বৃহস্পতিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৮

তালাক ও আমাদের বর্তমান সমাজ

ইফতায় অধ্যায়নরত সময় থেকেই বিষয়টা খুব ভাবিয়ে তুলতো। মৌখিক তিন তালাক ও আমাদের সমাজের বর্তমান অবস্থা। এসম্পর্কে আগে তালাকের সরকারী ও ইসলামী মতামত তুলে ধরব। এরপর মূল আলোচনা।
তালাক সম্পর্কে সরকারী বক্তব্য।
"অনেকেই মনে করেন তিনবার 'তালাক' উচ্চারণ করলেই তালাক কার্যকর হয়ে যায়। তবে বাস্তব অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কেউ যদি তার স্ত্রীকে ডিভোর্স বা তালাক দিতে চায় তবে মুখে 'তালাক' বলার পর এই সংক্রান্ত লিখিত নোটিশও দিতে হবে। তালাক কার্যকর করার ক্ষেত্রে মুখে উচ্চারণের পাশাপাশি চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত নোটিশ পাঠাতে হয়।
চেয়ারম্যান বলতে এখানে বোঝানো হচ্ছে— ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভার চেয়ারম্যান, সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বা প্রশাসক, সেনানিবাস এলাকায় এই অধ্যাদেশের অধীনে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের জন্য সরকারের নিয়োগ করা
চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো তালাক নোটিশের একটি অনুলিপি তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে পাঠাতে হবে। তারপর এই নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে দুই পক্ষের পুনঃমিলনের উদ্দেশ্যে চেয়ারম্যান সালিশি কাউন্সিল তৈরি করে দুই পক্ষের পুনঃমিলনের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
যদি দুই পক্ষের মধ্যে কোনোভাবেই পুনঃমিলন সম্ভব না হয় তবে তালাক নোটিশ প্রদানের তারিখ হতে ৯০ দিনের মধ্যে তালাক কার্যকর হয়ে যাবে।
এই ৯০ দিন পর্যন্ত স্ত্রীর ভরণপোষণ ও অন্যান্য খরচাপাতি বহন করবেন স্বামী।" (https://m.bdnews24.com/bn/detail/lifestyle/839194?)

এবার তালাক সম্পর্কে ইসলামের অভিমত শুনবো।
তালাক সম্পর্কে ইসলাম বলে যে,  তালাক  হল সর্বনিম্ন একটা জায়েয পন্থা। যদি কোনো স্ত্রী স্বামীর আনুগত্য না করে, স্বামীর অধিকার আদায় না করে; বরং উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত হয়, তাহলে স্বামীর দায়িত্ব হলো তাকে সংশোধনের সর্বাত্মক চেষ্টা করা। তালাক দেওয়ার আগে ইসলামে কয়েকটি পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। স্বামী সেগুলো অনুসরণ করবে। তার পরও যদি স্ত্রীর মধ্যে কোনো পরিবর্তন না আসে, তাহলে চূড়ান্ত ফয়সালা তালাক দেওয়ার পথ বেছে নিতে পারবে।
প্রথম পদক্ষেপ : স্ত্রীর অবাধ্যতা দেখেই উত্তেজিত হবে না; বরং নিজেকে সংযত রাখবে এবং তাকে মিষ্টি ভাষায় বোঝানোর চেষ্টা করবে। স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে তার মন গলানোর চেষ্টা করবে। স্ত্রী কোনো ভুল ধারণায় থাকলে যথাসম্ভব তা দূর করার চেষ্টা করবে। স্বামী নিজেকে সংযত রেখে সব কিছু ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবে। ছাড় দেওয়া ও মায়া-মমতার মাধ্যমে যত দূর সম্ভব দাম্পত্য জীবন স্থায়ী করার আপ্রাণ চেষ্টা করবে।

দ্বিতীয় পদক্ষেপ : উক্ত পদক্ষেপের মাধ্যমে কাজ না হলে স্ত্রীর ব্যবহারে রাগ-অনুরাগ, অভিমান প্রকাশ করার জন্য স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে একত্রে রাতযাপন থেকে বিরত থাকবে। স্ত্রীর ঘুমানোর জায়গা পৃথক করে দেবে। স্ত্রী যদি এতেই সতর্ক হয়ে যায় এবং নিজেকে সংশোধন করে নেয়, তাহলে দাম্পত্য জীবন সুখের হবে।
তৃতীয় পদক্ষেপ : উল্লিখিত দুটি পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরও কোনো কাজ না হলে তৃতীয় পদক্ষেপ হিসেবে ইসলামের নির্দেশ হলো উভয় পক্ষ থেকে এক বা একাধিক সালিসের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সমস্যা নিরসনের চেষ্টা করবে।  কিন্তু  যদি পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছে যায় যে মীমাংসার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়, তখন ইসলামী শরিয়ত স্বামীকে তালাক দেওয়ার সুযোগ দিয়েছে। তবে ইসলামের দৃষ্টিতে তালাক দেওয়া অত্যন্ত অপছন্দনীয় ও ঘৃণিত কাজ। হাদিস শরিফে রয়েছে, ‘আল্লাহর কাছে বৈধ কাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঘৃণিত কাজ হলো তালাক। এর পরও তালাক দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা না থাকলে ইসলামী শরিয়ত সমর্থিত পদ্ধতি অনুসরণ করে তালাক দেবে। এ পদ্ধতি অনুসরণ করার অনেক সুফল রয়েছে।

তালাক দেওয়ার সর্বোত্তম পদ্ধতি।

এক. কোরআন-হাদিসের নির্দেশনা এবং সাহাবা-তাবেঈনের কর্মপন্থা থেকে প্রমাণিত যে তালাক দেওয়ার সর্বোত্তম পদ্ধতি হলো, স্ত্রী যখন হায়েজ (মাসিক ঋতুস্রাব) থেকে পবিত্র হবে, তখন স্বামী তার সঙ্গে সহবাস না করে সুস্পষ্ট শব্দে এক তালাক দেবে। এরপর স্বামী যদি স্ত্রীকে ইদ্দত চলা অবস্থায় ফিরিয়ে নেয় তাহলে ভালো। পুনরায় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কায়েম হয়ে যাবে। নতুন করে বিবাহের প্রয়োজন হবে না। আর যদি ইদ্দত চলাকালে স্বামী স্ত্রীকে ফিরিয়ে না নেয়, তাহলে ইদ্দত (তিন ঋতুস্রাব বা  ৯০ দিন) শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। স্ত্রী স্বামী থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে যাবে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, তালাকের পরে উভয়েই অনুতপ্ত হয় এবং বৈবাহিক সম্পর্ক পুনর্বহাল করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। যদি ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী এক তালাক দেওয়া হয়, তাহলে এ আশা পূরণের সুযোগ থাকে এবং তারা পুনরায় বৈবাহিক জীবন শুরু করতে পারে। কিন্তু স্বামী একসঙ্গে তিন তালাক দিলে ইদ্দত চলাকালেও স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে না। ইদ্দতের পরেও হালালা ব্যতিত নতুনভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অবকাশ থাকে না। তারা একে অন্যের জন্য সম্পূর্ণ হারাম হয়ে যায়। এমতাবস্থায় অনুতপ্ত হওয়া এবং আপসের জন্য আগ্রহী হলেও তা কোনো কাজে আসে না।

দুই. যদি তারা চায় যে আর কোনো দিন তারা একে অন্যের সংসারে ফিরে আসবে না, সে ক্ষেত্রেও ইসলাম একসঙ্গে তিন তালাক দিতে নিষেধ করেছে। তাই ঋতুস্রাবের পর প্রত্যেক পবিত্রতার সময় এক তালাক করে তিন বারে তিন তালাক দেবে। এভাবে তিন তালাকের মাধ্যমে তারা সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে যাবে। এ পদ্ধতিতে তালাক দিলে তালাক-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে স্বাভাবিকভাবে চিন্তাভাবনা করার সুযোগ পাওয়া যায়। ধীরস্থিরভাবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। তাড়াহুড়া করে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না। পক্ষান্তরে একসঙ্গে তিন তালাক দিলে এই অবকাশগুলো থাকে না এবং তা কোনো সুফলও বয়ে আনে না; বরং স্বামী-স্ত্রী উভয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। জীবন তাদের জন্য দুর্বিষহ হয়ে পড়ে।

এতো গেল তালাক সম্বন্ধীয় শরয়ী বিধান ও সরকারী আইন। তালাকের মধ্যে সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয় যেটা  খুব উদ্বেগপূর্ণ এবং সরকারী বিধান যে ব্যাপারে গোলকধাঁধাপূর্ণ তা হলো, সরকারী বিধানুযায়ী মৌখিক তালাক দিলেই স্বামী স্ত্রীর মাঝে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় না। যতক্ষণ না স্বামী  তালাকের নোটিশ প্রদান করবে এবং স্থানীয় প্রশাসন দ্বারা উপরিউক্ত কার্যক্রম না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত স্বামী স্ত্রীকে বিচ্ছিন্ন ধরা হয় না। এই সুযোগটা গ্রহণ করে কিছু অসাধু কাজী ও ভণ্ড মোল্লাগণ। স্বামী রাগের মাথায় স্ত্রীকে  মৌখিকভাবে  তিন তালাক প্রদান করে। এরপর যখন হুঁশ ফেরে তখন প্রথমে যায় হুজুরদের কাছে। তারা স্বামীর বিবরণ শুনে বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছেদের কথা জানিয়ে দেন। কিন্তু সে রায় স্বামীর মনোপূত হয় না। এবার যায় স্বার্থ্যান্বেষী কথিত মোল্লার কাছে। তখন সে মোল্লা ফাতাওয়া দেন, "যেহেতু আপনি কাগজ কলমে তালাক দেননি বা নোটিশের মাধ্যমে তালাক দেননি তাই তালাক হয়নি।" এরপর তাওবা তিল্লা পড়িয়ে দেন। আর স্বামী সাহেব কয়েক হাজার টাকা হাদিয়া দিয়ে পূর্বের স্ত্রীকে নিয়ে "হারামজাদা" প্রডাকশন এর কাজে লেগে যায়। নাউযুবিল্লাহ!

সমাজের  অবস্থা খুবই করুণ। আমার মনে হয় বর্তমানের ৩০ শতাংশ পরিবারে তালাক সংক্রান্ত এই জটিলতা বিদ্যমান। এরকম তিন তালাকের স্ত্রী নিয়ে সারা জীবনের তরে গুনাহ করে চলেছেন।  এ দায়ভার কার? সরকারের, নাকি সমাজপতিদের? না আলেমসম্প্রদায়ের?
তালাক নিয়ে এই বিভ্রান্তি আর কতো চলবে। মৌখিক তালাক নিয়ে ইসলামের অবস্থান সুস্পষ্ট। কিন্তু সরকারের অবস্থান অস্পষ্ট। কারণ, যদি মৌখিক তিন তালাকের পর নোটিশ প্রদানের ক্ষেত্রে চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপের ফলে স্বামী স্ত্রী মাঝে সমঝোতা হয়ে যায় তাহলেই কি তাদের মাঝে সংসারের বৈধতা আছে? এর উত্তর হবে, না। তিন তালাকের পর যতই সমঝোতা করুক, হালালা উক্ত স্ত্রী তার স্বামীর জন্যে বৈধ হয় না। সরকারী এই বিধান প্রযোজ্য হতে পারে এক বা দুই তালাকের ক্ষেত্রে। এক বা দুই তালাক দেওয়ার পর স্বামী স্ত্রীর সমঝোতার মাধ্যমে হালালা ব্যতিরেকেই পূণঃবিবাহ বা রাজ'আতের মাধ্যমে সংসার করা যায়।
সরকারী এই আইনের ইসলামসমর্থিত সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা খুবই জরুরী। উলামায়ে কেরাম কতো দাবী নিয়েই তো সরকারের কাছে যান। এই বিষয়েও সঠিক সুস্পষ্ট ব্যাখার দাবী জানানো দরকার। সেই সাথে অসাধু মোল্লাদের স্বার্থবাধী আগ্রাসনকেও বন্ধ করতে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ দায়বদ্ধতা এড়িয়ে যাবার সুযোগ নেই।
আল্লাহ তাওফিক দিন।
(লেখা সংক্ষিপ্ত করার লক্ষ্যে মাসয়ালা ইবারত উল্লেখ করা হয়নি। কেউ যদি আগ্রহী হন তবে দেখুনঃ সূরা বাকারা-২২৯-২৩০,  সুরা নিসা, আয়াত : ৩৪ : ৩৫, সহীহ বুখারী-২/৭৯২, ২/৮০৩,   সুনানে আবু দাউদ-১/২৯৯, হাদীস নং-২১৯৯,  সুনানে বায়হাকী কুবরা, হাদীস নং-১৪৭২০, সুনানে দারা কুতনী, হাদীস নং-১৪৩,   হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা : ২/১৩৯, হেদায়া, ২/৩৯৯,  মাজমুউল আনহুর, ২/৮৮)

১৯০৪১৮, সিরাজগঞ্জ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নাভীর নীচের অবাঞ্ছিত লোমের সীমানা

নাভীর নীচের অবাঞ্ছিত লোমের সীমানা হলো : পায়ের পাতার উপর ভর করে বসা অবস্থায় নাভী থেকে চার পাঁচ আঙ্গুল পরিমাণ নীচে যে ভাঁজ বা রেখা সৃষ্টি হয় ...