।
.
৪, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরতে হবে। নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন এবং আন্তর্জাতিক জীবনে নবীজির সুন্নাতকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিদ'আত থেকে দূরে থাকতে হবে। আক্বিদাগত বিদ'আত এবং আমলগত বিদ'আত, সর্বপ্রকার বিদ'আত বর্জন করতে হবে।
৫, ফিরাকে বাতিলা তথা ভ্রান্ত জনগোষ্ঠীর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। বক্তৃতা, লিখনি সহ সমুহ পদ্ধতিতে তাদের মোকাবেলা করতে হবে।
কিছু বাতিল আছে ইসলামের নামে, কিছু আছে ইসলামের নামও সহ্য করতে পারে না। বর্তমানে সবচে নিকৃষ্ট এবং ঘৃণিত ভ্রান্তদল হচ্ছে নাস্তিক্যবাদী সম্প্রদায়। তাদের প্রতিরোধে দুর্বার সংগ্রাম করতে হবে। তাদের প্রতিরোধ করার জন্য তাদের কিতাবও মুতালা'আ করতে হবে। কাদিয়ানী, শীয়া, মওদুদিবাদী, কবরপূজারী, দরগা ব্যবসায়ী, তাদের কিতাব পড়ে তাদের বিরুদ্ধে অজেয় দুর্গ গড়তে হবে। এজন্য যুগের চাহিদা বুঝতে হবে। মানুষের মন বুঝতে হবে, সমাজকে নিজেদের গুণ দিয়ে জয় করতে হবে। তাহলে কাজটা মজবুত এবং প্রভাবশালী হবে। তবে একটা বিষয় খেয়াল রাখবেন, ইসলামকে যুগের সাথে মেলানো যাবে না। অনেকেই বলে ইসলামকে যুগোপযোগী করতে হবে। না না না, ইসলামকে যুগোপযোগী করা যাবে না। বরং যুগকেই ইসলাম উপযোগী করতে হবে।
কারণ, ইসলাম হচ্ছে সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম, মহান আল্লাহর কাছে একমাত্র মনোনীত জীবনবিধান। সুতরাং কোনোক্রমেই ইসলামে পরিবর্তন আনা যাবে না। ইসলাম হচ্ছে মুকাম্মাল ধর্ম। ইসলামকে যুগের সাথে মেলানো মানে ইসলাম অসম্পূর্ণ ধর্ম, সুতরাং এটা করা যাবে না। বরং যুগকেই ইসলামের সাথে মেলাতে হবে। এজন্য আপনাদেরকে যুগের চাহিদা বুঝতে হবে।
তবুও কোনোভাবে বাতিলের সাথে আপোষ করা যাবে না।
.
৬, মাদারিসের সাথে খেদমতে নিয়োজিত থাকবেন। কারণ, বর্তমানে দরস ও তাদরীসের লাইনে আজ যোগ্য আলেমের অভাব। আপনাদেরকে এবিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ছোট্ট একটা নূরানি মক্তব অথবা হেফযখানায় হলেও দ্বীনি খেদমতে লেগে থাকবেন।
কোনো মাদ্রাসায় খেদমতে গেলে নিজ থেকে কোনো কিতাব চেয়ে নিবেন না, কারণ এতে বরকত থাকে না। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ যে কিতাব আপনাদের ভাগে দিবে, সেগুলোই সবক দিবেন, এতে বরকত পাবেন, ছাত্ররা আপনাদের সবকও বুঝতে পারবে। খবরদার, কোনো কিতাব সরাসরিভাবে অথবা ইশারা ইঙ্গিতে চেয়ে নিবেন না। এবং প্রতিটি সবক মুতালা'আ করে পড়াবেন। মুতালা'আ ছাড়া পড়াবেন না। অনেক শরাহ শরুহাত আছে, ওগুলো মুতালা'আ করবেন, তারপর সংক্ষিপ্ত এবং সারাংশ নোট করবেন, তারপর সেগুলো তারতিবের সাথে সবকে বলবেন। তারতিবের খেয়াল অবশ্যই রাখবেন। সাজিয়ে-গুছিয়ে সবক দিবেন।
.
* দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতে লেগে থাকবেন। এই কাজে আপনাদেরকে নেতৃত্ব দিতে হবে। বর্তমানে এই মেহনতে উলামায়ে কেরাম না থাকায় সাধারণ মানুষ সহীহ দ্বীন থেকে মাহরুম হচ্ছে।
* বক্তৃতা এবং বয়ানের লাইনেও খেদমত করবেন, তবে সহীহ বয়ান করবেন। বর্তমানে অশুদ্ধ বয়ানের সয়লাব। আপনারা সহীহ বয়ান করবেন, এবং বয়ানের আগে মুতালা'আও করবেন, তারপর বয়ান করবেন।
* ইমামত এবং খেতাবতের লাইনেও খেদমত করবেন। যেকোনো একটা মসজিদের মুখলেস ইমাম হবেন, প্রয়োজনে যেকোনো মসজিদের মুয়াজ্জিন হবেন। কারণ, ইমাম মুয়াজ্জিনের কথা সাধারণ মানুষ বেশি শুনে, এক্ষেত্রে আপনারা সহজে একটা সমাজকে আলোকিত করতে পারবেন।
আমার প্রাণপ্রিয় উস্তাদ, বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা ইউসুফ বান্নুরি রাহ. বলতেন, আমার মন চায় অমুক গ্রামে গিয়ে একনিষ্ঠভাবে মুয়াজ্জিন হয়ে থাকি।
আল্লাহু আকবার! এতবড় মুহাদ্দিস, মাদ্রাসার পরিচালক, খতমে নুবাওয়াতের আন্দোলন, তিরমিযী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ লেখা, এত কাজের ঝামেলা থাকা সত্ত্বেও তিনি এমন আকাঙ্ক্ষা করতেন!
আপনারা কেন পারবেন না?
.
* সঠিক ইসলামি রাজনীতি করবেন। এটাও ইসলামের একটি শাখা। বর্তমানে নোংরা রাজনীতির চর্চা হচ্ছে। বর্তমানে রাজনীতি ইসলাম থেকে অনেক দূরে, তাই এগুলো রাজনীতি নয়, সন্ত্রাসবাদী হয়ে গেছে। আপনারা সঠিক ইসলামী রাজনীতিও করবেন। যেন সমাজ থেকে সন্ত্রাসবাদ দূরীভূত হয়ে যায়।
তবে খবরদার, ছাত্রজীবনে রাজনীতি হারাম হারাম হারাম। আপনারা আলেম হয়ে গেছেন, তাই আপনাদেরকে বললাম।
* যদি উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তাহলে আল্লাহর যমীনে আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠা করার জন্য জিহাদ করবেন। আহ হা, আজ জিহাদ নেই বলেই বিশ্ব অশান্ত হয়ে আছে। চারিদিকে যুলুম আর অবিচারের সয়লাব। সন্ত্রাসবাদ এবং ফ্যাসিবাদের রাজত্ব চলছে।
জিহাদ রহিত হয়ে যায় নি। কিয়ামত পর্যন্ত জিহাদের হুকুম বাকি আছে। সুতরাং উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হলে জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহয় অংশ নিবেন।
.
৬, সর্বশেষ নসীহত আমার, মহান আল্লাহ এবং রাসুলে কারীম সা., আকাবির ও আসলাফের প্রতি মুহাব্বাত রাখবেন।
কারণ, হাদিসে আছে, যে ব্যক্তি যার সাথে মুহাব্বাত রাখবে, তার সাথে তার হাশর হবে।
এজন্য আপনারা আল্লাহ পাক, রাসুলে কারীম, সাহাবায়ে কেরাম, সালফে সালেহীন, আকাবিরে দেওবন্দ এবং আকাবিরে হাটহাজারির প্রতি গভীর মুহাব্বাত রাখবেন। উনাদের জন্য ইসালে সওয়াব করবেন, উনাদের জন্য দোয়া করবেন। ইনশাল্লাহ কামিয়াব হবেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যখন আমরা সফরে যাবো, তখন পারলে এসে দেখা করবেন, পরিচয় দিবেন যে হুযুর আমি আপনার ছাত্র, তাহলে দিল অনেক খোশ হবে। আমার জন্য দোয়া করবেন, কখনো যদি মওতের খবর পান, কয়েকটা আয়াত পড়ে ইসালে সওয়াব করবেন। আপনাদের সবার জন্য আমি দোয়া করছি, আল্লাহ পাক আপনাদেরকে দীনের জন্য কবুল করুন, দুনিয়া এবং আখেরাতে আপনাদেরকে কামিয়াব করুন। আমীন!!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন