আজ শাবানের ০৪ তারিখ। মহিমান্বিত মাহে রামাযান আমাদের খুব নিকটে। পবিত্র মাহে রামাযানের আগমনী বার্তা নিয়ে রজবের প্রথম চাঁদ যখন পশ্চিমাকাশে মুচকি হাসি দিত, তখন প্রিয়নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি বিশেষ দোয়ার আমল শুরু করতেন। তা হলো, ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজাবা ওয়া শাবান ওয়াবাল্লিগনা রমাদান’ অর্থাৎ, হে আল্লাহ! আমাদের রজব ও শাবান মাসকে বরকতময় করুন এবং আমাদের হায়াতকে রামাযান পর্যন্ত বৃদ্ধি করে দিন। (আল মুজামুল আউসাত, হা. ৩৯৩৯)
দ্বিতীয় কথা হলো মাহে রামাযান উপলক্ষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগে থেকেই মানসিক ও শারীরিকভাবে নিজেও প্রস্তুতি নিয়েছেন আবার সাহাবায়ে কেরাম রাজি. এর প্রতি রমজানের আগমন উপলক্ষে সুসংবাদ দিতেন এবং তাদের উত্তম আমলসমূহের জন্য প্রস্তুতি নিতে উৎসাহিত করতেন।
এ বিষয়ে একটি দীর্ঘ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, হজরত সালমান ফারসি (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, শাবান মাসের শেষ দিনে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন।
ওই ভাষণে তিনি বলেন, হে লোক সকল! একটি মহিমান্বিত মাস তোমাদেরকে ছায়া হয়ে ঘিরে ধরেছে। এ মাস একটি বরকাতময় মাস। এটি এমন এক মাস, যার একটি রাত হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। আল্লাহতায়ালা এ মাসের সিয়ামকে ফরজ করেছেন আর নফল করে দিয়েছেন এ মাসে রাতের কিয়ামকে। যে ব্যক্তি এ মাসে একটি নফল কাজ করবে, সে যেন অন্য মাসের একটি ফরজ আদায় করল। আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ আদায় করল, সে যেন অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ সম্পাদন করল। এ মাস সবরের (ধৈর্যের) মাস; সবরের সওয়াব জান্নাত। এ মাস সহমর্মিতার। এ এমন এক মাস যাতে মুমিনের রিজিক বৃদ্ধি করা হয়। যে ব্যক্তি এ মাসে কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, এ ইফতার তার গোনাহ মাফের কারণ হবে, হবে জাহান্নামের অগ্নিমুক্তির উপায়। তার সওয়াব হবে রোজাদারের অনুরূপ। অথচ তার (রোজাদার) সওয়াব একটুও কমানো হবে না।
আমরা বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমাদের সবাইতো রোজাদারের ইফতারির আয়োজন করতে সমর্থ নই। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, এ সওয়াব আল্লাহতাআলা ওই ইফতার পরিবেশনকারীকেও প্রদান করবেন, যে একজন রোজাদারকে এক চুমুক দুধ, একটি খেজুর অথবা এক চুমুক পানি দিয়ে ইফতার করায়। আর যে ব্যক্তি একজন রোজাদারকে পেট ভরে খাইয়ে পরিতৃপ্ত করল, আল্লাহতায়ালা তাকে আমার হাউজে কাওসার থেকে এভাবে পানি খাইয়ে পরিতৃপ্ত করবেন- যার পর সে জান্নাতে (প্রবেশ করার পূর্বে) আর পিপাসার্ত হবে না। এমনকি সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এটা এমন এক মাস যার প্রথম অংশে রহমত। মধ্য অংশে মাগফিরাত আর শেষাংশে জাহান্নামের আগুন থেকে নাজাত। যে ব্যক্তি এ মাসে তার অধীনস্তদের ভার-বোঝা সহজ করে দেবে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন। তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেবেন। -মিশকাতুল মাসাবিহ, কিতাবুস সাওম, হাদিস নং: ১৯৬৫
এছাড়াও রামাযানের আগমন উপলক্ষে রামাযানের ফজিলত ও মাহাত্ম্য শুনিয়ে সাহাবা আজমায়ীনকে হুজুর সাঃ আমলের ব্যাপারে সুসংবাদ ও উদ্বুদ্ধ প্রদান করতেন। যার বর্ণনা আমরা দেখলাম। সেই সাথে আরো জানলাম যে, জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাত লাভের ফজিলতসহ অন্যান্য সকল ফজিলত রামাযানের হক আদায়ের সাথে সম্পৃক্ত। শুধুমাত্র রামাজানের আগমনী বার্তা প্রচার করলেই জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে এরকম কথা হাদীসে নেই। সুতরাং "যে ব্যাক্তি সর্বাগ্রে রোজার খবর দিবে তার জন্য জাহান্নামের আগুন হারাম " এ জাতীয় যত বর্ণনা বর্তমান সময়ে প্রচলিত হচ্ছে সব বানোয়াট, মিথ্যাচার ও ভিত্তিহীন কথা। হাদীসের কোন ছোট বড় দুর্বল সবল প্রসিদ্ধ অপ্রসিদ্ধ কোন বর্ণনাতেই এজাতীয় বর্ণনার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।
এখানে অনেকেই খুব সুক্ষ্মভাবে ধোঁকায় পড়েন। তারা মনে করে, রামাযানের সংবাদ দেওয়া তো ভালো কাজ। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাঃ যেখানে রামাযানের সুসংবাদ জানিয়েছেন তাহলে আমাদের জানাতে অসুবিধে কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর যদিও আগের আলোচনায় আছে তারপরেও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করছি। তা হলো, সুসংবাদ জানাতে হবে রামাযানের ফজিলত জানিয়ে। কিন্তু সুসংবাদ জানানোর জন্যে বিশেষ ফায়দা বা কোন নির্দিষ্ট ফজিলত হাদীসে উল্লেখ নেই। রামাযানের আগমনী সংবাদ জানালেই যে জাহান্নাম থেকে মুক্তির পরোয়ানা অর্জিত হয়ে যায়, তা নয়। জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভের জন্যে রামাযানের হক আদায় করা জরুরী।
এখানে আরেকটি মারাত্মক অন্যায় হলো যে, রামাযানের বার্তা প্রাদানকারীর জন্যে যেহেতু হাদীসে নির্দিষ্ট কোন ফজিলতের কথা উল্লেখ নেই সুতরাং এ বিষয়ে বিভিন্ন কথা রাসূলুল্লাহ সা. থেকে হাদীস হিসেবে বর্ণনা করা হারাম ও মারাত্মক গুনাহের কাজ । ব্যাপারে হাদীসে মুতাওয়াতির এর সূত্রে (যেটা প্রায় একশত 'র চেয়ে বেশি সাহাবী থেকে) বর্ণিত আছে যে, হুজুর সা. বলেছেন—
ﻣﻦ ﻛﺬﺏ ﻋﻠﻲ ﻣﺘﻌﻤﺪﺍ ﻓﻠﻴﺘﺒﻮﺃ ﻣﻘﻌﺪﻩ ﻣﻦ ﺍﻟﻨﺎﺭ
অর্থ: যে ব্যাক্তি আমার (নবী সাঃ) এর উপর ইচ্ছাকৃত মিথ্যারোপ করল তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম ৷
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- “খবরদার! তোমরা আমার নামে বেশি বেশি হাদীস বলা থেকে বিরত থাকবে। যে আমার নামে কিছু বলবে সে যেন সঠিক কথা বলে। আর যেই আমার নামে এমন কথা বলবে যা আমি বলিনি তাকে জাহান্নামে বসবাস করতে হবে।" [ইবন মাজাহ ১/১৪; ২৯, দারিমী ১/৮২, আল মুসতাদরাক হাকিম ১/১৯৪।]
সুতরাং অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে জাহান্নাম থেকে বাঁচতে গিয়ে আরো জাহান্নামের অতল গভীরে নিপতিত হওয়ার পথ খুলে নিচ্ছি৷ মনের অজান্তেই জাহান্নামের দিকে পা বাড়াচ্ছি। এ বিষয়ে খুব সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি। আল্লাহ আমাদের সকলকে সঠিক বুঝে আমল করার তাওফিক দান করুন।
২১০৪১৮, সিরাজগঞ্জ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন