বর্তমান পরিস্থিতিতে মাদ্রাসা শিক্ষা বহুমুখী ষড়যন্ত্রের শিকার। বিশেষকরে সরকারী অর্থায়নে যেসকল মাদ্রাসা আমাদের দেশে চালু রয়েছে, সে মাদ্রাসার শিক্ষা, মান-মর্যাদা ও ঐতিহ্যকে ধূলিসাৎ করে দিতে যা যা করা দরকার কোনটাই বাদ রাখছেন না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
উপমহাদেশের ইতিহাসে তিন প্রকার মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সন্ধান পাওয়া যায়। এক প্রকার মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দের আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। দ্বিতীয় প্রকার মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ১৭৮১ খ্রিঃ থেকে চালু হয়েছিল। তৃতীয় প্রকার মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ১৮৬৬ খ্রিঃ থেকে চালু হয়েছে।
বিলুপ্ত হওয়া মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সম্পর্কে পাওয়া যে, ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দের আগে মোগল শাসকদের আমলে ভারত উপমহাদেশে প্রায় ১২ লক্ষ মাদ্রাসা ছিল। ম্যাক্সমুলারের মতে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের আগ পর্যন্ত খোদ বাংলাদেশেই ৮০ হাজার মাদ্রাসা চালু ছিল। কিন্তু বৃটিশ সরকার বাংলা দখল করে মসজিদ-মাদ্রাসার খরচ নির্বাহের জন্য বরাদ্দকৃত ‘ওয়াক্ফ সম্পত্তি’ বাজেয়াপ্ত করলে মাদ্রাসাগুলো ধীরে ধরে বন্ধ হয়ে যায়। এমতাবস্থায় মুসলমানদের অর্থনৈতিক ও শিক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে চরম ও শোচনীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়। ফলে মুসলমান প্রতিনিধিগণ শিক্ষার ক্ষেত্রে তাদের দুর্দশার কথা এবং মুসলিম সন্তানদের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান কায়েম করার জন্যে বৃটিশ গভর্নরের কাছে আবেদন জানান। মুসলমানদের এই আবেদনে সাড়া দিয়ে ব্রিটিশ গভর্ণর লর্ড ওয়্যারেন হেস্টিংস ১৭৮১ খ্রীস্টাব্দে কলিকাতায় একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে দেন। সেই মাদ্রাসাকে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা নামে নামকরণ করা হয়। আর এটাই আমাদের উপ মহাদেশের সর্বপ্রথম আলীয়া মাদ্রাসা।
মাদ্রাসার দাবীতে মুসলমানদের প্রতিনিধিদের মধ্য অন্যতম একজন ছিলেন শাহ্ আবদুল আজিজ (রাহ.) এর একজন কৃতি ছাত্র মোল্লা মাজেদুদ্দীন (রাহ.)। মোল্লা মাজেদুদ্দীনের মতো বুযূর্গ লোক কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসার সাথে জড়িত থাকার ফলে, শাহ্ আবদুল আজিজ (রাহ.) এর আহবানে উপমহাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমস্ত আলেম-ওলামা এবং সর্বস্তরের জনসাধারণের সাথে একাত্ম হয়ে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা পড়ুয়ারাও ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ইংরেজ সরকার আলিয়া মাদ্রাসাকে সংশোধনের করার জন্য কয়েকটা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
প্রথম ব্যবস্থা হিসেবে কলিকাতা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার পর থেকে একাধারে ২৬ জন প্রিন্সিপাল নিযুক্ত করা হয় খ্রিস্টান সম্প্রদায় থেকে। উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশে যত আলিয়া মাদ্রাসা আছে, তার উৎপত্তি কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকেই। এখন মুসলমানদের ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপাল যদি খ্রিস্টান হয়, সেই মাদ্রাসার লেখা-পড়ার আর নীতি-আদর্শের দশা কী হতে পারে চিন্তা করুন।
এরপর দ্বিতীয় ব্যবস্থা হিসেবে ইংরেজ সরকার কলিকতা আলিয়া মাদ্রাসার পাঠ্য তালিকায় আঘাত হানে। একসময় আলিয়া মাদ্রাসায় হাদীস, তাফসীর, আধ্যাত্মিকতা, আরবী ব্যাকরণ বালাগাতসহ ধর্মীয় সমস্ত কিতাবাদি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে শিক্ষা দেওয়া হত। কিন্তু ইংরেজরা এই পাঠ্য তালিকায় পরিবর্তনের হাওয়া লাগিয়ে যায়। তৎকালীন সময়েই তাফসীরের প্রসিদ্ধ কিতাব বায়যাবী শরীফসহ অনেক হাদীও ও ফিকহের কিতাবকে বাদ দেওয়া। আর এখন তো আলিয়া মাদ্রাসায় ধর্মীয় সাবজেক্টগুলো কেবল মাদ্রাসা নাম ঠিক রাখার স্বার্থে কোনমতে পড়ানো হয়।
তিন নম্বর ব্যবস্থা- এক পর্যায়ে ইংরেজ সরকার আইন পাস করে, যেসব ছাত্র আরবী বা ফার্সী ভাষা মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ করবে, এরা সরকারীভাবে মূর্খ বলেই গন্য হবে। এই আইন পাশ করে নেওয়ার মাধ্যমে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা পড়ুয়াদেরকে অশিক্ষিত, মূর্খ সাব্যস্ত করে।
ইতিহাসের এই অধ্যায় পাঠ করলে বুঝা যায়, কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ভালো হলেও পরবর্তিতে ইংরেজদের হস্তক্ষেপের কারণে তা বহাল থাকেনি। মাদ্রাসা আবেদন করার মূলে আবেদনকারী মোল্লা মাযেদুদ্দীনের মতো বুযুর্গ হলেও মাদ্রাসা পরিচালিত হতো ইংরেজ কর্তৃক নিয়োগকৃত খ্রিস্টান প্রিন্সিপালের দায়িত্বে। এভাবে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রিক আলীয়া মাদ্রাসাসমূহ থেকে ইংরেজ সরকার মৌলিক ইসলামী শিক্ষাকে উচ্ছেদ করে দেয়ার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়েছিলো। যার চরম অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফল আজ মুসলমানদের সামনে।
ইতিহাসের কালে কালে যখনই যে ক্ষমতায় আসে ধর্মকে নিজের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার জন্যে এই মাদ্রাসা শিক্ষাকেই বেছে নেয়। কারণ আমার বিড়াল কখনো আমাকে ম্যাঁও বলবে না। পেটভরে আহার করিয়ে পিটভরে প্রহার করার লজিক তো জানাই আছে। আবার এসব মাদ্রাসায় চাকরি করে সরকারী অর্থে যাদের দিন কাটছে তারা ভাবেন, "যে গরু দুধ দেয় তার লাত্থি খাওয়াও ভালো।" অতএব সরকার দু-একটা ইসলাম বিদ্বেষী কর্মকাণ্ড অংশগ্রহণ করতে বললে সমস্যা কী?
কিন্তু দেশের সরকার ও সরকারী মাদ্রাসায় চাকুরীজীবী আলেমদের মানসিকতা যদি এই রকম হয় তবে শুধু মঙ্গল শোভাযাত্রা নয়, একসময় অসাম্প্রদায়িকতার বলয়ে বেঁধে দূর্গাপূঁজাতেও অংশগ্রহণ করিয়ে ছাড়বে। মনে রাখা খুবই জরুরী যে, রিযিকের মালিক আল্লাহ। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন,
ومامن دابة فى الارض الاعلى الله رزقها
অর্থ: “যমীনে যত প্রাণী আছে সবার রিযিকের মালিক মহান আল্লাহ পাক তিনি।” সূরা হুদ, আয়াত - ০৬
কেবল পার্থিব জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য লাভের জন্যে চোখ কান বুজে অসত্যের অনুসরণ করাটা নিতান্তই বোকামী। ইমামতি যাবার ভয়ে যে ইমাম হক কথা বলে না সে যেমন সবার কাছে ধিক্কৃত, তার মতো ধিক্কার যেনো আমরা না পাই। বড় কথা হলো আগুন অল্প থাকতেই নিভিয়ে ফেলতে হয়। চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে কিন্তু নিয়ন্ত্রনের উপায় থাকে না। সরকারের এইসব বিভ্রান্তিকর সিদ্ধান্ত অল্প থাকতেই বর্জন করে প্রতিবাদ করা দরকার। এখন মুখ বুজে সবর করতে থাকলে গায়ের পাঞ্জাবী আর মাথার টুপিও কিন্তু বাঁচানোর সামর্থ থাকবে না।
১৬০৪১৮, সিরাজগঞ্জ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন